ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

করোনায় দিক হারা শিক্ষা খাত

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা | প্রকাশিত: ০৯:৪০ এএম, ০১ মে ২০২১

অতিমারির সব ক্ষতি আর্থিক নয়। কিছু ক্ষতি তার চেয়েও বেশি। করোনা মহামারিতে প্রায় ১৪ মাস ধরে কওমি মাদ্রাসা ছাড়া সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। বন্ধ আছে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা। থমকে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম। তবে শিক্ষাকার্যক্রম চালিয়ে নিতে অনলাইনে ও দূরশিক্ষণ পদ্ধতির পাঠদান চলছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে।। স্কুল-কলেজে অভ্যন্তরীণ কিছু পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে অনলাইনে। কিন্তু তাতে বলা যাচ্ছে না যে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। অনিশ্চয়তা বাড়ছে। দফায় দফায় পিছিয়ে যাচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার তারিখ। সবমিলে পৌনে ৪ কোটি ছাত্রছাত্রীর শিক্ষাজীবন এখন বিপর্যস্ত।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক থেকে শিক্ষার্থী, সবার জন্যই বড় চাপ এখন এই বন্ধ সময়। করোনার সাথে যুদ্ধ, তার সাথে সিলেবাস বনাম সময়ের যুদ্ধ। সময় নষ্ট না করতে, নতুন পথে ভাবতে হচ্ছে শিক্ষক-ছাত্র সবাইকেই। এই পরিস্থিতিতে একমাত্র রাস্তা সিলেবাস কমাও, পুরোদস্তুর অনলাইনে যাও। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষকশিক্ষিকা বা ছাত্রছাত্রীদের জন্য এই অনলাইন শিক্ষা পদ্ধতি কি দীর্ঘমেয়াদি সুফল বয়ে আনবে? এবং সবার পক্ষে কি অনলাইনে শিক্ষা সম্ভব? নাকি আমরা শিক্ষা ক্ষেত্রে আরও বড় করছি ধনী ও গরিব বিভাজন, শহর ও গ্রাম বিভাজন বা ডিজিটাল বিভাজন? কারণ অনলাইনের সুযোগ সবাই পাচ্ছে না বড় একটি অংশ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জানিয়ে দিয়েছে, ১৭ মে তার আবাসিক হল খুলছে না। এবং নিশ্চয়ই এ্ পথ ধরবে বাকিরাও। স্কুল বা কলেজ কবে খুলবে বা আদৌ খুলবে কিনা, সেটা পরিষ্কার করছে না শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা বেতন পাচ্ছেন, বোনাস পাচ্ছেন। বেসরকারি পর্যায়ে পরিচালিত স্কুলের শিক্ষক ও উদ্যোক্তারা বলতে হবে এখন মৃত প্রায়। ধনিক শ্রেণির ইংলিশ মিডিয়াম আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের কার্যক্রম – পুরোটাই চলছে অনলাইনে। নানা উদ্ভাবনী পদ্ধতিতে তাদের চেষ্টা আছে সময় নষ্ট না করার।

পুরো চিত্রটা যে সমস্যা সামনে আনল তা হল— ডিজিটাল সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সুযোগসুবিধার বৈষম্য। গত বছর ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের পর ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। এ বছর ৩০ মার্চ খুলে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ছুটি ২২ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। শিক্ষার বিভিন্ন স্তরের জন্য অনলাইনে ও দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে বিকল্প পাঠদান পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়েছে। কিন্তু অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে সব শিক্ষার্থীর কাছে তা পৌঁছাচ্ছে না। গণসাক্ষরতা অভিযানের (ক্যাম্পে) গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত সমীক্ষা বলছে, প্রায় ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী দূরশিক্ষণে অংশ নিয়েছে। ব্র্যাকের সমীক্ষা মতে, টেলিভিশন পাঠদানে ৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছে। অর্থাৎ অন্তত অর্ধেক শিক্ষার্থীই দূরশিক্ষণ কার্যক্রমের বাইরে। যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, ৯২ শতাংশ শিক্ষার্থী দূরশিক্ষণের অধীনে এসেছে। আর স্কুল শিক্ষকদের মাধ্যমে অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে ৮৫ শতাংশকে লেখাপড়ার মধ্যে নিয়ে আসা হয়েছে। সরকার ভাবছে হয়তো লকডাউন উঠে যাওয়ার পরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুললেও ক্যাম্পাসে কি যথাযথ ভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করা যাবে?

করোনায় শিক্ষার ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি এবং অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকরাও নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছেন। তাই সার্বিক শিক্ষা পুনরুদ্ধারে সুচিন্তিত পরিকল্পনা নিতে হবে জরুরি ভিত্তিতে। আমরা বুঝতে পারছি করোনা দীর্ঘকালীন ভাবে জীবনযাত্রার সঙ্গী হয়ে পড়বে। সে ক্ষেত্রে আর বন্ধ করে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। একবারও কি ভাবছি যে, শিক্ষা ও জ্ঞানের প্রসার স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে? আসলে এই নতুন জটিলতার সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে শিক্ষাদানের নতুন পদ্ধতি খুঁজে নেওয়াই হবে এর সমাধানের পথ।
ভয়ংকর ক্ষতি হয়েছে এবং হচ্ছে। করোনায় শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া, শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ এবং শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার বাড়ছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। যখন স্কুল তথা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এক সময় খুলবে তখন অনেক শিক্ষার্থী আর স্কুলে নাও ফিরতে পারে। দীর্ঘ শিখন বিরতির কারণে একটি অংশ পাঠ না পারা ও বোঝার পরিস্থিতিতে পড়বে আর আরেকটি অংশ সম্ভাব্য দারিদ্র্যের কশাঘাতে নিপতিত হয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে কাজে ভিড়ে যাবে। ঝরে পড়া এসব শিক্ষার্থীর মেয়ে শিশুদের বিয়ে হয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে মাধ্যমিকে ঝরেপড়াদের ক্ষেত্রে এটা বেশি ঘটতে পারে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও অনেক শিক্ষার্থী আর ক্যাম্পাসে নাও ফিরতে পারে।

তাই শিক্ষা পুনরুদ্ধারের যে কথা বলা হচ্ছে সেটা আর উদ্ধার করা সম্ভব নাও হতে পারে। এখন এই ধকল কাটিয়ে উঠতে অন্য দেশের অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে নিজস্ব প্রয়োজন ও বাস্তবতার নিরিখে উপযুক্ত পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়ন করাই উত্তম বলে মনে করছেন অনেকে। যদি একসঙ্গে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা না যায়, তাহলে যেখানে যখন পরিস্থিতি উন্নতি হবে, সেখানে আগে খুলে দেওয়া যেতে পারে। এটাই বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পর্যায়ে দ্রুত ১৮ বছরের বেশি সবার টিকাকরণ নিশ্চিত করে প্রতিষ্ঠান খোলার কোন বিকল্প নেই।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।

এইচআর/এমএস