ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

অমিত শাহকে লাগাম লাগাতে হবে

আনিস আলমগীর | প্রকাশিত: ১১:৫৬ এএম, ১৫ এপ্রিল ২০২১

সম্প্রতি আমি ‘বিজয়া’ নামে একটি ভারতীয় বাংলা সিনেমা দেখেছি। বাংলাদেশি অভিনেত্রী জয়া থাকাতে এবং তিনি এর জন্য পুরস্কার পেয়েছেন শুনে নেটে দেখলাম। অনেক সুন্দর কাহিনী। কলকাতার মানুষদের গরিবি হাল, আর বাংলাদেশি চরিত্রদের মুখে বিরক্তিকর বাংলা বলা বাদ দিলে দেখার মত ছবি।

এ ছবির সবচেয়ে যে জিনিস আমাকে অবাক করেছে তা হচ্ছে স্থল সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশি এক রোগী হুটহাট করে কলকাতা যাওয়া-আসা করতে পারে, অন্যদেরকেও অবৈধভাবে পার করাতে পারে। আর তাকে সহায়তা করে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড? কিভাবে এটা সম্ভব? অমিত শাহরা কি এই ধারণা থেকে বলে বাংলাদেশিরা খাবারের অভাবে ভারতে চলে যায়!

বাংলাদেশ সম্পর্কে অসৌজন্য, অসার কথা বলা ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী নেতাদের শিরোমনি অমিত শাহ আবারও বলেছেন, ‘বাংলাদেশের গরিব মানুষ এখনও খেতে পায় না, তাই ভারতে আসে। বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ বন্ধ করা হবে।’ কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকাকে তিনি এ কথা বলেন। দু’চার দিন পর পর অশিষ্ট, মিথ্যা কথা বলা অমিত শাহের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে এবং পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনকে ঘিরে সেটি মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ তার বক্তব্যের আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ না করলেও আপত্তি জানাচ্ছে বরাবর। অমিত শাহের সর্বশেষ বক্তব্যের প্রতিবাদে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, ‘বাংলাদেশ নিয়ে তার জ্ঞান সীমিত। বরং ক্ষেত্রবিশেষে বাংলাদেশ তাদের দেশ ভারত থেকে অনেক এগিয়ে।’

ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সাবেক সভাপতি অমিত শাহ হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যিনি ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গার সময় গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেদ্র মোদির ডেপুটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন এবং ২০২০ সালের দিল্লি দাঙ্গার সময় প্রধানমন্ত্রী নরেদ্র মোদির মন্ত্রিসভার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। গুজরাটের দাঙ্গায় প্রায় দুই হাজার এবং দিল্লির দাঙ্গায় ৫৩ জন মানুষ মারা গেছে; যে দুই দাঙ্গায় সিংহভাগ নিহতহরা ছিল মুসলমান।

এর আগে গত ১১ ফেব্রুয়ারি অমিত শাহ পশ্চিমবঙ্গের এক জনসভায় বাংলাদেশ থেকে কথিত অনুপ্রবেশের ইস্যু নিয়ে উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ক্ষমতায় এলে সীমান্ত দিয়ে ‘কোনও মানুষ দূরে থাক - একটা পাখিও ঢুকতে পারবে না।’ পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস অবশ্য দাবি করছে তাদের শাসনামলে অনুপ্রবেশ ঘটছে বলে কেন্দ্রীয় সরকার যা বলছে তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।

অমিত শাহের বাংলাদেশ নিয়ে বিদ্বেষপূর্ণ, অবমাননাকর মন্তব্য করার ইতিহাস দীর্ঘ। প্রায় প্রতিবছরই বাংলাদেশিদের নিয়ে অবমাননাকর কথা বলেন তিনি। ২০১৯ সালে বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশিদের খুঁজে খুঁজে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। ২০২০ সালের নভেম্বরে বিএসএফ-এর সঙ্গে এক বৈঠকে বলেছেন বাংলাদেশ থেকে ভোটার গিয়ে ভারতে ভোট দিয়ে আসে। সীমান্ত সিল করে দেওয়া হবে, যাতে 'মশা-মাছিও' ঢুকতে না পারে। তার এসব আপত্তিকর মন্তব্যের মধ্যে ২০১৮ সালে বাংলাদেশিদের ‘উইপোকা’ বলার বিষয়টি ভারতেও সমালোচিত হয়েছে।
অমিত শাহ যতবারই বাংলাদেশ নিয়ে বিরুপ মন্তব্য করেন বাংলাদেশের মানুষ আশ্চর্য হয়। ভারতীয়দের অর্থনৈতিক অবস্থা, রাজনৈতিক অবস্থা, সামাজিক অবস্থা- কোনটাই বাংলাদেশ থেকে উন্নত নয়। ছিটমহল বিনিময়ের পর যেসব অধিবাসী ভারতে রয়ে গেছে তারা এখন পস্তাচ্ছে। ভারতীয় পত্রিকা খবর করেছে, কেউ কেই অমানবিক জীবন যাপন করছে সেখানে।

এটা ঠিক যে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে সামর্থবান হিন্দুদের কেউ কেউ ভারত গিয়েছেন ভারতকে হিন্দু সম্প্রদায়ের তীর্থ ভূমি জ্ঞান করে। আর কেউ কেউ যাচ্ছেন এখান থেকে বড় অংকের টাকা আত্মসাত করে। মামলায় পলাতক হয়ে। বাংলাদেশ বরং অভিযোগ করতে পারে যে, ভারত এদের দ্বারা অবৈধভাবে বাংলাদেশের সম্পদ পাচারে সহায়তা করছে এবং মুসলমান ছাড়া সবাইকে নাগরিকত্ব দিবে বলে অমিত শাহরা ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল বা সিএবি-এর মূলা’ ঝুলিয়ে শিক্ষিত হিন্দু, বিশেষ করে আমেরিকা-কানাডা-ইউরোপে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশি হিন্দুদের দেশত্যাগে বা ভারতে সেকেন্ড হোম বানাতে অর্থ পাচারে উৎসাহ যোগাচ্ছে। এসব প্রবাসীদের অনেকে পশ্চিমা দেশে ভারতীয় হিন্দু মৌলবাদীদের সঙ্গে মিশে বাংলাদেশ বিরোধী তৎপরতায়ও আছে।

বাংলাদেশের মুসলিমরা তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বসবাস করতে কোন কারণে ভারতে যাবে- আমাদের প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র বাংলাদেশি নাগরিকেরা বার বার এই প্রশ্ন তুলেছে। ভারতে মুসলমানরা হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় বাড়ি ভাড়া নিতে পারে না, উচ্চ পদের সরকারি চাকরি পায় না, নিম্ন শ্রেণির বেসরকারি চাকরি করতে হলেও অনেককে ধর্ম গোপন করতে হয়। ভারতে হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানদের প্রেম-বিয়ে নিষিদ্ধ, গরুর মাংস খাওয়ার কারণে মুসলমানদের হত্যা করে, মোদি-অমিত শাহ জুটির এই বর্বর হিন্দু রাষ্ট্রে বাংলাদেশিরা কেন যাবে!

যে হারে লক্ষাধিক শিক্ষিত ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশের বিভিন্ন সংস্থায় চাকরি করছে, বাংলাদেশিরা ভারতে যে সুযোগ পাচ্ছে না। পেলেও তাদেরকে হয়তো জানে মেরে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিত ভারতীয় হিন্দু মৌলবাদীরা। তাহলে বাংলাদেশের কারা যাচ্ছে ভারতে থাকতে, চাকরি করতে! অশিক্ষিত বেকারতো বাংলাদেশে সচরাচর চোখে দেখা যায় না। ভাত খাওয়ার জন্য ভারত যেতে হবে- যেই দেশের লক্ষ কোটি মানুষ তিন বেলা খাবার পায়না! অমিত শাহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তারতো উচিত ভোটের মাঠে এই বক্তৃতাবাজি না করে, বাংলাভাষী ভারতীয়দের বাংলাদেশি না ভেবে ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ বের করে তার তালিকা ঢাকাকে হস্তান্তর করা।

বাংলাদেশেরও উচিত কতজন ভারতীয় বাংলাদেশে চাকরি করছে তার হিসাব দেওয়া। ২০০৯ সালে ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস পত্রিকা লিখেছিল ৫ লাখ। গার্মেন্টস সেক্টরের লোকরা দাবি করছেন, শুধু এই সেক্টরে বৈধ অবৈধভাবে কত লাখ ভারতীয় কাজ করে এবং কী পরিমাণ রেমিটেন্স ভারতে যায় হিসাবটা দিলে অমিত শাহদের মুখ বন্ধ হবে। সোর্সিং অফিসগুলো আর ফ্যাক্টরিতে শুধু টেকনিশিয়ান সাজিয়ে ফলস ডিক্লারেশন দিয়া নানা ডিপার্টমেন্টে যেসব ভারতীয় এক্সিকিউটিভ কাজ করে এদের ওয়ার্ক পারমিট দেয়া বন্ধ করলে অমিত শাহদের খবর হবে। বাংলাদেশ নিয়ে অমিত শাহের জ্ঞান সীমিত বললে হবে না, জ্ঞান বাড়ানোর দায়িত্ব বাংলাদেশেরও রয়েছে। লক্ষ লক্ষ বেকার দেশে রেখে বিদেশি এক্সিকিউটিভ আনা বিলাসিতা। গার্মেন্টস সেক্টরের বয়স চল্লিশ বছর, শিশু নয় যে এখনও বিদেশি নির্ভর থাকবে।

ভারতীয়রা বছরে কত টাকা বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যায়, তার নানা পরিসংখ্যান রয়েছে। কেউ বলছেন হুন্ডি বাদেও ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, কেউ বলছেন ১০ বিলিয়ন ডলার। রিফিউজি এন্ড মাইগ্রেশন মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট তাদের ২০১৯ সালের রিপোর্টে দেখিয়েছে ভারতীয় নাগরিকদের বাংলাদেশ থেকে পাঠানো অর্থের পরিমাণ চার বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আমি এর কোনটাই নয়, বাংলাদেশ সরকারের কাছে সঠিক এবং হালনাগাদ তথ্য দাবি করছি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যেসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ভারতীয়দের গড়ে টেকনেশিয়ান বানিয়ে এখানে চাকরির সুযোগ দিচ্ছে তাদেরকে চিহ্নিত করতে হবে।

ভারতীয় সরকারি তথ্য মতে, ভারতে যাওয়া বিদেশি রোগী এবং পর্যটক- দুই স্থানেই বাংলাদেশিরা শার্ষস্থানে। ২০১৮ সালে সাড়ে ২২ লাখ বাংলাদেশি পর্যটক হিসেবে ভারত গিয়েছে। ভারতের অর্থনীতিতে এসব বাংলাদেশিদের ভুমিকা অমিত শাহ না জানলেও কলকাতার ব্যবসায়ীরা, রোগীর অভাবে থাকা দিল্লি, ভেলোর, মাদ্রাজ, হায়দ্রাবাদ, ব্যাঙ্গালোর এবং কলকাতার হাসপাতালগুলো করোনাকালে ঠিকই টের পেয়েছে। সে কারণে যত দ্রুত সম্ভব বিমান চলাচলের অনুরোধ নিয়ে আসে তারা।

এদিকে বাংলাদেশি নেটিজেনরা অমিত শাহকে আবার ধুয়ে দিচ্ছে তার মন্তব্যের কারণে। বলছে, হাঁ, বাংলাদেশিরা ভারতে যাচ্ছে কিন্ত টয়লেট না থাকায় ফেরত আসছে। ডাক্তার আব্দুন নূর তুষার লিখেছেন, ‘খোলামাঠে হাগা তাদের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। বিশেষ করে রেললাইনে বসে।‘ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনও এই টয়লেট নিয়ে অমিত শাহকে কটাক্ষ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ভারতের লোকদের ৫০ শতাংশের ভালো কোনো বাথরুম নেই। আর আমাদের ৯০ শতাংশ লোকই ভালো বাথরুম ব্যবহার করেন।’ খোলা জায়গায় টয়লেট করার বিপক্ষে ভারত দীর্ঘ সংগ্রাম করছে। অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খান, আমির খানরা ক্যাম্পেইন করেছেন। অক্ষয় কুমার এই নিয়ে সিনেমা বানিয়ে শত কোটি রুপি আয় এবং রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেয়েছেন কিন্তু খোলা জায়গায় হাগা বন্ধ করা যাচ্ছে না। মহারাষ্ট্র খোলা জায়গায় হাগা বন্ধের আইন করেছে, নরেন্দ্র মোদি 'স্বচ্ছ ভারত অভিযান' চালাচ্ছেন। লাভ হয়নি।

সে কারণে আমারও বলতে হচ্ছে হয়- বাংলাদেশ নিয়ে বেফাঁস মন্তব্য করার আগে অমিত শাহের বরং 'স্বচ্ছ ভারত অভিযান'-এ মন দেওয়া উচিত। ভালো টয়লেট ব্যবস্থা যদি তারা নিশ্চিত করতে পারে- তার কথিত অনুপ্রবেশের উদ্ভট বয়ান বাংলাদেশিদের কাছে তখন বিশ্বাসযোগ্য হতেও পারে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]

এইচআর/জেআইএম