“কঙ্কাল” রবীন্দ্রনাথ ও একটি পুনঃপাঠ
ড. লুৎফর রহমান
১৯১৩ সালে ৮১ বছর বয়সে কবি এজরা পাউন্ড রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্বন্ধে বলেছিলেন ‘উদ্ধৃতির জন্য যে কবিতাই তুলি পরেরটা পড়ে ভাবি বুঝি ভুল করলাম [..]’। আমরা ভুল করি না, কারণ আমরা তাঁর ভিতর বাহির এতোটাই জানি যে, কখনও পড়িই না! পড়ি না তাই ভুলও করি না। পড়লেও ভুলভাবে পড়ি কিংবা ব্যাখ্যা করি। কবি শঙ্খ ঘোষের ‘পাঠক’ প্রবন্ধ পড়ে অন্তত এরূপই উপলব্ধি হয়েছে। জীবদ্দশায় রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং অকাট্য যুক্তিতে সমালোচকদের কতো আখ্যা-ব্যাখ্যার ভ্রান্তি চিহ্নিত ও অগ্রাহ্য করেছেন তার দৃষ্টান্ত রবীন্দ্র-রচনাবলিতে সংরক্ষিত।
কথাটি এ-কারণে বলছি, ছাত্রাবস্থায় দশম-একাদশ শ্রেণির ঐদিকে কোথায়ও ‘কঙ্কাল’ গল্পটি পাঠ্য ছিল। পড়েছি, শিক্ষকের ব্যাখ্যা শুনেছি। মৃত নারীর প্রেতিনিটাই তখন কায়াহীন শরীরে বিসদৃশ কঙ্কালের বিপরীতে ঘরময় হেঁটে বেড়াতো, জ্যান্ত। কখনও সরোষে কাষ্ঠহাসি ছড়াতো অন্ধকার চৈতন্যে। গল্পটির মর্মে কঙ্কালের হাড়হাড্ডি ছাড়া আর কোনো বস্তগত সত্য রবীন্দ্র-দৃষ্টির আলোক সম্পাতে বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে কি-না তা ঐ বয়সে অনুসন্ধানের বিষয় হয়ে ওঠে নি। বরং শ্রেণি শিক্ষকের বর্ণনায়, ব্যাখ্যায় এক ভয়ংকর আধিদৈবিক পরিবেশ মূর্ত হতো মনে। অতএব, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্ষুধিত ‘পাষাণ’, ‘কঙ্কাল’ গল্পের আলোচনা শুনে, নাট্যরূপ দেখে অনেক বন্ধু উত্তীর্ণ সন্ধ্যায় এ-ঘর-ও-ঘর করতে ভয় পেতেন।
কঙ্কাল প্রকৃত পক্ষে জীবদেহের হাড়ের কাঠামো, অস্থিপঞ্জর। মাংসমজ্জাশূন্য হাড়ের খাঁচা। ডাক্তারী বিদ্যা চর্চার বাইরে তার কোনো ব্যবহারিক গুরুত্ব খুব একটা নেই। মানবদেহের হাড়হাড্ডির হিসেব বা নামপরিচয় বা অবস্থান সম্বন্ধে জ্ঞান দেবার উদ্দেশ্যে এ-গল্প রচনা করা হয়েছে তা নয়। প্রত্যেকটা কঙ্কালের পেছনে থাকে এক একটা জীবন্ত মানুষ। তাদের জীবন সম্বন্ধে আমরা কিচ্ছু জানি না অথচ তার কঙ্কাল বিষয়ে আমরা নানান তথ্য মুখস্ত করি। একটি কঙ্কালের জীবিত কালের যে-স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা, প্রেম-কামনা-বাসনাপূর্ণ জীবন গল্পে সেই জীবনের কথা, তার জবানিতে বর্ণনা করা হয়েছে।
কঙ্কালের সাথে এতদাঞ্চলে বসবাসকারী ভূত-প্রেতের নিবিড় যোগ: সামন্ত বিশ্বাস এই যে, অপঘাত মৃত্যু হলে যে-ব্যক্তির মৃত্যু হয় তার অতৃপ্ত আত্মা বসবাস স্থানে আবার আসে, বার বার। তার কঙ্কালকে খোঁজে। হত্যাকারীর উপর প্রতিশোধ নেয়। অতএব, অপঘাতে কেউ, যে-ঘরে মরেছে সে ঘর পরিত্যক্ত ঘোষণা করে পরিবারটি। আমরাও এই অনগ্রসর, সংস্কার-কুসংস্কারের শিকড়-বাকড় সমাচ্ছন্ন সমাজে শৈশব, কৈশোর এমনকী যৌবনবেলা কাটিয়ে এসেছি। ভূত-প্রেত নিয়ে গল্পে আসর জমিয়েছি, সমাজ নিয়ে সমাজের প্রচলিত বিধিবিধান জীবনের জন্য কতো বড় প্রতিবন্ধক তা নিয়ে ভাববার প্রয়োজন বোধ করি নি। পরিণত বয়সে কঙ্কাল পুনরায় পাঠ করলাম। মনে হলো - কঙ্কালটা চোখের উপর থেকে, ভাবনার দরজা থেকে পলকে উধাও হলো। দেখলাম এ-গল্পে রবীন্দ্রনাথ কঙ্কালটি সম্বন্ধে একটি শব্দও লিখেন নি। শুনিয়েছেন বলেছেন- যে-নারীর এই কঙ্কাল, তার জীবনেতিহাস। না, তাও নয়, সেই নারী যে-সমাজে বাস করতো, যে-গোঁড়া সমাজের সে প্রতিনিধি, যে-সমাজের প্রচলিত বিধি-বিধান, ভ্রান্ত শাস্ত্রনীতি তাকে কঙ্কালে পরিণত করেছে এবং বিনষ্ট করে চলেছে তার মতো অসংখ্য নারীর জীবনকে সেই সমাজের চিত্র অংকন করা লেখকের উদ্দেশ্য। সেই কঙ্কালসার সমাজের ভ্রান্তিগুলো, ক্ষমতাধর সমাজনিয়ন্তার চোখে মূর্ত করতেই রবীন্দ্রনাথ এই গল্প রচনা করেছেন। প্রেতাত্মার নাম শুনে বেহুঁশ আমরা আড়ালে থাকা দুর্ভাগা এক নারীর যন্ত্রণা কাতর অস্তিত্বের উপস্থিতিকে দেখতেই পাইনি। অন্তত আমার বেলায় এই-ই সত্য।
রবীন্দ্র-গল্প প্রসঙ্গ এলেই দৃষ্টিপথে ভেসে ওঠে পূর্ববঙ্গ এবং এর জনমানুষ, জীবন যাপন, সমাজিক জীবন ও মানুষের কর্মমুখর জীবনের চিত্র। সম্ভবত তাঁর খুব কম সংখ্যক গল্পই কোলকাতা বা অন্যকোনো স্থানে লেখা। শিলাইদহ, সাহজাদপুর ও প্রতিসরে বসবাসকালে, পদ্মায় বোটে, সাহজাদপুরের কুঠিতে বসে লেখা। যতোদূর জানা যায়,‘পোস্টমাস্টার’ গল্পটিই রবীন্দ্রনাথের লেখা প্রথম গল্প। সাহজাদপুর তাঁর খুব প্রিয় স্থান ছিল। ‘ছিন্নপত্রে’ তিনি এই প্রিয় জায়গাটি সম্বন্ধে অনেক কথা বলেছেন এবং এখানে বসে গল্পলিখার আনন্দ ও ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পটি কিভাবে রচিত হলো তার মনোজ্ঞ বর্ণনা আছে। পদ্মা, যমুনা, ছোট যমুনা, আত্রাই, নাগর নদী এবং ‘চলন বিল ছিল কবির শিলাইদহ থেকে পতিসর, সাহজাদপুর যাতায়াতের বিচিত্র- বৈচিত্র্যে ভরা পথ। এই যাতায়াত কালেই তিনি নদী ও নদী তীরবর্তী গৃহস্থজীবনে ও প্রান্তরে ষড়ঋতুর বিচিত্র লীলা দেখতে পেতেন। উদয় দিগন্তের সূর্য, অস্তপাটে কিরূপে বাসরযাত্রার বধূরবেশে সাজে মুগ্ধচিত্ত প্রেমিকের চোখে তা দেখেছেন। মধ্যদুপুরের গৈরিক বাউলরূপ আবার পড়ন্ত বিকালের নিভু নিভু সূর্যের থাকে না। সন্ধ্যার রূপের সাথে অন্ধকার মধ্যরাতের এবং জোছনার ও অমাবশ্যার কি যে পার্থক্য! কবির অন্তর ভরে যেতো তাঁর সোনার বাংলার মোহনীয় রূপ দেখে। জোছনা রাতের পদ্মার চরের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ কবি, ছিন্নপত্রে তাই লিখেন -‘বাস্তবিক পৃথিবী যে কি সুন্দরী কোলকাতা থাকলে তা বুঝা যায় না।’ এ-কথাও সমান সত্য যে, রবীন্দ্র- ছোটগল্পে বাংলার প্রকৃতি, মানুষ, সমাজ, অর্থনৈতিক জীবন ও সংস্কার-সংস্কৃতির যে-রূপ ভাষা, সংলাপ, চরিত্র, কর্ম ও যাপন পদ্ধতির মধ্য দিয়ে চিত্রিত হয়েছে তা আর কোথাও চোখে পড়ে নাই। আমরাও তাঁর মতো করে এস্থলের মানুষকে ভিতর-বাহির এক করে দেখিনি অমন।
প্রাচীন-মধ্যযুগের বাংলার সমাজ ধর্মশাস্ত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তন্ত্র-মন্ত্রের উৎসভূমি প্রাচীন বাংলার লোকমানসে ভূত-প্রেত, দৈত্য-দানব, জাদু-টোনার প্রতি আলাদা আকর্ষণ থাকা অস্বাভাবিক নয়। উৎপাদকশ্রেণিকে কায়েমী স্বার্থে জ্ঞানালোকের ছোঁয়া পেতে দেয় নি বৈদিক এবং তার পরবর্তী ব্রাহ্মণ্য সমাজের পুরোহিততন্ত্র। বৌদ্ধধর্মে নির্বাণ লাভের সহজ উপায় হিসেবে সাংসারিক মায়ার বাঁধন ছিন্ন করে ভিক্ষান্নে জীবন যাপন করাই ছিল বিধান। ভিক্ষান্নে জীবন ধারণ করেই প্রেমে জল হয়ে গলে অচিন্ত্যদ্বৈতাদ্বৈত তত্ত্বের স্রষ্টা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু আসমুদ্র-হিমাচলে মানবপ্রেমের তরঙ্গ উৎক্ষিপ্ত করেছিলেন। ব্রাহ্মণশ্রেণি আর একটি সুবিধা আদায় করেছিলেন সমাজ থেকে- নারীর সহমরণ বা সতীদাহের বিধান দেবার আগে হরণ করেছিলেন তার সম্পত্তির অধিকার। হিন্দু নারী সম্পত্তির উত্তরাধিকারী নন। পুরুষের কর্তৃত্বের অধীন, কেবলই তার ভোগ্যপণ্য, একই সঙ্গে ‘সংসার আশ্রমে’র নিরুপায় শ্রমিক। বালবিধবাকে ভরণপোষণ, প্রতিপালনের দায় নেবে কে? অতএব, পুণ্যার্থে পুড়িয়ে সহমরণে পাঠাও। সমাজপতি দেখল, ব্রাহ্মণ প্রকারন্তরে মঙ্গলজনক বিধানই দিয়েছে। পুড়ে যে-ছাই হলো বিধান দাতা ব্রাহ্মণের তাতে খুব বড় কোনো লাভ হলো না। ভেবে দেখা গেল লাভ আছে, একটু ঘোর পথে যেতে হবে। সহমরণের পাশেই থাক, বাল্যবিবাহ ( গৌরিদান), কৌলিন্য প্রথা (সলোম, অনুলোম বা প্রতিলোম বিবাহ প্রথা), তাতে অধিক লাভ। অকাল বিধবা যার সহমরণের ভয় আছে সে দেবসেবায় জীবনোৎসর্গ করবে। অর্থাৎ সে আমৃত্যু সেবাদাসীর জীবন যাপন করবে - দেব-ব্রাহ্মণের সেবাই হবে তার ইহজীবনের একমাত্র আরাধ্য। অবসরভোগী পরশ্রম শোষক ব্রাহ্মণ তৎকালীন সমাজের সর্বাপেক্ষা সুবিধাভোগী ভারতীয় নাগরিক। সমাজপদ্ধতির ভিতরে ঘুণ হয়ে ঢুকে এই প্রতিষ্ঠানটিকে ধীরে ধীরে কঙ্কালে পরিণত করেছে তাঁরাই। সমাজে ভেদাভেদ, বিভেদ সৃষ্টিকারী তাঁরা। মানুষকে শূদ্র, অচ্ছুত, তুচ্ছ করেছেন তাঁরাই।
জীবনের প্রতি কী অমানবিক আচরণ, অকারণ অবহেলা! নারীত্বের কী অপমান। রামমোহন (১৭৭২-১৮৩৩), বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) ভারতীয় পুরুষ শাসিত বঙ্গীয় সমাজের এই অসহায় অবলা অধিকার বঞ্চিতা নিগ্রহের শিকার নারীদের মুক্তির জন্য জীবনপাত করেছেন। হয়তো তাঁরা এটাও উপলব্ধি করেছেন যে, একমাত্র বৈষ্ণব ব্যতীত এশীয় সমাজের প্রায় সকল ধর্মের বিধানদাতাই নারীর প্রতি সহিংস। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই নারীকে এই দুরবস্থা থেকে প্রকৃত মুক্তি দিতে সক্ষম, এই ভাবনাই তাঁদেরকে নারী শিক্ষা বিস্তারে অনুপ্রাণিত করে থাকবে। ব্রাহ্ম পরিবারের সন্তান রবীন্দ্রনাথ সংখ্যা লঘু ব্রাহ্মদেরও হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত জ্ঞান করতেন। সুতরাং হিন্দু সমাজ কালের বিবর্তন ধারায় উনিশ শতকে এসে যে, একটি কংকালে পরিণত হয়েছে মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথ তা উপলব্ধি করেছিলেন। তাই নারীর অধিকার, নারীর স্বাতন্ত্র্য রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন রচনায় বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচ্য বিষয় হয়ে ওঠে। পাঠক ভাবতেই পারেন রামমোহন, বিদ্যাসাগরের কালকে জোর করে রবীন্দ্রনাথের ঘাড়ে চাপিয়ে এ-যাত্রা দুর্যোগ পার হতে চাচ্ছি। ধৃষ্টতা নেবেন না, ‘কঙ্কাল’ গল্পটি রবীন্দ্রনাথ লিখেন ১২৯৮ বঙ্গাব্দে (১৮৯১ সাল) তাঁর ত্রিশ বছর বয়সে। ঐ বছরটি বিদ্যসাগর মহাশয়েরও মৃত্যুর বছর। বিদ্যাসাগরের দীর্ঘ দিনের আবেদন, লেখালেখির পর ঔপনিবেশিক শাসন ঐ বছরই “বাল্য বিবাহ দমন করবার জন্য ‘সঙ্গমের’ ন্যূনতম বয়স-নির্দেশক এক আইন প্রণয়ন করেন (১৮৯১)।” সর্বস্বান্ত¡ বিদ্যাসাগর ‘বিধবা বিবাহদানে’র সপক্ষে আইন পাশ করিয়েছিলেন ১৮৫৬ সালে, বিধবার বিয়েও দিয়েছেন কিন্তু বাঙালি, প্রথার দাস- বিদ্যাসাগরের জীবদ্দশায় এদেশের সর্বত্র ‘বিধবা বিবাহ’ দেশচল হয়নি। বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম, ‘কঙ্কাল’ আমাদের বিবেচনায় ‘বিধবা বিবাহে’র পক্ষের একটি প্রতিবাদী রচনা। না পাবার ক্ষোভে ক্রুদ্ধ, ঈর্ষান্বিতা এক বিধবার বাঞ্ছিতজনকে হত্যা, অতঃপর স্বয়ং আত্মহত্যা করবার ইতিবৃত্ত।
গল্পে লেখক একটি পক্ষের প্রতিনিধি। সেই পক্ষেই তিনি উকালতি করেন- যেমন, হৈমন্তী গল্পে লেখক হৈমন্তীর শ্বশুরের বিপক্ষে। অর্থাৎ বাল্য বিবাহ ও পণ প্রথার বিরুদ্ধে। তা হলে গল্পে বিষয় বা ঝঁনলবপঃ হলো পণ প্রথার বা বাল্য বিবাহের কুফল। ‘কঙ্কাল’ গল্প যার জীবন কাহিনী সেই মেয়েটি বিধবা। বিধবা বলে তার প্রেমিক ডাক্তার বড় অঙ্কের যৌতুকের লোভে, সমাজের ভয়ে বিধবা প্রেমিকাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। আর সেই যন্ত্রণায় বিধবা যুবতী আত্মহত্যা করে। কিন্তু তার আগে সে তার প্রেমিককেও বিষ প্রয়োগে হত্যা করে। আজ সে নেই আছে তার কঙ্কাল। আছে কঙ্কালসার সেই সামন্ত সমাজ। গল্পকারের মনে হয়েছে - বুঝি সে নারী অপূর্ণজীবন স্বপ্নের, অচরিতার্থ প্রেমের অতৃপ্তি নিয়ে যৌবনের অপূর্ব ঐশ্বর্যভরা দেহের কাঠামোটির কাছে রোজ রাতেই আসে। আত্মা-তো, অশরীরী অমর।
কঙ্কাল গল্পের উপস্থাপনা অংশটি লেখক স্বীকার করেছেন সত্যি ঘটনা। কঙ্কালটি বাস্তব সত্য, মেয়েটি অমূর্ত সত্য তাঁর চেতনায়। গল্পের প্রথম দুটি অনুচ্ছেদের বাস্তব সত্যের উপর কল্পনার রঙ চড়িয়েছেন লেখক। পরবর্তী কালে “পুণ্যস্মৃতি” নামক রচনায় কিভাবে ‘গল্পটি মাথায়’ এলো তা বর্ণনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। কঙ্কাল সত্য, সেই অনেক বছর পরে রাত্রি যাপনের ঘটনা সত্য। কঙ্কালটি যে-এক মেয়ের তা কাব্য সত্য। রোজ রাতে তার এই ঘরে আসার প্রসঙ্গ, এবং কঙ্কালটির জীবিত মানুষের মতো আত্মকাহিনী বর্ণনার ঘটনা কবি কল্পিত। সেই গল্পে বাস্তব পারিবারিক, সামাজিক জীবনের যে-তথ্য আছে তা এরূপ-
মেয়েটি এক সম্পদশালী পরিবারের সন্তান। বাল্যবিবাহের শিকার। বিয়ের দুই মাস পরই তার স্বামীর মৃত্যু হয়। বিধবা হয়ে সে চিরকুমারব্রত গ্রহণকারী ভাইয়ের সংসারে জীবন কাটাতে থাকে। ধীরে ধীরে বালিকা থেকে কিশোরী এবং তারপর যুবতীর রূপযৌবনে পরিপুষ্ট ষোলকলা চন্দ্র হয়ে ওঠে বিধবা মেয়েটি। নিঃসঙ্গ সেই নারী আপন সৌন্দর্যে মুগ্ধ ছিল। তার অনন্য রূপের বর্ণনা সে গল্প লেখককে শোনায়। অনেক বছর পরে, ডগমগ এই যুবতী জ্বরে আক্রান্ত হলে ভাইয়ের একমাত্র ঘনিষ্ট ডাক্তার বন্ধুর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। অসূর্যম্পর্শা এই নারী প্রথম দর্শনেই ডাক্তারের প্রতি প্রেমাসক্ত হয়। কিন্তু তা গোপন থাকে মনে। কারণ সে বিধবা। পুরুষের প্রেম তার জন্য নয়। শাস্ত্রের অমূলক দোহাই দিয়ে সেকালের সমাজ বিধবার প্রেম, বিবাহ নিষিদ্ধ করেছে। দেহে যৌবন টগবগ করবে কিন্তু তার জন্য অন্তরে প্রেম আসা শাস্ত্রীয় বিধানে (?) পাপ, সামাজিক বিচারে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু প্রেম মানব স্বভাবের অন্তর্গত - মনোদৈহিক উপলব্ধি, প্রয়োজনও বটে। প্রেম তো অদৃশ্য, তাই অদৃশ্য মনে দিনে ক্ষণে বাড়ে। এক্ষত্রেও তাই হলো - মেয়েটির প্রেমের শিকড় ডাক্তারের অস্তিত্বের গহীনে বিস্তৃত হলো। ডাক্তার নিজেও তাকে ভালোবাসতো।
একদিন মেয়েটি জানতে পারে - রাতের লগ্নে ডাক্তারের বিয়ে। ডাক্তারের স্ত্রী হবে অন্যকোনো নারী, এটা ছিল তার কাছে সহ্যাতীত। মৃত্যু ছাড়া তার মুক্তির পথ ছিল রুদ্ধ, জানতো সে। বিষ প্রয়োগে ডাক্তারকে হত্যা করে, নিজে সে আত্মহত্যা করবে এটাই ছিল মেয়েটির সিদ্ধান্ত। বিষ মিশানো থাকায় চা পানে মৃত্যু হয় ডাক্তারের। অতঃপর, বিয়ের সাজে সজ্জিত মেয়েটি বকুল তলায় বিছানা পাতে এবং বিষ পান করে। প্রেমিক-প্রেমিকার সাথে প্রেমেরও মৃত্যু ঘটে। আত্মকাহিনী শেষ হতেই কাক ডাকে। সকাল। নিত্যবাস্তবের রুক্ষতার ধাক্কায় লেখকের কল্পবাস্তব ঝনাৎ শব্দে গুঁড়িয়ে যায়।
আখ্যান শেষে সহৃদয় পাঠক, দ্বিধা বিভক্ত - একপক্ষ একটি আত্মাকে প্রেতের বেশে তার দেহ কাঠামো খুঁজতে খুঁজতে একটি অন্ধকার ঘরে এসে বিনিদ্র লেখকের সাথে গল্প বলে শুনে গালাগাল করে, বলে ঘাঁজাখুরী! আবার ভাবে- কী ভয়ংকর, লেখকের সাহস কতো! এই শ্রেণির পাঠকের বিশ্বাস যুক্তি খোঁজে না - যুক্তি ও বিজ্ঞানকে সজারুর কাঁটা জ্ঞানে তাঁদের বিশ্বাস দৌড়ে পালায়। তাঁরাই চাঁদের গায়ে পৃথিবীতে বসবাসরত ও জীবন্ত তাঁর মতোই আর একজন মানুষের মুখচ্ছবি দেখে। সমাজ নামক কঙ্কাল, বিশ্বাস নামক কঙ্কাল, সামাজিক প্রথা নামক কঙ্কালের তাঁরাই রক্ষা কর্তা, প্রতিপালক। হাজার বছর ধরে তাঁরাই এইসব কঙ্কালের ইজারাদার। ক্ষণেকের জন্যও তাঁরা এগুলোকে কাঁধ থেকে নামায় না।
অপর কাতারে যাঁরা দাঁড়াবেন তাঁরাও মহা দ্বিধান্বিত। একবার তাঁদের বিচারে, মেয়েটা মূলত রাক্ষুসীÑ তার মনুষ্যত্বকে গ্রাস করেছে তার ঈর্ষা। প্রেমের জন্য প্রেমিককে খুন করলো সে? খুন করে ফাঁসির ভয়ে আত্মহত্যা করেছে, ডাইনি একটা। হিন্দ্র সম্প্রদায়ের কোনো সীমন্তিনী নিশ্চিয়ই খবর শুনে ছিঃ ছিঃ করে বলেছিলেন - ‘ছ্যা, ছ্যা, ছ্যা! বিধবা মাগীর খায়েস দেইখ্যা বাঁচি না। হইছস বিধরা তোর আবার পিরীতের লালস! কী-কাল আইল মাগো!’
আবার সমাজ-নৌকার হাল ধরে যিনি বসা, তিনি বললেন, ‘দুই-দুইটা পাপ- নিজেকে হত্যার পাপ; অন্য এক পরপুরুষকে খুনের পাপ। এইবার এই দুই পেতনি কী-করে দেখো।’ সকলেই দূরবর্তী দরগা ঘরের অদৃশ্য কুত্তা খেদায়, ভাতের তলের ভাজা কৈ-মাছটা দেখতে পায় না। দেহধারী নারী, যুবতী বিধবা - যৌবন থাকবে, অথচ তার কামনা বাসনা থাকবে না, এ কী করে হয়! সমাজ বিধান দিয়েছে, থাকতে পারবে না। থাকলে, সে অসতী, কুলটা। একঘরে করে রাখা হবে তার পরিজনকে। অস্তিত্বের সংকটে পড়লেই তো ক্ষমতাধর ব্যক্তির পায়ের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দেবে সে। রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র প্রত্যেকেই নিজ নিজ সমাজে এই অসহায় নারীদের দুর্দশার প্রত্যক্ষদর্শী। তাঁরা বিস্তর লিখেছেন সমাজ সংশোধিত হয় নি, সংস্কৃত হয় নি। তার কারণ কায়েমী স্বার্থ।
রবীন্দ্রনাথ বাঙলার অকাল বিধবা নারীর মনটিকে, তাঁদের মনের সুপ্ত আকাক্সক্ষাকে যেনো কঙ্কালের জবানিতে উপস্থাপন করেছেন। লেখককে কঙ্কালের ছায়া-সত্তা বলেছে-
[..] [..] বাগানের গাছতলায় আমি একা বসিয়া ভাবিতাম, সমস্ত পৃথিবী আমাকেই ভালোবাসিতেছে, সমস্ত তারা আমাকে নিরীক্ষণ করিতেছে, বাতাস ছল করিয়া বার বার দীর্ঘশ্বাসে চলিয়া যাইতেছে এবং যে তৃণাসনে পা দুটি মেলিয়া বসিয়া আছি তাহার যদি চেতনা থাকিত তবে সে পুনর্বার অচেতন হইয়া যাইত। পৃথিবীর সমস্ত যুবাপুরুষ ঐ তৃণপুঞ্জরূপে দল বাঁধিয়া নিস্তব্ধে আমার চরণবর্তী হইয়া দাঁড়াইয়াছে, এইরূপ আমি কল্পনা করিতাম; হৃদয়ে অকারণে কেমন বেদনা অনুভব করিতাম। [গল্পগুচ্ছ, বিশ^ভারতী সংস্করণ, পৃ. ]
আশ্চর্য আত্মসচেতন এই নারী। এবং এটাই জৈবনিক স্বাবাভাবিক প্রবণতা। যৌবন অযাচিত শূন্যতায় এভাবেই ভরে তোলে যুবক পুরুষ ও যৌবনবতী নারীর মন। হোক সে সধবা বা বিধবা কামনার কেউটে তার জীবদেহে ছোবল দেবেই। যে-সমাজ রক্তমাংসের মানুষের দ্বারা পরিচালিত, তার ব্যবস্থাপক গোষ্ঠী এই চিরায়ত সত্যকে অগ্রাহ্য করতে পারে না। যে-সমাজ কৃচ্ছতাসাধনের মধ্যে মুক্তি খোঁজে, সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করে গার্হস্থ্য জীবন থেকে পালিয়ে আত্মরক্ষা করে সে-সমাজে এই সমানুভূতি সম্পন্ন মন থাকতে পারে না- তো! গল্পের নায়িকা এই মেয়েটি ধর্মসম্প্রদায়ের নীতির ছাঁচে সৃষ্ট নয়- কামনা-বাসনা ইত্যকার ষড়রিপুর তাড়নায় অস্থির মানবী। ভালোবেসেছে সে এক পুরুষকে। তাকে ঘিরেই তার যাবতীয় আকাক্সক্ষা-স্বপ্ন-কল্পনা পল্লবিত হয় আর কিছু নয়। যে-সুখ নিজের জন্য নিষিদ্ধ তা অন্যকে ভোগ করতে দেখলে রক্তমাংসের অধিকারী সকলেই ঈর্ষান্বিত হবেই। প্রতিশোধের আগুন ব্যক্তি মনে দাউ দাউ জ্বলে। মেয়েটি বিধবা, এটা তার অপরাধ নয়- কিন্তু সমাজ তার বিবাহের অধিকার হরণ করেছে। জীবনকে, যৌবনকে ভোগের অধিকার হরণ করেছে। সেই সমাজেই মেয়েটির চোখের উপর তার প্রেমের পাত্রকে নিয়ে অন্য কোনো নারী সুখভোগ করবে তা হতে পারে না। তাই এর মীমাংসা প্রয়োজন। অতঃপর ভিন্ন চিত্র পাঠকের চোখের উপর-
যার দেহাবশেষ এই কঙ্কাল সে বলেছে, “আমি। আমার সেই কঙ্কালটা কোথায় গেছে তাই খুঁজিতে আসিয়াছি”। হারালে খোঁজা মানব স্বভাব। খুঁজতে কোথায় এসেছে আত্মাটি? সমাজের দেয়ালে তার কঙ্কাল খুঁজতে এসেছে। কঙ্কালের জীবন্তরূপ যে-মেয়েটি অতঃপর সে তার মানুষরূপ থেকে কঙ্কালে পরিণত হবার গল্প শোনচ্ছে এই গল্পের মূল কথককে।
তারপর প্রশ্নোত্তরের মধ্য দিয়ে গল্পটি এগিয়েছে। মৃত যুবতী লেখককে যে- গল্প শোনায় তাতে আছে- ক. তার বাল্যবিবাহের গল্প, খ. বালিকার স্বামী ভীতি, স্বামীর অকাল মৃত্যুর খবর; গ. সেকালের নিয়ম অনুযায়ী বিধবা হয়ে বাবার বাড়ি চলে আসার কথা; ঘ. বালিকা থেকে যুবতী হওয়ার পর রূপযৌবনের ঐশ্বর্য কথা; ঙ. দাদার ডাক্তার বন্ধু শশীশেখরের প্রতি মুগ্ধতা, ভালোবাসার কথা; চ. বারো হাজার টাকা পণ নিয়ে ডাক্তারের বিয়ে ঠিক হওয়ার কথা; এবং ছ. মেয়েটির অপূর্ণ জীবনে ব্যর্থতার গ্লানি সহ্য করতে না পেরে, আত্মহত্যা এবং তার পূর্বে জীবনের প্রথম ও একমাত্র প্রেম শশীশেখরকে অন্যের অধিকারে যেতে না দেওয়ার সিদ্ধান্তে তাকেও বিষ প্রয়োগে হত্যা করবার কথা। সমাজের উপর সে প্রতিশোধ গ্রহণ করেছে।
গল্পের ভাষা চরিত্রের জীবনের মতো সহজ সরল। দীর্ঘবাক্য কিন্তু তা সরল। কখনও যৌগিক। জটিল নয়। অসমাপিকা ও সমাপিকা ক্রিয়ার ব্যবহারে তা অত্যন্ত গতিশীল। চরিত্রের ভাষা এবং লেখকের ভাষা এখানে অভিন্ন। কারণ চরিত্রই তার জীবনের গল্পটির বর্ণনাকারী বা কথক। দুজন কথক গল্পটি বলছে একজন আরম্ভকারী ও ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাটকের ঠ্যাটার মতো প্রশ্ন কর্তা। অন্যজন যার জীবনের গল্প সেই নারী। দুজনই উত্তম পুরুষে কথা বলছে। উত্তম পুরুষের কথা বরাবর আত্মকেন্দ্রিক, আমিত্ব থাকে ভাষার কেন্দ্রে। ভাষাও হয় অন্তর্মুখী। কঙ্কাল গল্পেও এ-রীতি অনুসৃত। ভাষায় যা বলা হয়নি- বিধবা মেয়েটির নিঃসঙ্গ পরিবেশ, দুঃখময় জীবন ও নতুন যে-পরিস্থিতির মধ্যে সে প্রবেশ করে- বিধবার প্রেম, বিবাহ, নিষিদ্ধ জানার পরও সে ডাক্তারের প্রেমে আচ্ছন্ন হয়েছে। ব্যক্তি হিসেবে সে অধিকার তার রয়েছে কিন্তু শশীশেখরের জীবনে প্রবেশের সামাজিক অধিকার বা ছাড়পত্র তার নেই। ফলে সে নিজেই তার ট্রাজিক পরিণতির স্রষ্টা সমাজ সহায়ক শক্তি। কারণ সমাজ ও সামাজিক বিধিনিষেধ তাকে ঐ অবস্থায় পৌঁছে দেয়ার জন্য দায়ী অতএব গল্পটি সামাজিক ট্রাজেডির অন্তর্গত। তাই বাইরের জগতের প্রতি এর ভাষার কোনো আগ্রহ নেই। মনের কথার ভাষা, তাই এর অবস্থান অন্তরে অন্তরে চোখ মেলে অন্তর দিয়েই মেয়েটির নিরুপায় অস্তিত্বের দহনকে অনুভব করতে হয়।
এই গল্পে নায়িকার আত্মা শ্রোতাকে জিজ্ঞেস করেছে, “মনে করো এইখানেই গল্পটা যদি শেষ হয় তাহা হইলে কেমন হয়।” গল্পরসের পরিপূর্ণতা আসে না তাতে। মেটে না, সাহিত্যের, সাহিত্যিকের সামাজিক দায়। সেই কথাটিই রবীন্দ্রনাথ মৃত নারীর জবানীতে বলেছেন। গল্পে উত্তমপুরুষ প্রথম বক্তা যখন ঐ প্রশ্নের উত্তরে বলেছে- “ মন্দ হয় না। একটু অসম্পূর্ণ থাকে বটে , কিন্তু সেইটুকু আপন মনে পূরণ করিয়া লইতে বাকি রাতটুকু বেশ কাটিয়া যায়।” মূল গল্পটি তখনও বাকি। মেয়েটির জীবনের অবশিষ্ট কথাই এই গল্প। কঙ্কালের ছায়া-সত্তা সে জন্যেই বলে- “ কিন্তু তাহা হইলে গল্পটা যে বড়ো গম্ভীর হইয়া পড়ে। ইহার উপহাসটুকু থাকে কোথায়। ইহার ভিতরকার কঙ্কালটা তাহার সমস্ত দাঁত-ক’টি মেলিয়া দেখা দেয় নাই।” নারীর জীবনালেখ্যের ভিতর থেকে সমাজের কঙ্কালটি বের করে আনা তখনও বাকী। গল্পকারের উদ্দেশ্য-বীজটি সেখানেই উপ্ত। বালবিধবাদের সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, অর্থনৈতিক নিশ্চয়তার কোনো ব্যবস্থা করে নি সেকালের বিধানদাতা সমাজ। সম্ভ্রম, সম্মানের ব্যক্তিক মর্যাদা নেই যে-সমাজে, নেই অর্থনৈতিক স্বচ্ছল জীবনের নিশ্চয়তা সে-সমাজ বিধান দেয় কোন্ অধিকারে? সমাজসচেতন ব্যক্তির বিবেক এই প্রশ্ন করতেই পারে। নাগরিকের অধিকার যথাযথভাবে রক্ষা না করে সমাজ কখনও বিধান দাতার স্বৈরাচারীনীতি গ্রহণ করতে পারে না। আধুনিক এবং পরবর্তীকালের সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি তা ন্যায্য মনে করে না। অসঙ্গত সাব্যস্ত করে। গল্পের ‘কঙ্কালটা তাহার সমস্ত দাঁত-ক’টি মেলিয়া দেখা’ দিলেই তো আমাদের অনড় সমাজপদ্ধতির অন্তর্গত অন্তঃসার শূন্যতা এবং মানবসৃষ্ট সমাজে মানুষের অমানবিক বিধিবিধানের নরকে কিভাবে মানবতা পুড়ে ভস্মীভূত হচ্ছে তা প্রত্যক্ষ করা সম্ভব। এবং গল্পকার রবীন্দ্রনাথের আলোচ্য ‘কঙ্কাল’ গল্পটি আমাদের স্বকালের সমাজের সর্বস্তরে অসংখ্য ‘কঙ্কাল’ আমাদের কণ্ঠহার হয়ে কিভাবে দৃশ্যমান তা দেখিয়ে দেয়।
গল্পটি পাঠের পর অন্তরচোখে তাকালে দেখবেন আমাদের জীবনের সর্বত্র প্রাণহীন, অস্থিচর্মসার বেশুমার সামাজিক কঙ্কাল - তা নিয়েই জীবন ও যাপনে মানুষ দিশেহারা। প্রেমহীন সম্পর্কের কঙ্কাল নিয়ে কৃক্রিম এক দাম্পত্য জীবন বয়ে চলেছি আমরা। হত্যা করছি সেই নারী কিংবা পুরুষকে যার জন্য একদিন অস্তিত্ব বিসর্জন দেয়াও ছিল অতি সাধারণ বিষয়। এই কঙ্কাল সমাজের প্রেমিক-প্রেমিকা, স্বামী-স্ত্রী, পিতা-মাতা, সন্তানের গলায় ঝুলে আছে। আমরা কেউ স্ত্রীকে হত্যা করছি, কেউ একই ছাদের নীচে প্রেমহীন এক অস্বাভাবিক আত্মপ্রতারণার আশ্রয়ে শূন্যতায় ঝুলে বেঁচে আছি। কুসংস্কার কঙ্কালের স্তূপ আমাদের ব্যবহারিক জীবনের প্রতিটি আচরণে ‘দাঁত-ক’টি মেলিয়া দেখা’ দিলেও আমরা তা সরাবার তাগিদ বোধকরছি না। ফতোয়াবাজি কঙ্কাল জীবনের অমিত সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করছে; প্রথার, শাস্ত্রের কঙ্কাল জীবনের পথকে কণ্টকাকীর্ণ করে তুলেছে। নীতিহীন রাজনীতির কঙ্কাল গলায় সুবেশ সমাজ-রাষ্ট্র সেবকের নখরে ছিন্নভিন্ন জাতীয় জীবনের সম্ভাবনাময় অগ্রগতির বাড়ন্ত লতা। গণতন্ত্রের হাড়হাড্ডির মালা জপে বড় ক্লান্ত আমরা। সমাজপদ্ধতিরূপ পাঁচ হাজার বছরের ক্ষয়িষ্ণু কঙ্কাল কোলে নিয়ে পরম মমতায় তাকে আঁকড়ে ধরে আমরা বাাঁচার কসরৎ করছি ক্রমবিবর্তনশীল বিজ্ঞান ভিত্তিক মস্তিষ্ক শক্তির উপর নির্ভরশীল রোবটিক সময়-বৃত্তে। আর এই সমাজেরই উনিশ শতকীয়রূপ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের দেখিয়েছেন ‘কঙ্কাল’ গল্পের ক্যানভাসে। গল্প কঙ্কাল, যেনো অস্থিচর্মসার বাঙালি সমাজের আর একরূপ।
এইচআর/এমএস