ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

নববর্ষ ১৪২৮

সুভাষ সিংহ রায় | প্রকাশিত: ০৮:৪৭ পিএম, ১৪ এপ্রিল ২০২১

 

পাঠকদের মধ্যে যারা বঙ্গবন্ধুর ‘কারাগারের রোজনামচা’ পড়েছেন তাদের নজরে এসেছে ২২৩ পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছে এইভাবে- “আমি কারাগার থেকে আমার দেশবাসীকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাই। ১০ সেল থেকে মিজানুর রহমান চৌধুরী আমাকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাইয়া একটা টুকরা কাগজে নিম্নলিখিত কবিতাটা লিখে পাঠায়,

‘আজিকের নূতন প্রভাতে নূতন বরষের আগমনে
-মুজিব ভাইকে’

‘বন্ধু হও, শত্রু হও, যেখানে যে কেউ রও,
ক্ষমা কর আজিকার মত,
পুরাতন বরষের সাথে,
পুরাতন অপরাধ যত।’

নববর্ষের শ্রদ্ধাসহ মিজান
১লা বৈশাখ ১৩৭৪ সাল।
( ১৪ এপ্রিল ১৯৬৭ )

(‘কারাাগারের রোজনামচা’র ২২৩ পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছে। প্রকাশক বাংলা একাডেমি, প্রকাশকাল ২০১৭ , ফেব্রয়ারি)”

১৪২৮ নববর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে ভাষণদানকালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বিচিত্রা’ কাব্য গ্রন্থের ‘নববর্ষে’ কবিতা থেকে উপরিউক্ত লাইন কয়টি উল্লেখ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “বেঁচে থাকলে আবার সবকিছু গুছিয়ে নিতে পারবো”

(২)

বাঙালি জাতিকে নববর্ষ পালনের জন্যে লড়াই করতে হয়েছে এবং অবশ্যই এ লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধুর লেখা থেকে জানতে পারি। “একটা যুবপ্রতিষ্ঠান গঠন করা হবে, যেকোনো দলের লোক এতে যোগদান করতে পারবে। তবে সক্রিয় রাজনীতি থেকে যতখানি দূরে রাখা যায় তার চেষ্টা করা হবে। এই প্রতিষ্ঠানকে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করতে হবে। এই প্রতিষ্ঠানের নাম হবে ‘গণতান্ত্রিক যুবলীগ’। আমি বললাম, এর একমাত্র কর্মসূচি হবে সাম্প্রদায়িক মিলনের চেষ্টা, যাতে কোনো দাঙ্গাহাঙ্গামা না হয়, হিন্দুরা দেশ ত্যাগ না করে- যাকে বলে ‘কমিউনাল হারমনি’, তার জন্য চেষ্টা করা’..। ষাটের দশকে বাঙালি জাতি নিজস্ব সংস্কৃতির জন্যে লড়াই করেছে।

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ১৯৬১ থেকে ১৯৭১ পর্ব খুবই গৌরবের ও সংগ্রামের। ১৯৬১ সালের ২৫ বৈশাখে অনেকগুলো সংগঠন একত্র হয়ে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে রবীন্দ্রশতবর্ষ পালন করেছিল। ষাটের দশকে তিনটি ঋতু উৎসবের আগে পরে আরও আরও ছিল রবীন্দ্র-নজরুলের জন্মোৎসব, ছিল বাইশে শ্রাবণের রবীন্দ্রস্মরণ। ১৯৬৭ সালে ১ বৈশাখ রমনার বটমূল তথা অশ্বত্থমূলের প্রশস্ত অঙ্গনে সাংস্কৃতিক স্বাধিকার ঘোষণার জন্য ‘ছায়ানট’ আয়োজন করেছিল বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। সেই থেকে শুরু বাঙালি সংস্কৃতির দিনবদলের পালা। মনে রাখা দরকার বাঙালির অন্যান্য উৎসব ছিল ঈদ-পূজা-খ্রিষ্টোৎসব-বুদ্ধপূর্ণিমার অনুষ্ঠান ছিল ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায় কেন্দ্রিক। সেই সময়ে ছায়ানটের আয়োজনে বাংলা নববর্ষ বরণ হয়ে উঠেছিল হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান তথা সর্বজাতি- সম্প্রদায়ের আনন্দ সম্মেলন হয়ে উঠেছিল। এর মধ্যে অনেক বাধা এসেছে; বাঙালি জাতি সে বাধা মানেনি।

যখন ১৯৫৩ সালে রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে পালন করার জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যে প্রেস বিজ্ঞপ্তি পত্রিকায় পাঠানো হয়েছে, যে আমন্ত্রণ পাঠানো হয়েছে তা কিন্তু অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং প্রতিবছর সে কাজটি করা হতো। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পূর্ব পাকিস্তানে যে গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল বলাবাহুল্য তা এক দশক পরে পাকিস্তানের উভয় অংশের সঙ্গতিকে অনেকটা দুর্বল করে দেয়।

এই প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় আমি একটু উল্লেখ করি, দেশের বিভিন্ন জায়গায় যে জাগরণটি গড়ে-১৯৬৭ সালের জুনে পাকিস্তান সরকার জাতীয় পরিষদে শেষ সপ্তাহে আইয়ুব শাহের কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পর যখন রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসভায় সরকারের ওই যে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করা সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ বঙ্গবন্ধু করেন। তখন গুরুত্বপূর্ণ একটি বক্তব্য রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। দেশের অন্যান্য সমস্যার সাথে বাঙালির প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্র সংগীত সম্পর্কে ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন- আমরা মির্জা গালিব, সক্রেটিস, শেক্সপিয়ার, অ্যারিস্টটল, রবীন্দ্রনাথের লেখা, ডানতে, লেনিন, মাও সেতুং পড়ি জ্ঞান আহরণের জন্যে। আর সরকার আমাদের পাঠ নিষিদ্ধ করে দিয়েছে রবীন্দ্রনাথের লেখা। যিনি একজন বাঙালি কবি এবং বাঙলা কবিতা লিখে বিশ্বকবি হয়েছেন। আমরা এ ব্যবস্থা মানি না, আমরা রবীন্দ্রনাথের বই পড়বই, আমরা রবীন্দ্র সংগীত গাইবই। রবীন্দ্র সংগীত এদেশে গীত হবেই।

বঙ্গবন্ধু তার এ ভাষণে বেতার-টেলিভিশনে রবীন্দ্র সংগীতের ওপর সব ধরনের বিধিনিষেধ তুলে নিয়ে দুটি প্রচারমাধ্যমে পর্যাপ্ত পরিমাণ রবীন্দ্র সংগীত প্রচারের দাবি জানান। বলবার অবকাশ রাখে না, বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের পর বাঙালি সংস্কৃতির ওপর বড় ধরনের আঘাত এসেছিল। ১৯৯৩ সালে ১ বৈশাখ ছিল অন্য রকম বর্ষবরণের পরিবেশ, সেটা ছিল ১৪০০ সাল উদযাপন সময়কাল। আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় ১০০১ সদস্যের বিশিষ্ট নাগরিকদের সমন্বয়ে ‘১৪০০ সাল উদযাপন কমিটি’ গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছিল জননী সাহসিকা বেগম সুফিয়া কামাল ও সদস্য সচিব হয়েছিলেন এখনকার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে। অথচ কী নির্লজ্জভাবে সেই সময়কাল বিএনপি সরকার বেগম সুফিয়া কামালসহ বিশিষ্ট নাগরিকদের রমনা পার্ক এলাকায় ঢুকতে বাধা দেয়া হয়েছিল। সেই সময়কার বিএনপি সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মতিন চৌধুরী নির্লজ্জভাবে বলেছিলেন ‘বাংলাদেশে বিজাতীয় সংস্কৃতি পালন করতে দেয়া হবে না’। উল্লেখ্য যে আব্দুল মতিন চৌধুরী ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশ বিরোধী শক্তির সহযোগী ছিল।

(৩)

পাঠকদের অনেকেই মনে থাকবে আজ খেকে ১৭ বছর আগে ১৪১১ বাংলা নববর্ষের (ইংরেজি ২০০৪ সালের ১৪ এপ্রিল) দিনটির কথা। দুই হাজার চার (২০০৪ সাল) সালে বিবিসি বাংলা একটি 'শ্রোতা জরিপ'-এর আয়োজন করে। বিষয়টি ছিল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি কে? ত্রিশ দিনের ওপর চালানো জরিপে শ্রোতাদের ভোটে নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ ২০ জনের জীবন নিয়ে বিবিসি বাংলায় বেতার অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয় ২০০৪-এর ২৬ মার্চ থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত। বিবিসি বাংলার সেই জরিপে শ্রোতাদের মনোনয়নে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। ২০০৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২২ মার্চ পর্যন্ত ২ কোটি ৫০ লক্ষ বাংলাভাষী মানুষ এই জরিপে অংশগ্রহণ করেছিল । বাংলাদেশের ১ কোটি ২০ লক্ষ বাংলাদেশি নাগরিক সেই ভোট প্রদানে যুক্ত হয়েছিল । সে বছর স্বাধীনতা দিবসের দিন ২৬ মার্চ ২০তম শ্রেষ্ঠ বাঙালি নাম ঘোষণা করা হয়েছিল । প্রতিদিনই একজন করে নাম ঘোষণা করা হচ্ছিল । সর্বশেষ ১৪ এপ্রিল ঘোষিত হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের নাম ।

উপসংহার : ১৯৬৭ সালের পর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ২০২০ সাল এবং ২০২১ সালের অতিমহামারির কারণে বাঙালি জাতি বাংলা নববর্ষ পালন করতে পারেনি । জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী বলেছেন ‘জীবন সর্বাগ্রে , বেঁচে থাকলে সবকিছু গুছিয়ে নিতে পারবো’।

লেখক : রাজনীতি বিশ্লেষক

এইচআর/এমএস