ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

লকডাউনে আইনজীবীদের দুঃখ-বেদনা

আনিস আলমগীর | প্রকাশিত: ০৯:৩৭ এএম, ৩০ এপ্রিল ২০২১

একজন আইনজীবী ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন- ‘বিশ্বাস করবেন, লকডাউনের ১ম দিন মাত্র দুই হাজার টাকা নিয়ে বাসায় এসেছি। আমার সহধর্মিণী তার স্বর্ণ বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু আমি ধৈর্য ধরেছি। এমনকি কোনো বন্ধু, সিনিয়র বা আত্মীয়কে পর্যন্ত বলিনি। মাঝে দুই একটা কাজে ৫/৭ হাজার টাকা পেয়েছি তাতেও অপ্রতুল। সবশেষে, একজন শুভাকাঙ্খী হাজার পঞ্চাশেক টাকা কর্যে হাসনা দিয়েছে। শুধু বলেছি, আর্থিকভাবে কিছুটা সংকটে পড়ার আশঙ্কা করছি। বাকিটা আল্লাহ ভরসা।’

করোনাকালে, লকডাউন বা তালাবন্দির মধ্যে আমরা অনেক পেশার লোকদের অসহায় অবস্থা সম্পর্কে লিখছি কিন্তু আইনজীবীদের সম্পর্কে কিছুই বলছি না। আমি গত ২৮ এপ্রিল বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের একটি বিবৃতিতে দেখলাম স্বাস্থ্যবিধি মেনে সব আদালত খুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা। সেইসঙ্গে যারা দুস্থ আছেন তাদের জন্য সহায়তা চেয়েছেন। তাদের দাবি বর্তমানে দেশে প্রায় ৫২ হাজার আইনজীবী রয়েছেন তাদের মধ্যে ৩০ হাজার আইনজীবী শুধু আইনপেশার ওপর নির্ভর করে চলেন।

আরেকজন আইনজীবী তাদের গ্রুপে স্ট্যাটাস দিয়ে বলেছেন, বিজিএমইএ গার্মেন্টস খোলা থাকার পরও সরকারের কাছে ৫-৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ চেয়েছে গার্মেন্টস কর্মীদের বেতন বোনাস দেয়ার জন্য। বার কাউন্সিল কি পারে না আইনজীবীদের জন্য সরকারের কাছ থেকে ঋণ/ অনুদান নিয়ে সাধারণ আইনজীবীদের পাশে দাঁড়াতে? সাংবাদিক সমিতিও ১০ কোটি আদায় করে নিয়েছে আর আমরা..।”

অবশ্য আরেকজন আইনজীবী এই সহযোগিতার পরিবর্তে আদালত খোলার পক্ষে। তিনি লিখেছেন, লকডাউন অজুহাতে নিয়মিত আদালত বন্ধ না রেখে, আইনজীবী এবং জনগণের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির জন্য নিয়মিত আদালত চালু করার জোর দাবি জানাই। আমরা আইনজীবীরা সরকারি প্রণোদনা, ভিক্ষা সাহায্য সহযোগিতা চাই না। আমরা চাই- ভার্চুয়াল নয় ‘একচুয়াল আদালত’। আর নয়তো, তথাকথিত লকডাউনে আদালত পাড়ায় শপিংমল ও কাঁচাবাজার খুলে দিয়ে আইনজীবীদের জন্য আয়ের ব্যবস্থা করে দেয়া হোক।’

একজন আইনজীবী ভার্চুয়াল আদালত নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছেন। লিখেছেন, ‘করোনার ঢেউ সাঁতরিয়ে আদালতে এসে জামিনের দরখাস্ত জমা দিয়ে ভার্চুয়ালি শুনানি করে জামিন লাভের পর সিউরিটি ফিট এর নামে অফিসে ধর্না দিয়ে নগদ টাকা দিয়ে (আবার অনেক সময় দস্তখতকারী কর্মকর্তাকে স্পিড মানি দিয়ে) সিউরিটি ফিট করার কি আদৌ দরকার আছে? অন্তত এই সংকটকালীন কি ওই ব্যবস্থা বন্ধ রাখা যায় না? বার কি এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নিতে পারে না?

লকডাইনে ভার্চুয়াল আদালত নিয়ে আমি অবশ্য ভিন্ন কথা বলব। ভার্চুয়াল আদালত হয়তো আমাদের আরও অনেকদিন চালাতে হবে। আদৌ সহসা করোনা যাবে কিনা আমরা সে ভরসা করতে পারি না। সে কারণে বরং ভার্চুয়ালকে আদালত আরও বিস্তৃত করা, আরও বেশি ডিজিটালাইজ করা দরকার। বর্তমানে আমার জানামতে ক্রিমিনাল মামলাগুলো ভার্চুয়াল আদালতে প্রাধান্য পাচ্ছে কিন্তু দেওয়ানি মামলাকেও ভার্চুয়াল আদালতে তোলা দরকার। এই জন্য প্রশিক্ষণ দরকার সংশ্লিষ্ট সবার। ভিডিও কনফারেন্স করেও আদালত খোলা রাখা যায় কিনা ভাবা দরকার।

ডিজিটাল করার বিষয়টা মসৃণ করতে হবে। একটা জিডি ডিজিটাল করা, আরও নথিপত্র ডিজিটাল করা, অনলাইনে ট্রোজারি চালান দেয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। রেকর্ডনামাগুলো ডিজিটাল না। এক আদালত থেকে আরেক আদালতে যেতে মামালার নথিপত্রের কপি দরকার হয়। এগুলো যদি জিডিটালি সংরক্ষিত থাকে না। খুঁজতে সময় লাগে। আরও অনেক খুঁটিনাটি বিষয় রয়েছে যা আদালত এবং আইনজীবীরা ভালো বলতে পারবেন। বসে সিদ্ধান্ত নেবেন। আমার মনে হয়ে ভার্চুয়াল আদালতের ক্ষেত্র যদি বাড়ানো যায় এবং দ্রুত ডিজিটালাইজ করার দিকে নজর দেয়া যায়, তাহলে জনগণের জন্য সবচেয়ে কল্যাণের কাজ হবে।

দেওয়ানি মানে জায়গা-জমির সংক্রান্ত মামলার জন্য আদালত খোলা রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘদিন আদালত বন্ধ থাকায় প্রভাবশালীরা মওকা পেয়ে গেছে। তাদের দখলকৃত সরকারের বা বেসরকারি কোনো জমির দখলদারিত্ব আরও দীর্ঘ হচ্ছে। জমি নিয়ে বিরোধ টিকে থাকছে। অনেক সময় জমির ভুয়া দাবিদার প্রভাবশালীদের কাছে সেই জমি বিক্রি করলে তারা দখল নিয়ে রাখে। তাতে করে সুবিধাটা দখলধারী পাচ্ছে। আবার থানা-পুলিশ পক্ষে আনতে পারলে তো আরও সুবিধা। শেষ পর্যন্ত প্রকৃত মালিককে জমি ছেড়ে দিয়ে আসতে হয়, না হয় আপস করতে হয়।

জেলা প্রশাসকরা অনেক সরকারি জমি আত্মসাতের বিরুদ্ধে লড়ছেন। মামলার কার্যক্রম স্থবির থাকলে দখলদার সেখানে অস্থায়ী থেকে স্থায়ী কাঠামোর দিকে চলে যাবে। এখন দেখবেন হাইওয়ের পাশে অনেক অস্থায়ী কাঠামো গড়ে উঠেছে। ভুমি অফিসে যদি টাকা পয়সা দিয়ে দলিলে কাটাকুটি করে সন্দেহ ঢুকিয়ে দেয়া যায় তাহলে বছরের পর বছর ভোগ করতে পারে তারা।

পরিশেষে আমি আইন পেশার নতুন প্রজন্ম নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। আমি অনেকের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি বার কাউন্সিল আইনজবীবী সনদ দেয়ার যে পরীক্ষা নিচ্ছে সেটা তাদের পাশ করা মুশকিল হচ্ছে, অনেক সময় মেধা থাকা সত্ত্বেও পরীক্ষার মধ্যে ‘ভূত’ ঢুকে যাওয়ায় অনেকে বার বার পরীক্ষা দিয়েও ফেল করছেন। কিছুদিন আগে আইনজীবী নিয়োগের যে পরীক্ষা হয়েছে এখনো তার রেজাল্ট হয়নি। অনেক তরুণ বারবার পরীক্ষা দিচ্ছে কিন্তু পাস না করে তারা হতাশ।

তারা বলছে বিসিএস পরীক্ষা থেকে এই সনদ প্রাপ্তিটা কঠিন করা হয়েছে। প্রথমেই প্রিলিমিনারি পরীক্ষা দিতে হয়, তারপর লিখিত পরীক্ষা, মৌখিক পরীক্ষা দিতে হয়। অথচ তাদের পূর্বসুরিরা একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত জেলা জজের হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে নতুন আইনজীবী হিসেবে এনরোলমেন্ট পেতেন। পেশাটি এমনিতেই গুরু কেন্দ্রিক প্রফেশন। সেটাকে বিবেচনা করে বার কাউন্সিলের যুগান্তকারী কিছু পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।

সময়মত পরীক্ষা না হওয়ায় জমে গেছে অনেক শিক্ষার্থীর স্বপ্ন। দেশে প্রাইভেট এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় মিলে প্রতিবছর হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বেরচ্ছেন। তাদের মধ্যে আবার বিনা সনদে অনেক সিনিয়রের সঙ্গে কাজ করছেন। তারা সিনিয়রদের কাছ থেকে অল্পস্বল্প আর্থিক সহযোগিতা পেতেন, লকডাইনের কারণে তাও বন্ধ। নতুনরা এই পেশায় এসে নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি করছেন এক্সপেরিমেন্টের মধ্য দিয়ে। পুরোনোরা একই ধাঁচের মামলা নিয়ে আছেন, তারা একটা নির্দিষ্ট ধাঁচের মামলা করেন তারা। নতুনদের কেতন উড়াতে দেন।

সর্বশেষ বলব, দেশের গণতন্ত্র, উন্নয়ন এবং আইনি কাঠামোর জন্য আইনজীবীদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেটি আমরা অনেকে খেয়ালই করি না এবং তাদের নানা বিশেষণে বদনাম করি। সরকারের উচিত এই লকডাউনে তাদের দিকেও নজর দেয়া। এটা ভাবার কারণ নেই যে, মক্কেলের পয়সায় লাল হয়ে আছেন তারা। তাদেরও সংসার চালাতে বেশিরভাগের কষ্ট হচ্ছে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত। [email protected]

এইচআর/এমএস