একজন আলোকিত মানুষের প্রস্থান
অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমান খান চিরতরে ছেড়ে গেছেন আমাদের। গত কয়েক মাস ধরে বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন তিনি। একজন বিশ্বনন্দিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হিসেবে তিনি স্বীকৃত ছিলেন। মৃত্যুকালে ও উইসকনসিন ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সম্মানিত রোজবাখ অধ্যাপক ইমেরিটাস পদে এবং রোলিন্স কলেজে অধ্যাপক হিসেবে কাজ করছিলেন তিনি। ২০০৬ সালে তিনি অরল্যান্ডে চলে আসেন এবং সেই তখন থেকেই তার সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্কের শুরু। তার মতো বিশাল পরিসরের মানুষের কথা আমার পক্ষে তুলে ধরা কঠিন।
১৯৭১ সালে তার জগদ্বিখ্যাত ভাই স্থপতি ড. এফ আর খান (শিকাগোর সিয়ার্স টাওয়ারসহ অনেক বিখ্যাত স্থপনার এবং স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জনক) বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য গঠন করেছিলেন 'বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন' নামের একটি সংগঠন যা আন্তর্জাতিক পরিসরে মুক্তিযুদ্ধের জন্য জনমত সৃষ্টি করত এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সাহায্য সংগ্রহ করত। তিনি মারা যাওয়ার পর ড. জিল্লুর রহমান খান সে সংগঠনটিকে আবার জাগিয়ে তোলেন এবং বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য এ সংগঠনের মাধ্যমে অনেক কাজ করেছেন।
আমার সৌভাগ্য হয়েছিল বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের বোর্ড অব ট্রাস্টির একজন সদস্য হিসেবে তার সাথে কাজ করার। জিল্লুর আঙ্কেল বলে ডাকতাম তাকে। আমাদের পুরো পরিবারই ছিল তার স্নেহধন্য। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হলেও তার বিদ্যার পরিধি ছিল অসীম। যেকোনো ব্যাপারে তার জ্ঞানের পরিধি ছিল গভীর। যুক্তিতর্কের মানুষ ছিলেন। আলোকিত মানুষ ছিলেন।
১৯৩৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তার জন্ম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতোকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৫৭ সালে। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার ক্লেরমন্ট ইউনিভার্সিটি থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। উইসকনসিন ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত। তারপর ফ্যাকাল্টি সিনেটের চেয়ারম্যানও ছিলেন তিনি।
ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশনের আরসি-৩৭ এর চেয়ারম্যান হিসেবে বহু আন্তর্জাতিক সম্মিলন করেছেন তিনি। শিক্ষকতা, গবেষণা, সমাজসেবার জন্য তিনি অনেক জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কার এবং সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- উইলি স্মিথ ডিস্টিংগুইশ টিচিং অ্যাওয়ার্ড, রোসেবাক প্রফেশনাল অ্যাওয়ার্ড। তার উল্লেখযোগ্য নেতৃত্বের জন্য দুইবার তিনি আমেরিকান পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশনের সেরা শিক্ষক এবং গবেষকের সম্মান লাভ করেন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে তার অসামান্য ভূমিকা ও দক্ষতার জন্য এবং দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর তার গবেষণার জন্য আমেরিকার কংগ্রেস তাদের ১০০তম বিশেষ অধিবেশনে তাকে বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তানের গণতন্ত্রের বিকাশের ওপর বিশেষ আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ করেন। অধ্যাপক ড. জিল্লুর খান ১২টি বই, ২০টি বইয়ের অংশ, ৫০টিরও বেশি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন।
২০০৬ সালে অরল্যান্ডোতে আসার পর তিনি এখানকার সব সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে সংশ্লিষ্ট রেখেছেন। তিনি খুবই অমায়িক, মিষ্টভাষী মানুষ ছিলেন। যে কাউকে তিনি নিমিষেই কাছে টেনে নিতে পারতেন। তিনি একজন সংস্কৃতিমনা মানুষ ছিলেন। ভরাটগলায় চমৎকার রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন তিনি। একটি সিডিও বের করেছিলেন তিনি। নিয়মিত সাঁতার কাটতেন তিনি, ভ্রমণ করতেন, গান শুনতেন, সব ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকতেন।
প্রতিবছরে কয়েক মাস বাংলাদেশে কাটাতেন তিনি। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতির উন্নতির জন্য নিয়মিত টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিয়মিত তার গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিতেন। তার মৃত্যুতে একজন আলোকিত মানুষের খুব সফল জীবনের প্রস্থান হলো। একজন অসাধারণ দেশপ্রেমিক হারালো বাংলাদেশ, একজন আলোকিত বিশ্বমানব হারালো মানবতা।
আমি অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমান খানের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। আমি তার রুহের মাগফেরাত কামনা করছি।
এইচআর/জেআইএম