ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ধর্ম ব্যবসায়ী হেফাজত নেতাদের ছাড় দেওয়া চলবে না

বিভুরঞ্জন সরকার | প্রকাশিত: ০৯:২৫ এএম, ২০ এপ্রিল ২০২১

হেফাজতে ইসলামের বহুল আলোচিত-সমালোচিত নেতা মামুনুল হককে মোহাম্মদপুরের একটি মাদ্রাসা থেকে ১৮ এপ্রিল দুপুরে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গত কয়দিনে ৯ জন কেন্দ্রীয় নেতাসহ ৪৬৯ জন হেফাজত নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আরও ৩৫ জন কেন্দ্রীয় নেতা নজরদারিতে আছেন বলেও জানা গেছে। দেশের গণতান্ত্রিক-অসাম্প্রদায়িক-প্রগতিশীল মহল থেকে সহিংসতার সঙ্গে জড়িত মামুনুল হকসহ হেফাজতের অন্য নেতাদের আইনের আওতায় আনার দাবি বেশ কিছুদিন ধরেই করা হচ্ছে। হেফাজতে ইসলামের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা হিসেবে মামুনুল হক নানা উপলক্ষে তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উস্কানি ও বিদ্বেষমূলক বক্তৃতা দেশের মধ্যে বিভেদ ও অস্থিরতা তৈরির পাঁয়তারা করছেন। ঢাকার এক সমাবেশে তিনি এবং হেফাজতের অন্য শীর্ষ নেতারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভেঙে চুরমার করার প্রকাশ্য ঘোষণা দেওয়ার পর দেশের কয়েকটি স্থানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ভাস্কর্য ভাঙচুর হয়েছে। সরকার তখনই এই সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিলে অন্তত কয়েকটি অঘটন থেকে দেশ রক্ষা পেতো।

হেফাজত যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী একটি শক্তি, তারা যে দেশে অসাম্প্রায়িক ধারায় বিশ্বাসী নয়, তারা যে ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে বাঙালির শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির উদার চিরায়ত ঐতিহ্যকে ধ্বংস করতে চায়– তার প্রমাণ তারা আগে একাধিকবার দিয়েছে। নারী নীতির বিরোধিতা থেকে শুরু করে ২০১৩ সালের মে মাসে রাজধানীর শাপলা চত্বরে জমায়েত হয়ে যে সহিংসতা তারা চালিয়েছিল তা থেকেই বোঝা গিয়েছিল তারা আসলে কি চায়। শাপলা চত্বর থেকে তাদের বিতাড়িত করতে সরকার শক্ত অবস্থান নিলেও পরে হেফাজতের সঙ্গে সরকারের এক ধরনের সমঝোতার অবস্থান দেখা যায়। হেফাজতকে নিরাপদ আশ্রয় দিয়ে সরকারকে ভুল করছে– এই সতর্কতা তখনই বিভিন্ন মহল থেকে উচ্চারিত হয়েছে। সরকার ক্ষমতার রাজনীতিতে ভারসাম্য আনার কৌশলগত কারণে তখন হেফাজতকে তোয়াজ করে তাদের শক্তি বৃদ্ধিতে পরোক্ষ ভূমিকা রেখেছে বলে অনেকেই মনে করেন।

সরকার হেফাজতের প্রতি নমনীয় হলেও হেফাজত সরকারের প্রতি নমনীয় না হয়ে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন এগিয়ে গেছে। এতে ক্ষতি হয়েছে দুটি। এক. দেশের অসাম্প্রদায়িক-প্রগতিকামী দল-সংগঠন-ব্যক্তি সরকারের প্রতি আস্থা হারিয়েছে। পুরনো মিত্রদের সঙ্গে সরকারের সখ্য আলগা হয়েছে। দুই. হেফাজত সূচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরুবার কৌশল বাস্তবায়নে বহুদূর এগিয়েছে বাধাহীনভাবে। সরকার তাদের দাবি মেনে পাঠ্যপুস্তকে এমন কিছু পরিবর্তন এনেছে যা স্থায়ী ক্ষতির কারণ হয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষার সরকারি স্বীকৃতি দিয়ে প্রতিপক্ষ একটি উগ্রগোষ্ঠি তৈরি করা হয়েছে। অধিকাংশ কওমি মাদ্রাসা বাংলাদেশ মানে না, জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান জানায় না। এসব কেবল সন্দেহ বা অনুমান নয়, এর পক্ষে ভূরি ভূরি প্রমাণ থাকলেও সরকার তা আমলে নেওয়ার গরজ বোধ করেনি।

হেফাজতের যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের একজনও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, তার প্রমাণ প্রমাণ দিতে পারবেন না। উল্টো মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী এবং তাদের সন্তানরাই এখন হেফাজতের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তারা নিজেদের প্রথম দিকে অরাজনৈতিক বলে দাবি করলেও তারা যেসব কার্যক্রমে অংশ নেন তা কেনোভাবেই রাজনীতি-নিরপেক্ষ নয়। হেফাজতের ভেতর এখন জামায়াতের মতো দুষ্ট রাজনৈতিক শক্তিরও অনুপ্রবেশ ঘটেছে। পবিত্র ইসলাম ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে হেফাজত প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের লক্ষ্য নিয়েই যে অগ্রসর হচ্ছে, তাতে কোনো অস্পষ্টতা নেই। আওয়ামী লীগ সব সময় বিএনপিকে তাদের বড় শত্রু হিসেবে মনে করে। সে জন্য বিএনপিকে কোণঠাসা করার চেষ্টা আওয়ামী লীগের মধ্যে দেখা যায়। একটি সময় পর্যন্ত বিএনপিই হয়তো আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল। কিন্তু গত কয় বছরে হিসাব বদলে গেছে। দুনিয়াব্যাপী জঙ্গিবাদ তথা উগ্র ইসলামি চিন্তাভাবনা প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে প্রায় সব দেশেই মানুষের রাজনৈতিক ভাবনা জগতেও এক বিস্ময়কর পরিবর্তন ঘটেছে। প্রগতির ধারা দুর্বল হয়ে রক্ষণশীল বা প্রতিক্রিয়ার ধারা বলবান হয়ে উঠছে।

আমাদের প্রতিবেশি দেশ ভারত ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করলেও গত কয়েক বছরে সেখানে হিন্দুত্ববাদী শক্তি রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলে নেওয়ার অবস্থায় পৌঁছেছে। ধর্ম নিয়ে মানুষের মধ্যে এমন এক অনুভূতি কাজ করে যা সব সময় যুক্তিবুদ্ধি অনুসরণ করে না। মানুষের মনোজগৎ এক দুর্বোধ্য জায়গা। কি থেকে যে সেখানে কি হয় তা বুঝি এখনও বিজ্ঞানের দখলে আসেনি। হায়াতমওত আল্লাহ বা ঈশ্বরের হাতে – এটা যিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করেন, তিনি অসুখবিসুখে ডাক্তার কবিরাজের কাছে ধরনা দিতে ভুল করেন না। ফলে আমরা যে যাই বলি না কেন, ধর্মকে আর রাজনীতির বাইরে রাখা যাচ্ছে না। এতে বিপদ বাড়ছে। তবে এর থেকে বেরিয়ে আসার সহজ পথ খুঁজে পাওয়া বুঝি এখন দুরূহ।

আওয়ামী লীগ কৌশলের খেলা খেলে এক ধরনের সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও এখন দিন দিন অবস্থা কঠিন হয়ে আসছে। বিএনপি দুর্বল হয়ে হেফাজতের মতো ধর্মাশ্রয়ী সংগঠনের শক্তিবৃদ্ধি আশঙ্কার বিষয়। কেউ হয়তো একমত হবেন না, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, বিপদ বিএনপির দিক থেকে নয়, বিপদ আসবে হেফাজত বা তার সমমনা শক্তির দিক থেকেই। হেফাজতের যে দর্শন তা এখন অন্য অনেকের মধ্যেই প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে ছড়িয়ে পড়েছে বা পড়ছে। হেফাজত এখন সরকারে আছে, প্রশাসনে আছে, আওয়ামী লীগে আছে, বামে আছে, ডাইনে তো আছেই।

মামুনুল হক এবং তার মতো আরও যারা ধর্মীয় নেতা বলে যারা আজকাল পরিচিতি পাচ্ছেন, তাদের অনেকেই এমন সব উদ্ভট কথাবার্তা বলে থাকেন, যা কোনোভাবেই কোনো সভ্য সমাজে বলা যায় না। ভাগ্যের পরিহাস এই যে, ধর্মের লেবাসে এ ধরনের উদ্ভট কথা তারা বলেন বলে কেউ সরাসরি তাদের চ্যালেঞ্জ করে না। চ্যালেঞ্জ করার মতো সাহস তো আজকাল কমে গেছে। আরো দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে, এই প্রজন্মের একটা বড় অংশ কোন ধরনের যুক্তি তর্কের মধ্যে না গিয়ে মামুনুল হকদের পরকাল নিয়ে ব্যবসার মোহে আকৃষ্ট হচ্ছেন।

যে জাতি ইসলামী লেবাসে থাকা অস্বাভাবিক একটি রাষ্ট্র থেকে বেরিয়ে এসে অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ে তুলেছিল ১৯৭১ সালে, সে জাতি 'বীরত্বের সঙ্গে' কদম এরপর কদম পিছু হটছে। এবং এই পিছু হটা এমন গতিতে চলছে যে, সত্যিকারের অসাম্প্রদায়িক মানুষের পক্ষে টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়ছে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, সাংস্কৃতিক জীবন ইতিমধ্যেই সংকুচিত হয়ে এসেছে। গ্রামীণ উৎসবগুলোর অবস্থা ম্রিয়মাণ। শিল্প ও সংস্কৃতির সাধনা ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে একশ্রেণির ধর্মব্যবসায়ীর ওয়াজ মাহফিলের রমরমা এনেছে সমাজে।

মামুনুল হকের নারী কেলেঙ্কারির কথা জেনেও তাকে প্রশ্রয় ও সমর্থন দেওয়ার মধ্য দিয়ে হেফাজত এটা সংগঠনগতভাবেই পরিষ্কার করেছে যে তারা প্রচলিত নীতি নৈতিকতার ধার ধারে না। যেসব অপরাধের জন্য তারা অন্যদের তিরস্কার করবে, সেসব অপরাধ থেকে তারা নিজেরা দূরে থাকবে না। কিছুটা দেরিতে হলেও সরকার হেফাজতের সংবিধানবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য তাদের শীর্ষ নেতাদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করছে। তবে এটা যদি হয় তাদের সঙ্গে নতুন করে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার কৌশল তাহলে তার ফল বুমেরাং হতে পারে।

সরকারকে যেমন অবস্থানে দৃঢ় থাকতে হবে, তেমনি যারা সমাজে হেফাজতি তাণ্ডব দেখতে চান না তাদেরও এখন সরকারের পাশে দাঁড়াতে হবে। ওয়াজের নামে অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানো, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের উস্কানি দেওয়া, নারীদের নিয়ে অশ্লীল কথাবার্তা বলা, দেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে পারলে মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসবে।

এটা সবারই মনে রাখতে হবে যে, ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিষয়। প্রদর্শনের নয়। ধর্ম এবং ধর্মব্যবসা যে এক নয়, সেটা পরিষ্কারভাবে সাধারণ মানুষকে বোঝাতে হবে। এজন্য সরকারি প্রচার মাধ্যম এবং দেশে সক্রিয় সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হবে । আইনের প্রয়োগে পক্ষপাত মুক্ত হবে। আমার জন্য যেটা অন্যায় বা অপরাধ, আরেকজনের জন্যও তাই হতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাড়াহুড়া না করে ধৈর্য ও সহনশীলতা সঙ্গে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্পন্ন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী ভূমিকা পালনকারী পালের গোদাদের বিচারের আওতায় এনে কয়েকজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছেন। হেফাজতের নেতারা রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করার ঔদ্ধত্য দেখিয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনকালে দেশের কয়েকটি স্থানে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছেন তার উপযুক্ত বিচার করেও তিনি ন্যায়ের পক্ষে তার অবিচল আস্থার প্রমাণ রাখবেন– এটা আমরা বিশ্বাস করতে চাই।

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

এইচআর/জেআইএম

আরও পড়ুন