ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

মিথ্যা বলা মোমিনের কাজ নয়

মোস্তফা হোসেইন | প্রকাশিত: ০৯:১৯ এএম, ১৪ এপ্রিল ২০২১

ধর্ম সম্পর্কে আমার জ্ঞান সীমিত। তবে নিজের প্রয়োজনে মাঝে মধ্যে ধর্মীয় বিষয়ে পড়াশোনা করতে হয়। তারপরও জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে ধর্মীয় তাত্ত্বিক বিষয়ে আলোচনা আমার কাজ নয়। তবে যৌক্তিকতা বলে একটা কথা আছে, যা বিবেক দ্বারা অধিকাংশ সময় পরিচালিত হয়। এই বিবেকবোধ যদি ধর্মীয় নির্দেশনার সঙ্গে মিলে যায়, তাহলে যে কোনো বিষয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ হয়। মন্তব্য করাও সম্ভব হয়। সেক্ষেত্রে সরাসরি কোনো মুফতির স্মরণাপন্ন না হলেও উৎরে যেতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, আজকে প্রযুক্তির কল্যাণে যে কোনো বিষয়ই জানা সহজ হয়ে পড়েছে। ধর্মীয় কোনো বিষয়ে ধর্মীয় পণ্ডিত ব্যক্তিদের দেওয়া সমাধান বের করাও কঠিন কিছু নয়।সেই সুবাদে হাদিস ও কোরআনের তফসিরগুলো তাই যে কারো জানা সম্ভব। মিথ্যাচার ও প্রাসঙ্গিক বিষয়ে কিছু লেখার আগে আত্মপক্ষ সমর্থনে এটুকু বলা।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত নিবন্ধে দেখলাম-‘তিনটি ক্ষেত্রে মিথ্যা বলার অনুমতি আছে ইসলামে। যেমন ১. যুদ্ধে মিথ্যা বলা বৈধ ২. দু’পক্ষের মাঝে সমঝোতা করার জন্য মিথ্যা বলা বৈধ এবং ৩. স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ভালোবাসা ও মিল তৈরি করার জন্যও মিথ্যা বলা বৈধ। (তিরমিজি, হাদিস নং : ১৯৩৯; সহিহ আল-জামে : ৭৭২৩)’

এই সম্পর্কে বলা আছে স্ত্রীকে খুশি করার জন্য তার গুণ ও রূপের বর্ণনা বাড়িয়ে বলা যাবে, তার তৈরি খাবার সুস্বাদু না হলেও বলা যাবে, বেশ হয়েছে। অন্যত্র প্রেমবর্ধক কাজে স্ত্রীর সঙ্গে মিথ্যাচারের সুযোগ আছে বলা হয়েছে। (মুসলিম, ৬৭৯৯; সুনানে আবু দাউদ, ৪৯২৩)

প্রশ্ন হচ্ছে হেফাজতে ইসলামির নেতা মামুনুল হকের মিথ্যার পেছনে এই তিন পথের কোনটি কার্যকর হয়েছে? তিনি কি তার স্ত্রীকে খুশি করার জন্য মিথ্যাচার করেছিলেন? নাকি নিজের অপরাধ ঢাকতে গিয়ে মিথ্যাচার করেছেন। তিনি তাঁর স্ত্রী আমেনা তৈয়বাকে বলেছেন,তার সঙ্গে রিসোর্টে আসা নারী শহিদুলের সাবেক স্ত্রী । শুধু তাই নয় তিনি আমেনা তৈয়বাকে অনুরোধ করেছেন, কেউ কিছু প্রশ্ন করলে যেন আমেনা তৈয়বা এমনটাই বলেন। এই বক্তব্যে কি আমেনা তৈয়বাকে খুশি করার কিছু আছে? নাকি নিজের অপরাধকে ঢাকার জন্য আমেনা তৈয়বাও যাতে মিথ্যার আশ্রয় নেন তাই নির্দেশ প্রদান করেছেন।এমন নির্দেশনায় কোনো স্ত্রী কি খুশি হতে পারেন? আমেনা তৈয়বা যখন জানলেন, অন্য একজন নারীকে আমেনা তৈয়বা নাম দিয়ে রিসোর্টে তার স্বামী রাত্রিবাস করতে গেছেন, সেটা কি তার জন্য সুখকর বিষয় হতে পারে? এখানে ওই যে বিবেকের কথা বললাম, সেই বিবেকের কাছ থেকে জবাব পাওয়া সম্ভব। কিংবা যুক্তির আশ্রয় নেয়া যেতে পারে। স্পষ্ট বোঝা যায়, আমেনা বেগমের হৃদয়ে তখন রক্তক্ষরণ হওয়ার কথা। এই বাক্যালাপে আমেনা তৈয়বার স্বামীর প্রতি ভালোবাসা তৈরির কোনো কারণ নেই। ফাঁস হওয়া কথোপকথনে আমেনা তৈয়বা খুশি হয়েছেন এমন কোনো লক্ষণও ছিলো না। তিনি বাসায় আসার পর কথা হবে বলেছেন। অনুমান করা যায়- তিনি ক্ষুব্ধ হয়েই এমন জবাব দিয়েছেন।

মামুনুল হক জটিল পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে রিসোর্টে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা জেনেশুনে মিথ্যাচার। মামুনুল হকের দাবি অনুযায়ী স্ত্রীকে খুশি করার জন্য তিনি মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন, ধরা যাক এটাই সত্যি। কিন্তু তার আগে তিনি যখন রিসোর্টে বুকিং দিলেন, তখন তার সঙ্গে আসা নারীর নাম লিখলেন আমেনা তৈয়বা। শুধু তাই নয়, স্থানীয় মানুষজন যখন তাকে ওই নারীর নাম জিজ্ঞেস করেছেন তখনও তিনি আমেনা তৈয়বাই বলেছেন। তার মানে হচ্ছে, রিসোর্টে নাম তালিকাভুক্ত করার সময় একবার মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন, আবার স্থানীয় মানুষের সামনেও সেই মিথ্যাচারই করেছেন।

প্রকৃত আমেনা তৈয়বাকে তার মতে খুশি করার জন্য তিনি মিথ্যা বলেছেন এবং মনে করছেন সীমিত পরিসরে মিথ্যা বলার বিধান আছে। কিন্তু রিসোর্টের রেজিস্টারে নাম লেখার সময় কাকে খুশি করার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিলেন। এমন মিথ্যা তথ্য ব্যবহারের কোনো সুযোগ কি আছে ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী? হাদিস কোরআনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ না করে আমরা যদি তার বক্তব্যকেই যথেষ্ট মনে করি, তাহলে বলতে হবে, এই মিথ্যাচারের পেছনে কোনো ধর্মীয় যুক্তির কথা তিনি বলেননি। কিংবা মিথ্যাচারকে তিনি বৈধতা দিতে পারেননি।

এটুকু ব্যক্তি মামুনুল হকের প্রসঙ্গ।তারপরও হেফাজতে ইসলামির সিনিয়র নেতারা এটা সহজভাবে মেনে নিতে পারছেন না। হেফাজতের সিনিয়র একজন নেতা এবং যিনি খেলাফত মজলিশেরও একজন নেতা, বললেন, এই মুহূর্তে হেফাজতের ভুলগুলো মানুষের মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে। সংগঠনের বড় রকমের ক্ষতি হলেও শিক্ষাও হচ্ছে এতে করে। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, মামুনুল হকের ঘটনাগুলো ব্যক্তিগত আখ্যায়িত করে সংগঠন কি পরিত্রাণ পাবে দায় থেকে? তিনি বললেন, দায় নেই। কিন্তু বিষয়টির কারণে যেমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়লাম তাকে কি দায়মুক্তি বলা চলে? ব্যক্তিগত বিষয় বলে উড়িয়ে দিতে পারলে কর্মসূচি দিতে পারছি না কেন? জানেন মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলতে গিয়েও মুখ আটকে যায়। সুতরাং এর প্রভাব সংগঠনেও পড়ছে, ওই অর্থে বলতে পারেন। দীর্ঘদিন পর্যন্ত এর রেশ থাকবে। আবার ঘুরে দাঁড়াতে গেলে ওই শক্তি অবশিষ্ট আছে কিনা সেটাও ভাবতে হবে। অন্তত নৈতিক শক্তির কথা বলতে হবে এখানে।

এবার আসা যাক হেফাজতে ইসলামি সাংগঠনিকভাবে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে কি না। সোনারগাঁও ঘটনার পর হেফাজতে ইসলামি রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সাংবাদিক সম্মেলন ডাকে।মামুনুল হকের পক্ষে এবং হেফাজতে ইসলামির সাংগঠনিক বক্তব্য শেষ হওয়ার পর সাংবাদিকদের প্রশ্ন শুরু হলে তাড়াহুড়ো করে মোনাজাত মাধ্যমে সম্মেলন শেষ করে দেন হেফাজত নেতারা। সেদিন স্পষ্টভাবে হেফাজতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ফাঁস হওয়া ফোনালাপটি প্রযুক্তি সহায়তা নিয়ে তৈরি অর্থাৎ এটি মামুনুল হকের নয়।

পরবর্তীতে মামুনুল হক নিজেই স্বীকার করেছেন, ফাঁস হওয়া কথোপকথনটি তার। ফলে হেফাজতে ইসলামীর নেতাদের এই বক্তব্যকে মিথ্যাচার আখ্যায়িত করা যায় কি না সহজেই সেরকম প্রশ্ন আসে। হেফাজত নেতাদের অনুমাননির্ভর কিংবা মিথ্যাচার করার উদাহরণ শুধু এটিই নয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যে তাণ্ডব চালানো হলো, সেই তাণ্ডবে হেফাজতের কেউ ছিলো না বলে হেফাজতের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে।একইসঙ্গে দেখা যায়, হেফাজতের নেতৃবৃন্দ ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবে গিয়ে প্রেসক্লাব ভাংচুড়ের জন্য এবং সাংবাদিকের ওপর হামলার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তার মানে হচ্ছে- ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনাতেও যে মিথ্যাচার হয়েছে তাও তারা নিজেরাই প্রমাণ করলেন।

এই সংগঠনটির ধর্মের নামে মিথ্যার আশ্রয় নেয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়। হেফাজতের শীর্ষনেতা বলেছিলেন গার্মেন্টস এর মেয়েরা জেনা করে। এ নিয়ে বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন আছে কি? শাপলা চত্বরে জমায়েত হয়ে বাবুনগরী ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখছিলেন।ওই সময় সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের কারণে তাদের স্থান ত্যাগ করতে হয়। এরপর তাদের পক্ষ থেকে বলা হলো শতশত মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ৭/৮ বছর পেরিয়ে গেলেও একটা প্রমাণও তারা হাজির করতে পারেনি। বরং একটি তালিকা ধরে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা গেলো কথিত মৃত ব্যক্তি মাদ্রাসায় ক্লাস নিচ্ছেন।

শাপলা চত্বরের ঘটনার পরদিন মিজিমিজি ও আশেপাশের এলাকার মসজিদের মাইকে ঘোষণা দেওয়া হলো, মাদ্রাসা আক্রমণ করেছে প্রতিহত করতে সবাই রাস্তায় নামুন। মিথ্যা ওই প্রচারণার পরিণতিতে কয়েকটি প্রাণ গেলো। একইভাবে মাণিকগঞ্জেও মাইকে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে উত্তেজনা তৈরি করা হলো। যাকে সংবাদপত্রগুলো গুজব হিসেবে আখ্যায়িত করে।

সাংগঠনিকভাবে জন্মলগ্ন থেকেই ঘোষণা করা হয়েছে হেফাজতে ইসলামি কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়। বাস্তবতা হচ্ছে হেফাজতের মধ্যে খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, খেলাফত আন্দোলন, নেজামে ইসলামি এবং ইসলামি ঐক্যজোট সরাসরি যুক্ত। তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্যও প্রায় একরকম।। সুতরাং হেফাজতে ইসলামি একটি অরাজনৈতিক সংগঠন বলাটা সত্যের অপলাপ বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। শুধু তাই নয়,হেফাজত নেতাদের নির্বাচনে অংশ নিতেও দেখা গেছে। প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী কেন্দ্রীয় নির্দেশে হেফাজতের কয়েকজন নেতা স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও অংশ নিয়েছেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে হাটহাজারী উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান হয়েছিলেন হাটহাজারি পৌরসভা হেফাজতে ইসলামির সাধারণ সম্পাদক নাসিরউদ্দীন মুনির। ওই সময় বেশ কিছু জায়গায় হেফাজতের নেতাদের নির্বাচনে অংশ নিতে দেখা যায়।

এবার কর্মসূচিগুলো আলোচনায় আসতে পারে।সম্প্রতি হেফাজতে ইসলামি স্বাধীনতা দিবসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাণ্ডব ঘটিয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ আগমনের প্রতিবাদে তারা এই কর্মসূচি পালন করেছে। কিন্তু তারা স্বাধীনতা দিবসকে বেছে নিয়েছে প্রতিবাদের দিন হিসেবে। তারা স্বাধীনতা দিবসটিকে বেছে নিয়েছে স্পষ্টত স্বাধীনতা দিবসকে অবজ্ঞা করার মানসে। যদি তারা নরেন্দ্র মোদীর আগমনের প্রতিবাদেই এই কর্মসূচি নিতো তাহলে সেটা ২৭ মার্চও হতে পারতো। কারণ নরেন্দ্র মোদী ২৭ মার্চ পুরোদিনই শুধু নয় নির্ধারিত সময়েরও দুই ঘণ্টা বেশি সময় বাংলাদেশে অবস্থান করছিলেন। তার মানে হচ্ছে আসলে নরেন্দ্র মোদী উছিলা মাত্র। স্বাধীনতা দিবসকে চ্যালেঞ্জ করাই তাদের উদ্দেশ্য।

তারা যে স্বাধীনতাকে প্রতিপক্ষ ভাবে তার আরেকটি প্রমাণ হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ভাঙা। যদি তারা নরেন্দ্র মোদীর আগমনের প্রতিবাদ করতো, তাহলে তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতীক বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ভাঙে কোন যুক্তিতে। সর্বোপরি তাদের এসব কর্মসূচি স্পষ্টত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এবং অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে হেফাজতের ঘোষণাটি অবশ্যই অসত্য।

সবমিলে বলা যায়, মামুনুল হক রিসোর্টে ঝর্নাকে আমেনা বানিয়ে অসত্য বলেছেন এটাই শুধু নয়, তিনি যে সংগঠনটির নেতা সেই সংগঠনটিও অসত্যকেই লালন করেন। আর তিনি অসত্য বলার পেছনে যে ধর্মীয় যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন সেটিও যথার্থ কি না তাও ভাবার অবকাশ রয়ে গেছে। সবশেষে বলাই যায়, যে কোনো উছিলাতেই মিথ্যাচার আর যাই হোক ধর্মীয় নেতার কাজ হতে পারে না।হুজুরদের মুখে শোনা কথা- মিথ্যা বলা মোমিনের কাজ নয়।

লেখক : সাংবাদিক,মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও শিশুসাহিত্যিক।

এইচআর/জেআইএম

আরও পড়ুন