শেষ চৈত্রের শেষ সূর্যাস্তে
জাফর ওয়াজেদ
বিদায় বেলা আঁখি দুটো ছলোছল হবারই কথা। যে আর ফিরবে না, তার জন্য শোকগাথা তৈরি হয়ে যায় অনায়াসে। কতো আবেগ, ভালবাসা, সুখ-দুঃখ, আনন্দ বেদনা, উল্লাসে-উচ্ছ্বাসে কেটে গেছে সময় দিন মাস এবং বছর। জমেছে প্রচুর আবর্জনা। কলুষতার ডাস্টবিনগুলোতে উপচে পড়ছে রাশি রাশি বর্জ্য। কটু দুর্গন্ধ শুধু ছড়ায়। সারা বছর ধরে জমে থাকা পুঞ্জীভূত ক্ষোভগুলোও বিদায়ের পথে। কিন্তু রেশ তার থেকে যাচ্ছে তবু। কোভিড-১৯ এর ভয়াবহতা ক্রমশ বাড়ছে, জীবন গিয়েছে থমকে। অতিমারির এই কালে বর্ষ ফুরায়ে আসে তথাপি। এসবের বিপরীতে সুগন্ধি সুবাতাস বহে যাওয়া দিনগুলো ফিরে পাওয়া গেলে আরও সুন্দরের পথে চলবে এগিয়ে।
আজ শেষ চৈত্রের সূর্যাস্তের ছায়া ছায়া রোদমাখা উষ্ণ বিকেলের দিকে তাকালে ভেসে আসবেই ১৪২৪ সনের ঘটনাপঞ্জি। বিদায়ের রাগিনী বেজে ওঠার এই গোধূলি সন্ধিতে মনে প্রশ্ন জাগবেই, কেমন ছিল বিদায়ী বছরটি। এক বাক্যে হয়তো বলা হবে, ভাল-মন্দ মিলিয়েই কেটেছে বছর। আলো-অন্ধকারের দিন রাত্রিগুলো হয়তো ছিল স্বপ্নময় কিংবা বিষাদগ্রস্ত। তবে স্বস্তির ভার ছিল সর্বত্র। বিদায়ী বছরে পেছনে ফেলে আসা হয় কত স্মৃতি, কত রোমাঞ্চ, আনন্দ, জাগরণ। আর কিছু বেদনামিশ্রত দুঃখ ভারাক্রান্ত সময় দিতে হয় পাড়ি।
বাঙালির জীবনে আশা-নিরাশা, আলো-আঁধার, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা আর অগ্রগতির সুর তাল লয়ই জবাব দেবে বিদায়ী বছরের হাল হকিকত কেমন ধারায় প্রবাহিত হয়েছে। বিশ্বমানব হবার পথে তার এগিয়ে চলার রথ দিয়েছে কতটুকু পাড়ি বিদায়ী বছরে, সূর্যাস্তের শেষ আলোয় তার উত্তরও ভেসে উঠবে মানসপটে। বিদায়ের সুর বেদনার, কিন্তু নতুনের আগমন আনন্দের। তাই বর্ষ বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে নববর্ষের আগমন এক অনির্বচনীয় সুখের পাহাড় এনে দেয়। কিন্তু এবারের নববর্ষের অতিমারির আক্রোশ তীব্রতর। তাই সব আনন্দ গিয়েছে থেমে।
বাঙালিজাতির জীবনে ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহ দহন লাগে,/তবুও শান্তি, তবু অনন্ত, তবু আনন্দ জাগে।’ শেষ চৈত্রের খরতাপে বা দাবদাহে দগ্ধ মৃত্তিকা যখন বৈশাখের প্রথম সূর্যের আলোয় ঝলমল করে ওঠে; তখন যেন বাঙালির মনও নতুনত্বের স্বাদ গ্রহণের জন্য হয়ে ওঠে উদগ্রীব। এই দেশের ভাষা এক, খাদ্যাভ্যাস প্রায় এক। বাঙালী কঠোর শ্রমজীবী, নির্মল, সহজসরল, হাসিখুশি, ধার্মিক অথচ ধর্মে নয় গোঁড়া। বাঙালি অসাম্প্রদায়িক, শান্তিবাদী, শিল্প ও সঙ্গীতপ্রিয়, পরিবেশবাদী, দেশপ্রেমিকও।
কৃষিজীবী, লৌকিক দর্শন ও ভাববাদী এই দেশকে সুশাসন, প্রকৃত ইতিহাস, শান্তি, সংস্কৃতি দিয়ে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত করুক, এমন প্রত্যাশা জাগায় নতুন বছরের আবাহনে। বিদায়ী বছরের শেষ দিন আশাবাদ জাগায়, আরও বেশি প্রাণ প্রবাহ যেন হয় সঞ্চারিত নতুন বর্ষে, পুরাতনের রেশ নিয়ে। এমনিতেই প্রতিটি জাতির, প্রতিটি সংস্কৃতির কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে, বাঙালীরও তাই। চৈত্রমাস বাঙালির দিনপঞ্জির শেষ মাস। বসন্তের মাতাল হাওয়ায় বর্ষ ফুরানোর গান বেজে ওঠে সর্বত্র।
ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসকদের স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক ছিলেন সিএ বেন্টলি। ১৯২১ সালে প্রকাশিত তার ‘ফেয়ার এ্যান্ড ফেস্টিভ্যালস ইন বেঙ্গল’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘বছর শেষের পুরো চৈত্র মাসই যে বাঙালির উৎসবের মাস। কারণ, এই মাসে বাংলার নানা জায়গায় নানারকম গ্রামীণ মেলা হতো-চৈত্র সংক্রান্তি ছিল এর অন্যতম। নববর্ষের মেলা প্রায় সারা চৈত্র মাস এবং বৈশাখ মাস পর্যন্ত হতো।’ বেন্টলি ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের সংবছরের মেলার তালিকাও দিয়েছেন। সে আমলেও শেষ চৈত্রে চড়কা পূজা হতো। বাংলাদেশে চড়ক পূজার আয়োজন চলে শেষ চৈত্রে দেশের বিভিন্ন গ্রামে। হিন্দু সম্প্রদায়ের নিম্ন বর্ণের মানুষরা এতে অংশ নেয়। এই পূজাকে কেন্দ্র করেও বসে মেলা।
১৩০৮ সন তথা ১৯০১ সালের শেষ চৈত্রদিনে শান্তিনিকেতনের উপাসনালয়ে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘পৃথিবীতে সকল বস্তুই আসিতেছে এবং যাইতেছে-কিছুই স্থির নহে; সকলই চঞ্চল-বর্ষশেষের সন্ধ্যায় এই কথাই তপ্ত দীর্ঘনিঃশ্বাসের সহিত হৃদয়ের মধ্যে প্রবাহিত হইতে থাকে। কিন্তু যাহা আছে, যাহা চিরকাল স্থির থাকে, যাহাকে কেহই হরণ করিতে পারে না, যাহা আমাদের অন্তরে বিরাজমানÑ গত বর্ষে সেই ধ্রæবের কি পরিচয় পাই নাই-জীবনে কি তাহার কোন লক্ষণ চিহ্নিত হয় নাই? সকলই কেবল আসিয়াছে কিংবা গিয়াছে?’ না, শুধু আসা-যাওয়াতেই সবকিছু সীমিত ছিল, তা নয়। অনেক কিছুই গ্রথিত হয়ে যায় নানা দিগন্তরেখার সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে। এটা তো স্বীকার্য যে, ইতিহাস হতে শিক্ষা গ্রহণ করার মধ্যেই অতীত স্মরণ করার সার্থকতা।
পক্ষান্তরে, অতীতে ফিরে গিয়ে বর্তমান সমস্যাবলি সমাধানের চেষ্টা করার নাম পশ্চাদমুখিতা। আর তা মাত্রেই অগণতান্ত্রিক। অগণতান্ত্রিক পন্থা এবং প্রবঞ্চনা ছাড়া অতীতে ফিরে যাওয়া যায় না। বিশ শতকের ষাটের দশকে দেখা যেতো, চৈত্রের শেষের দিকে গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে বীজ বপন উৎসব, ভাল খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন। চৈত্র সংক্রান্তিতে পঞ্চব্যঞ্জনের ধারাবাহিকতা আজও বিদ্যমান। মেলা বসতো গ্রামের বড় বটবৃক্ষের নিচে।
মেলায় খেলাধুলা হতো। ছেলেমেয়েরা টুকরি ভরে নিয়ে আসতো বিন্নি ধানের খৈ, চিনির হাতি ঘোড়া পুতুল, জিলাপি, বড় বাতাসা, বাঁশি এবং আরও কতো কি। মাটির তৈরি তৈজসপত্র তো থাকতোই মেলায়। চৈত্র সংক্রান্তির দিনটি ছিল একদা প্রকৃতই বিষণœতার দিন। বর্ষবিদায়ে বেদনা ভারাতুর হতো বুঝি প্রকৃতিও। আর বর্ষা শুরুর দিন হতো ছুটির দিন, আনন্দের দিন মেলার দিন। প্রাণে প্রাণ যোগানোর দিন। কিন্তু সেদিনের অনাবিল আনন্দ কোলাহলের কতটুকু অবশিষ্ট আছে পল্লীগ্রামে অথবা শহরে? শহরের উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্তরা সরাসরি ছুটি ভোগ করছে, গানের জলসায় যোগ দিচ্ছে।
অনেকে মেলায় কোনাকাটাও করছে। অপরদিকে রিক্সাচালক সাত-সকাল থেকেই রিক্সা চালাচ্ছেন। ঠেলাগাড়িওয়ালা ও ভ্যানওয়ালা তার গাড়ি নিয়ে পথে, কুলিমজুরেরা কোদাল টুকরি হাতে চৌরাস্তার মোড়ে কাজ পাওয়ার আশায় অপেক্ষমাণ। ফকির, ভিক্ষুক, ফেরিওয়ালারাও শশব্যস্ত। গ্রামবাংলারও একই অবস্থা। কিষাণ, কিষাণিসহ মজুরদের যেমন শুক্র-শনিবারের ছুটি নেই, নেই নববর্ষসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দিবসের ছুটিও। ঈদে-চাঁদেও নয় ওরা সমস্যামুক্ত।
এখনও তারা কাজ খোঁজে, কাজ করে যায় নিরন্তর। শতে শতে ভিক্ষায় নেমে সভ্য ও সংস্কৃতিবান ব্যক্তিদের জন্য অনায়াসে পুণ্যার্জনের কাজে বুঝি সহায়তাই করে। জীবিতকালে আসলে তাদের ছুটি মেলে না। ‘ওরা চিরকাল টানে দাঁড়। ধরে থাকে হাল : ওরা মাঠেমাঠে বীজ বোনে; পাকা ধান কাটে/ওরা কাজ করে নগরে-প্রান্তরে।’ রবীন্দ্রনাথ জেনেছিলেন তাদের। বুঝেছিলেন, ওদের কঠোর পরিশ্রমে উৎপন্ন ধান এবং শস্য ভোগ করা হচ্ছে। আজীবন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নিজেরা অভুক্ত-অর্ধভুক্ত এবং জীর্ণবস্ত্র পরিহিত থেকে ওরা একটি ক্ষুদ্রশ্রেণীর ছুটি ভোগ ও আরাম আয়েসের যাবতীয় উপাদান যোগাচ্ছে। অথচ নিজেরা জানে না ছুটি কী জিনিস। যেন ‘বেদনারে করিতেছে পরিহাস স্বার্থোদ্ধত অধিকার।’
বসন্তের আজ শেষ দিন। ১৪২৭ সনেরও শেষ দিন। শেষ বেলার গান গাইবার দিন। ব্যর্থপ্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলার প্রাকলগ্ন এখন। শেষের এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আসন্ন গ্রীষ্মকালকে তথা বৈশাখকে বরণ করে নেয়ার পূর্ব মুহূর্তে জেগে ওঠে বিদায়ী বছরের যাত্রা দৃশ্য। কোভিড-১৯ সারাবিশ^কে তছনছ, পর্যুদস্ত করছে। বিদায়ী বছরের শুরুরও আগে কোরোনা প্রকোপ বাড়তে থাকে। শীতকালে কমে এলেও বসন্তে আবার বেড়েছে। তাই নববর্ষ ও বিদায়ী এই বছরে দেশে জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদ দমিত হয়েছে। তারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি। অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে বিদায়ী বছরে। তবে ষড়যন্ত্র থেমে নেই। আর তার প্রমাণ মিলেছে বছর শেষে ধর্মান্ধদের নোংরা খেলায়। মধ্যে জামায়াত-শিবির ও জঙ্গীদের নাশকতায় লিপ্ত হতে দেখা গেছে।
আজ বিদায় নিচ্ছে যে বছরটি, তার পুরো সময়টাতে দেখা যায়, করোনায় মৃতের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে। অর্থনীতিকে বিপর্যদস্তু করছে। সার্বিক দুঃসহ যন্ত্রণাময় যেন। অনেকেই মানসিকভাবে পর্যুদস্ত। এই এক অসহনীয় অবস্থায় বিদায় নিচ্ছে ২০২৭ সন। পাশাপাশি দেশ উন্নতি ও অগ্রগতির দিকে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে। তাই মধ্যম আয়ের দেশে বাংলাদেশ উপনীত হবার পথে চলছে। কিন্তু দুর্নীতির মাতা-পুত্র এখনও যে কথিত রাজনীতির চর্চা করে আসছেন, তা পশ্চাদমুখী, দেশ ও গণবিরোধী।
তাদের সহায়ক সশস্ত্র ও প্রশিক্ষিত শক্তিরা যে কোন সময় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় সমাসীন। তবে বিদায়ী বছরে দেশকে অস্থিতিশীল করার তাদের কোন তৎপরতাই হালে পানি পায়নি। সভা-সমাবেশের নামে সহিংস তৎপরতা চালানোর প্রচেষ্টা সফল হয়নি। ভেবেছিল, দুর্নীতির দায়ে জেলখানায় গেলে সারাদেশে সহিংস আন্দোলন হবে। জনগণ বিক্ষুব্ধ হবে। কিন্তু জনগণ সংক্ষুব্ধ হওয়া দূরে থাক; বরং তারা স্বস্তি পেয়েছে দেশে আইনের শাসন অব্যাহত থাকায়। জনগণ তাদের ডাকে সাড়াও দেয়নি। তাই চোরাগোপ্তা পথ আবারও বেছে নেবে তারা নতুন বর্ষেÑএমন আশঙ্কা অমূলক নয়।
বরষ ফুরায়ে আসে। বাঙালির জীবন থেকে সরে যাচ্ছে ১৪২৭ সাল। বিদায় চৈত্র সংক্রান্তি। বিদায় ১৪২৭ সন। শুভ হোক নতুন বছরে। যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত হবার দেবে ডাক পহেলা বৈশাখ। করোনামুক্ত হোক বাংলাদেশসহ সারাবিশ^, যুদ্ধাপরাধী মুক্ত হোক দেশ, পরাজিত শক্তির হোক বিনাশ। নাশকতা, সহিংসতা, বোমাবাজি হোক উধাও। স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের দাপট হোক বিলীন। আমার সোনার বাংলা হোক সোনায় মোড়ানো। ডিজিটাল বাংলাদেশ হোক সমৃদ্ধ। স্বাগত ১৪২৮ বাংলা সন।
লেখক : কবি, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক, মহাপরিচালক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)।
এইচআর/জেআইএম