ইয়াস-করোনা আসছে কেন?
মরলেও চোখ ভালো আছে- সান্ত্বনার মতো ঘূর্ণিঝড় ইয়াস নিয়ে এক ধরনের স্বস্তি অনেকের। স্বস্তির এমন বোধটা আসছে প্রাণহানির সংখ্যা দিয়ে। প্রাণহানি হয়নি মানে ক্ষয়ক্ষতি হয়নি-এ সরলীকরণ। আইলা, আম্ফান, সিডর, ফনি, বুলবুল, নারগিসের সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে ইয়াসকে মামুলি জ্ঞান করা হচ্ছে। খুলনা, ভোলা, হাতিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় গ্রামকে গ্রাম তলিয়ে যাওয়া, হাজার-হাজার মানুষের মানবেতর জীবনকে ক্ষয়ক্ষতি মনে করা যাচ্ছে না। গত কয়েক দশক ধরে দুর্যোগ মোকাবেলায় সক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানি এবং ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে৷ তবে রুদ্র প্রকৃতিকে বাগে আনার সাধ্য কি হচ্ছে? কাছাকাছি সময়ে আঘাত হানা সবচেয়ে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’৷
২০০৭ সালের নভেম্বরে আঘাত হানা ওই ঝড় এবং তার প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষ প্রাণ হারায়৷ আগে এ অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ের কোনো নাম দেওয়া হত না৷ ২০০০ সাল থেকে ঝড়ের নামকরণের জন্য নিয়ম বানানো হয়৷ তাতে ওয়ার্ল্ড মেটেরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশন ও ইউনাইডেট নেশনস ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়ার সদস্য দেশগুলি ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেওয়া শুরু করে৷ সদস্য দেশগুলোর মধ্যে আছে ভারত, বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, ওমান, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ড৷ সব দেশের কাছ থেকে ঝড়ের নাম চাওয়া হয়৷ তার থেকে দেশ প্রতি ৮টি করে নাম বাছাই করে মোট ৬৪টি ঝড়ের নামকরণ করা হয়৷ সেই তালিকার শেষ নাম ইয়াস ।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে আঘাত হানা শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে ১৯৮৮ এর ঘূর্ণিঝড়ের কথা স্মরণ করতেই হয়। ১৯৮৮ সালের নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড় লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে যায় যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর এবং বরিশাল ও খুলনা অঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায়৷ বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৬২ কিলোমিটার৷ এই ঘূর্ণিঝড়ে পাঁচ হাজার ৭০৮ জন প্রাণ হারান৷ এর চার বছর পর আসে ১৯৯১ এর ঘূর্ণিঝড়। এটি মূলত চট্টগ্রাম ও বরিশাল উপকূলে আছড়ে পড়েছিল৷ ঝড়ের প্রভাবে ১২ থেকে ২২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়৷ ২৯-৩০ এপ্রিলের এই ঘূর্ণিঝড়কে আখ্যা দেওয়া হয় ‘শতাব্দীর প্রচণ্ডতম ঘূর্ণিঝড়’ হিসেবে৷
এতে প্রায় এক লাখ ৩৮ হাজার মানুষ মারা যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এক কোটির বেশি মানুষ৷এর ৬ বছর পর ১৯৯৭ সালের ১৯ মে বাংলাদেশের সীতাকুণ্ড ও এর আশেপাশের এলাকায় আরেকটি ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ে৷ ঘণ্টায় ২৩২ কিলোমিটার বেগের বাতাসের সঙ্গে ১৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হয়৷ ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর দেশের দক্ষিণ উপকূলে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় সিডর প্রায় দশ হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল৷ সিডর বেশি তাণ্ডব চালায় খুলনা ও বরিশাল এলাকায় ৷ সমুদ্র থেকে উঠে আসা ১৫ থেকে ২০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে সব কিছু ভেসে যায়৷ ঝড়ে তিন হাজরের বেশি মানুষ মারা যায়৷ ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৩২টি জেলার ২০ লাখ মানুষ৷ উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ছয় লাখ টন ধান নষ্ট হয়ে যায়৷ সুন্দরবনের প্রাণীদের পাশাপাশি অসংখ্য গবাদিপশু মারা যায়৷
দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে একটি হলো নার্গিস৷ ২০০৮ সালের মে মাসে যেটি মিয়ানমারে আঘাত হানে৷ এতে প্রাণ হারায় ১ লাখ ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষ৷ ৪ লাখ ৫০ হাজার ঘর-বাড়ি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়৷ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও খুলনা উপকূলে ২০০৯ সালে ২৫ মে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা'৷ এই ঘূর্ণিঝড় ভারতের ১৪৯ জন ও বাংলাদেশের ১৯৩ জনের প্রাণ কেড়ে নেয়৷ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে উপকূলে প্রায় তিন লাখ মানুষ গৃহহীন হয়৷
এরপর ২০১৩ মহাসেন, ২০১৫ সালে কোমেন, পরের বছর ২০১৫ সালে রোয়ানু, ২০১৭ সালে মোরা, ২০১৯ সালে ফণী ও বুলবুলের ক্ষত এখনো সারেনি। প্রাণহানি ছাড়াও ঘরবাড়ি, বনভূমি, বাঁধ, সড়ক ও কৃষির ও্ই ক্ষতি অপুরনীয়। স্বাধীনতার আগেও একেকটি ঘূর্ণিঝড়এ অঞ্চলকে তছনছ করে গেছে। ১৯৬০ সালে অক্টোবরে ঘণ্টায় ২১০ কিলোমিটার গতির প্রবল ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, বাকেরগঞ্জ, ফরিদপুর, পটুয়াখালী ও পূর্ব মেঘনা মোহনায়৷ এতে মারা পড়ে প্রায় ১০ হাজার মানুষ৷ পরের বছর ১৯৬১ সালের ৯ মে অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে বাগেরহাট ও খুলনা অঞ্চলে৷ প্রায় সাড়ে ১১ হাজার মানুষ মারা যায় ওই ঝড়ে৷ ১৯৬২ সালে ২৬ অক্টোবর ফেনীতে তীব্র ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় হাজারখানেক মানুষের মৃত্যু হয়৷ ১৯৬৩ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত হয় চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কক্সবাজার এবং সন্দ্বীপ, কুতুবদিয়া, হাতিয়া ও মহেশখালী উপকূলীয় অঞ্চল৷ এই ঝড়ে প্রাণ হারায় ১১ হাজার ৫২০ জন৷
১৯৬৫ সালে মে মাসে ঘূর্ণিঝড়ে বারিশাল ও বাকেরগঞ্জে প্রাণ হারান ১৯ হাজার ২৭৯ জন৷ সে বছর ডিসেম্বরে আরেক ঘূর্ণিঝড়ে কক্সবাজারে মৃত্যু হয় ৮৭৩ জনের৷ পরের বছর অক্টোবরে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে সন্দ্বীপ, বাকেরগঞ্জ, খুলনা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কুমিল্লায়৷ এতে মারা যান ৮৫০ জন৷ ১৯৭০ সালের ১৩ নভেম্বর বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে প্রলয়ঙ্করী ‘গ্রেট ভোলা সাইক্লোন'৷ চট্টগ্রাম, বরগুনা, খেপুপাড়া, পটুয়াখালী, ভোলার চর বোরহানুদ্দিনের উত্তর পাশ ও চর তজুমুদ্দিন, নোয়াখালীর মাইজদি ও হরিণঘাটার দক্ষিণপাশ দিয়ে বয়ে যা্ওয়া ওই ঝড়ে প্রাণ হারায় প্রায় সাড়ে ৫ লাখ মানুষ৷
সাম্প্রতিক ঝড় ইয়াস আঘাত হানার আগেই অতি জোয়ার বা জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় ৯ জেলার ২৭ উপজেলার মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলার ভুক্তভোগীরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়া কাকে বলে। হাতিয়ার চরইশ্বর, সুখচর, সোনাদিয়া, তমরদ্দি, হরনী, চানন্দী ও নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়নের পানি বন্দি মানুষের দুর্ভোগ চরমে। নিঝুমদ্বীপের বেশিরভাগ এলাকা পানিতে নিমজ্জিত থাকায় বনের অসংখ্য হরিণ লোকালয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে।
অনেক হরিণ প্রবল জোয়ারে ভেসে গেছে। নিমজ্জিত এলাকার অধিকাংশ মৎস্য প্রজেক্ট ও পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। মরিচসহ কয়েক হাজার একর জমির রবিশস্য নষ্ট হয়ে গেছে। ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচর ও মনপুরা উপজেলার চর নিজামসহ বিভিন্ন চর এলাকায় ২৫০টি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। খুলনার কয়রা উপজেলার কপোতাক্ষ-শাকবাড়িয়া নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে ভেঙে গেছে বেড়িবাঁধ। এতে তলিয়ে গেছে সেখানকার অন্তত ৪০ গ্রাম। জোয়ারের পানিতে বাড়ির উঠান, রাস্তা-ঘাট, মাছের ঘের ও ফসলের মাঠ তলিয়ে গেছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে বাংলাদেশ নাজুক অবস্থানে। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে আবহমানকাল ধরে বাংলাদেশ বিভিন্ন সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত হয়ে আসছে। এসব ভয়াবহ দুর্যোগের মধ্যে রয়েছে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, কালবৈশাখী ঝড়, টর্নোডো, নদীভাঙন, উপকূলভাঙন, খরা, শৈত্যপ্রবাহ প্রভৃতি। এছাড়া সিসমিক জোন অর্থাৎ ইউরেশিয়ান প্লেট, ইন্ডিয়ান প্লেট ও বার্মা প্লেটের মাঝামাঝি অবস্থানে থাকার কারণে বাংলাদেশ ভূমিকম্প ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। রয়েছে, পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন একটি বাস্তবতা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা ও তীব্রতা দিন দিন শুধু বাড়ছে।
প্রকৃতির প্রতি চরম অবিচার, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, প্রকৃতিতে মানুষের অপরিকল্পিত হস্তক্ষেপ, নদীশাসন প্রভৃতির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নানা প্রভাবজনিত কারণে বাংলাদেশের বিপদাপন্ন হওয়ার শঙ্কা কেবল বাড়ছে। বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনার মাধ্যমে একটি দেশের দীর্ঘদিনের অর্জিত অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি দুর্যোগের কারণে বিলীন হওয়ার শঙ্কা ভর করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, প্রকৃতিতে মানুষের অপরিকল্পিত হস্তক্ষেপ রুখতেই হবে। পরিবেশ বিপদাপন্ন হলে তা দুর্যোগ-ঝুঁকিকে ত্বরান্বিত করে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঊর্ধ্বহার এবং এর প্রভাব বাংলাদেশকে আরো বিপদাপন্ন করার হাতছানি দিচ্ছে। প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপর আঘাতের পাল্টা আঘাত অনিবায । করোনার মতো মহামারি, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, শৈত্যপ্রবাহ এবং খরার মতো আপদ তার উদাহরণ মাত্র।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/এএসএম