‘করোনাভাইরাস মহামারি’ আগেও এসেছিল!
মানুষ বেঁচে থাকলে বদলায়! কোভিড-নাইন্টিন ভাইরাসের আক্রমণ হজম করে বেঁচে যাওয়া মানুষও বদলে যাচ্ছে! কীভাবে? মৃত্যুঞ্জয়ী এই মানুষদের কোষে ভাইরাস কি কোনো ছাপ রাখছে না? রাখছে। অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে করোনাজয়ী মানুষদের শরীরে, যা করোনাপূর্ববর্তী মানুষের শরীরে ছিল না। এই মহামারি মানুষের মাঝে পরিবর্তন ঘটাচ্ছে, এ কথা কি বলা যায় না? মহামারি সামলে ওঠা মানুষ ভিন্নতর মানুষ হয়ে উঠছে।
আজ থেকে ২৫ হাজার বছর আগে পূর্ব এশিয়ার মানুষের এরকম পরিবর্তন ঘটেছিল। তখনো এক মহামারি এসেছিল। যারা বেঁচে ছিলেন, তাদের কোষে ছাপ রেখেছিল সেকালে মহামারি ঘটানো ভাইরাস। সেই ভাইরাস কোভিড-নাইন্টিন ভাইরাস হতে পারে, আবার করোনাভাইরাসের কোনো এক জ্ঞাতী গোষ্ঠীও হতে পারে। বিজ্ঞানী মহলে এখনকার জোর আলোচনা কিন্তু এ-ই। ‘করোনাভাইরাস’ মহামারি অন্ততঃ আরও একবার এসেছিল পৃথিবীতে। কমপক্ষে ২৫ হাজার বছর আগে পূর্ব এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল সেই মহামারি। অনেকে মারা পড়লেও বেঁচে থাকা মানুষগুলোর কোষে রয়ে গেল ভাইরাসের ঘটিয়ে দেওয়া পরিবর্তন। কল্পবিজ্ঞানের পালে হাওয়া লাগিয়ে প্রশ্ন করা যায়, ২৫ হাজার বছর পর আবার মহামারি ছড়াতে জেগে ওঠেনি তো মানুষের কোষে সুপ্ত থাকা সেই ভাইরাসের ‘বংশধর’?
বিজ্ঞানীদের নতুন গবেষণায় জানা গেছে, ছবিতে দেখা মুখে মাস্ক পরা এই জাপানিদের মতো পূর্ব এশিয়ার অধিবাসীরা ২৫ হাজার বছর আগেকার করোনাভাইরাস মহামারির আঘাত তাদের জিনগত বৈশিষ্ট্য এখনো ধারণ করে চলেছেন ২০২১ সালের ৮ই এপ্রিল তারিখে অনুষ্ঠিত হয়েছিল আমেরিকার শারীরিক নৃবিজ্ঞানীদের এসোসিয়েশনের ভার্চুয়াল বার্ষিক সভা। আরিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বিবর্তনীয় জিনতত্ত্ববিদ ডেভিড এনার্ড সেই সভায় জানালেন, পূর্ব এশিয়ার কোনো কোনো মানুষের জিনগত বিবর্তনে নাক গলিয়েছে করোনাভাইরাস কিংবা এর নিকট আত্মীয় কোনো ভাইরাস। ৫ উপমহাদেশের ২৬ প্রকারের নৃতাত্তি¡ক জাতের প্রায় আড়াই হাজার মানুষের ডিএনএ বিশ্লেষণ করে ডেভিড এনার্ড এরকম সম্ভাবনা টের পেয়েছেন। তিনি বলছেন, এবারের করোনাভাইরাস মহামারী সারা পৃথিবীর মানুষের কোষের বৈশিষ্ট্যে বেশ কিছু পরিবর্তন আনছে। এইসব পরিবর্তনের জের মানুষকে নাকি সামনের ২০ হাজার বছর ধরে টেনে নিতে হবে।
প্রাচীন কালে ঘটে যাওয়া ভাইরাসঘটিত মহামারি কীভাবে মানুষের কোষে পরিবর্তন ঘটাতে পেরেছিল, সেই গবেষণার পালে হাওয়া লেগে গেছে এরপর। এর ফলে মানুষ হয়তো জানতে পারবে, আধুনিকতম সময়ে কোভিডনাইন্টিন ভাইরাসসৃষ্ট মহামারীর মতো রোগবালাইয়ে মানুষ তার নিজের কোষের বৈশিষ্ট্যকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে লড়তে পারবে কি না। ভাইরাস ঠেকাতে আরও বেশি সক্ষম ঔষুধ আবিষ্কার করা সম্ভব হবে হয়তো।
২৬ প্রকারের নৃতাত্ত্বিত জাতের মানুষদের মাঝে চিনের দাই, ভিয়েতনামের কিন এবং আফ্রিকার জোরুবা গোত্রের মানুষদেরও ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন ডেভিড এনার্ড বাহিনী। করোনাভাইরাসসমূহের সাথে মিথষ্ক্রিয়া ঘটাতে পারে, এমন চেনা ৪২০টি প্রোটিনের উপর নজর দিলেন প্রথমে। এর সাথে রেখেছিলেন ৩৩২টি প্রোটিন, যারা সার্স-কোভ-২ নামের সেই ভাইরাসটির সাথে মিথষ্ক্রিয়া ঘটাতে পারে, যে ভাইরাস কোভিড-নাইন্টিন ঘটিয়ে অঘটন ঘটিয়েছে। এইসব মি মিথষ্ক্রিয়ার ফলে আসলে কি ঘটে? কেবলমাত্র রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে রসদ জোগায়, তা কিন্তু নয়। ভাইরাস যে আমার শরীরের কোষকে হাইজ্যাক করা শিখে গেল, সে কি এমনি এমনি?
৪২০ টি প্রোটিনের সব ক’টির বাড়াবাড়ি রকমের উৎপাদন ঘটেছে কেবল মাত্র পূর্ব এশিয়ার মানুষের ডিএনএ নমুনায়। এ নাকি সেই প্রাচীন করোনাভাইরাসসম ভাইরাসের ঘটানো মহামারির প্রভাবে ঘটেছে। সেই প্রাচীন মহামারি পূর্ব এশিয়াতে ঘটেছিল। তবে সময়টা ২৫ হাজার বছর আগেকার, তা ডেভিড এনার্ড কীভাবে বুঝলেন? এই প্রোটিনগুলোর ৪২টি ভাইরাসের সাথে কী রকমের প্রতিক্রিয়া দেখায়, তা যাচাই করতে গিয়ে টের পেলেন, ২৫ হাজার বছর আগে ভাইরাসের সাথে প্রোটিনের প্রতিক্রিয়া এরকমই ছিল।
পূর্ব এশিয়ার মানুষের কারোর কারোর কোষের বিশ্লেষনে ঐসব প্রোটিন তৈরির প্রমাণ পাওয়া গেল। ২৫ হাজার বছর আগে এইসব প্রোটিন উৎপাদন হ’ত হর হামেশাই। দিনে দিনে উৎপাদনের হার কমেছে। মাত্র ৫ হাজার বছর আগে এই উৎপাদনের মাত্রা চোখে না পড়ার পর্যায়ে পৌঁছাতে পেরেছিল। অর্থাৎ কোষের এই প্যাটার্ন পেতে ভাইরাসের সাথে বাড়াবাড়ি মাত্রায় মিথষ্ক্রিয়া ঘটানোর অভ্যেস পাল্টাতে হয়েছে, আর এই অভ্যেস পাল্টাতে লেগেছে ২৫ হাজার কম ৫ হাজার অর্থাৎ ২০ হাজার বছর। ডেভিড এডার্ন এই সরল অংক কষে রায় দিয়েছেন, ২০ হাজার বছর পরে এসে বলা গেছে, পূর্ব এশিয়ার মানুষরা ভাইরাসটির সাথে মানিয়ে নিতে শিখলেন। এভাবেও বলা যায়, ভাইরাসটির রোগ ছড়ানোর ক্ষমতা হারাতে ২০ হাজার বছর লেগেছিল।
ভাইরাসের ৪২টি জিন ভিন্নতার ভেতর ২১টিতে যে রকমের অদল বদল ঘটল, তাতে ভাইরাসের আত্মীয়ের সংখ্যা গেল বেড়ে। ডেভিড এনার্ড বলেছেন, যে করোনাভাইরাসে আমরা কাবু হচ্ছি, ২৫ হাজার বছর আগেকার ভাইরাসটি এই একই করোনাভাইরাস ছিল অথবা এর আত্মীয় গোত্রের ভাইরাস, যে কিনা একই রকমের প্রোটিনের সাথে মিথস্ক্রিয়া ঘটাতে সক্ষম। মিথষ্ক্রিয়ার শক্তিতে ২৫ হাজার বছর আগেও মহামারি ঘটিয়েছিল বিধায় আত্মীয় বলে ছাড় দেওয়ার উপায় নেই।
প্যারিসের পাস্তুর ইনস্টিটিউটের বিবর্তনীয় জিনতত্ত্ববিদ লুই কুয়াতানা-ম্যুহ্সি ডেভিড এনার্ড বাহিনীর প্রাপ্ত তথ্যের যাচাই বাছাই করে বলেছেন, পূর্ব এশিয়ার কিছু মানুষ ২৫ হাজার বছর আগে করোনাভাইরাসের মতো মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে এরকম ভাইরাসের আক্রমনে টিকে থাকাটা রপ্ত করে ফেলেছিলেন। এ কারণেই কি ইউরোপ-আমেরিকার চেয়ে এশিয়াতে, বলা ভালো পূর্ব এশিয়াতে কোভিড-নাইন্টিন ভাইরাসের সংক্রমণ আর মৃত্যুর হার তুলনামূলকভাবে কম?
লুই কুয়াতানা-ম্যুহ্সি কিন্তু এরকম ধারণাই পোষণ করছেন। যদিও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হার নির্ভর করেছে স্বাস্থ্য সেবার অপ্রতুলতা, সামাজিক সুরক্ষাবলয়ের দুর্বলতা ইত্যাদি নানা উপাদানের উপর। যে সব দেশ অতি দ্রুত লকডাউন দিতে পেরেছে, মাস্ক পরতে জনগণকে খুব ভালোভাবে সচেতন করতে পেরেছে, তারা ভালো অবস্থায় আছে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়ার মতো পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো তো বটেই, কেরানাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছিল যে চীন থেকে, সেখানেও মৃত্যুর হার অনেক কম। অথচ উন্নত স্বাস্থ্য সেবার দেশ বলে এতকাল গর্ব বোধ করা আমেরিকা, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, স্পেন, বেলজিয়ামের অবস্থা শোচনীয়।
বিজ্ঞানী ডেভিড এনার্ড চিন্তিত। কেননা, ভাইরাসের ৪২টি জিন ভিন্নতা হয়তো বা কোভিড-নাইন্টিন অথবা এরকম করোনাভাইরাসের সংক্রমন ছড়াতে সাহায্য করলেও এগুলোর মাত্র ৪টিকে বর্তমানে চালু ১১টি ঔষুধের ক্ষেত্রে বিবেচনায় আনা হয়েছে। বাকিগুলোর কথা ভাবা উচিত। মহামারি ঠেকাতে যে টিকাগুলো বাজারে এসেছে, সেগুলোকে কোভিড-নাইন্টিনের হরেক রকমের মিউটেশনের সাথে পাল্লা দিতে হচ্ছে। ভবিষ্যতে হয়তো আরও হবে। কতদিনে এই মহামারিকে বাগে আনা যাবে, তার কোনো নিশ্চয়তা তো বিজ্ঞানীরা এখনো দিতে পারেননি।
২৫ হাজার বছর আগেকার সেই মহামারি কত বছরে কাবু হয়েছিল, তার তথ্য এখনো জানা যায়নি। আদৌ কি কাবু হয়েছিল? না কি ঘুমিয়ে ছিল ভবিষ্যতের মানুষ, এই আমাদেরকেই কাবু করার জন্য? কল্পবিজ্ঞানের পালে হাওয়া লাগিয়ে প্রশ্নটা আবারও করছি। ২৫ হাজার বছর পর মহামারি ছড়াতে আবারো জেগে ওঠেনি তো মানুষের কোষে সুপ্ত থাকা প্রাচীন ভাইরাসের ‘বংশধর’?
এইচআর/জিকেএস