মিয়ানমারে জান্তা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ‘সামাজিক শাস্তি’
প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
গত ১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ভোরবেলা মিয়ানমারে রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটান সেনাপ্রধান মিন অং হ্লেইং। কিন্তু তারপর থেকে দেশটিতে সামরিক বাহিনীর নির্মম নির্যাতন ও রক্তপাত ঘটানোর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। অ্যাসিসট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্সের তথ্যমতে, মিয়ানমারে জান্তাবিরোধী বিক্ষোভে মার্চ ২৭ সকালে দেশটির সসশ্র বাহিনী দিবস পালন করার সময় ৯৩ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এনিয়ে এ পর্যন্ত দেশটিতে অন্তত ৪০৮ জন নিহত হয়েছেন।
রাজধানী ইয়াঙ্গুন ছেড়ে ভারতের মিজোরাম ও থাইল্যান্ড সীমান্ত দিয়ে হাজার হাজার সাধারণ মানুষ পালিয়ে জীবন রক্ষা করছেন। এরপরও গণতন্ত্রকামী মানুষ মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে বুলেটের সামনে নিজেদেরকে সঁপে দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।
কিছুদিন আগে নাগরিক অসহযোগ আন্দেলন-সিডিএম নামক সংগঠন ‘সামাজিক শাস্তি’ নামে নতুন এক আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। এই আন্দোলন বেশ সাড়া ফেলেছে।
‘সামাজিক শাস্তি’ নামক বিশেষ আন্দোলনের উদ্দেশ্য হলো- সামরিক জান্তাদের পরিবার ও সহযোগীদের সামাজিকভাবে বয়কট করা এবং নানা ধরনের শাস্তির মধ্যে গণ্য করার জন্য পাকড়াও করা। সামাজিকভাবে হেয় করা, ঘৃণা ও লজ্জা দেয়ার জন্য এই ডাক দেয়া হয়েছে।
সামরিক সদস্যদের আনুকূল্যে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে জান্তাদের আত্মীয়-স্বজনরা চাকুরি করেন। স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে নিয়োগকৃতরা অনেকে বড় বড় প্রতিষ্ঠানের মালিক বনে গেছেন। সেনা প্রধানের মেয়েও সিনেমার প্রযোজনা করছেন ও সিনেমাশিল্পকে নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে জানা গেছে।
সিডিএম-এর সদস্যরা জান্তাদের সন্তানরা কোন দেশে পড়াশুনা করছে এবং কোন কোন প্রতিষ্ঠানের অবৈধ মালিক তা খুঁজে বের করে ফেসবুক. টুইটার, ইন্সট্রাগামে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিচ্ছে সামাজিক শাস্তির অংশ হিসেবে। তবুও জান্তাদের কোন বিকার নেই। থামছে না গুলিতে মৃত্যু।
কয়েকদিন পূর্বে এক বাবাকে সৈন্যরা গুলি করে। গুলিটি তার কোলে থাকা সাত বছরের মেয়ের দেহে লেগে মেয়েটি মারা যায়। রাস্তায় চলতে বাজার ফেরত থাকা নিরীহ মানুষকে হামাগুড়ি দিয়ে চলতে বাধ্য করা হয়েছে। যেসকল চাকুরীজীবী সরকারের বিরোধিতা করে রাস্তায় নেছে তাদেরকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অনুসন্ধান করে খুঁজে বের করে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অনেকে প্রাণভয়ে চাকুরি ছেড়ে মিজোরাম ও থাইল্যান্ড সীমান্তের দিকে পালিয়ে জীবন রক্ষা করার চেষ্টা করছেন। জান্তারা রোহিঙ্গা মুসলিমদেরকে বাধ্য করেছিল বাংলাদেশ সীমান্তে ঠেলে দিয়ে। আর এখন জান্তাদের ভয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুসহ অন্য ধর্মের মানুষ ভিন দেশে পাড়ি জমাচ্ছে। পালাতে গিয়ে বড়দের সাথে বিশজন শিশুও মৃত্যুবরণ করছে।
এছাড়া বন্দী করা হয়েছে সুচি-র দলের মন্ত্রী, এমপি, প্রাদেশিক প্রতিমন্ত্রীকে। সাথে বিবিসি সাংবাদিক অং থুরাসহ চল্লিশজন সাংবাদিককে বন্দী করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক চাপে বিবিসি সাংবাদিক অং থুরা কে মুক্তি দেয়া হলেও অন্যদেরকে জেলখানায় পুরে রাখা হয়েছে। মিয়ানমারে সামরিক নির্যাতন বিরোধিতা করে স্বৈরাচার প্রতিরোধে পিপলস্ আর্মি গঠিত হয়েছে। তারা আন্দোলনের পাশাপাশি জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দিকে সাহায্যের জন্য তাকিয়ে আছে।
কিন্তু কেন এই অসভ্যতা? একটু গভীরে দৃষ্টি দিলে বোঝা যেতে পারে, সারা পৃথিবীতে স্মরণাতীত কাল থেকে চলে আসছে ‘মাৎস্যন্যায়’। অর্থাৎ, ‘জোর যার মুল্লুক তার’। গণতন্ত্রের নামে এই অপতৎপরতাকে লাগাম টানার ব্যবস্থা করা হলেও দেশে দেশে সামরিক গণতন্ত্রের নামে জনগণের উপর চালানো হয়েছে নিপীড়ন, নির্যাতন। এই অবস্থা দুটো দিক দিয়ে বিস্তার লাভ করে। প্রথমত চুরি করা ও চুরির প্রতিবাদে মানুষ যাতে রাস্তায় বের হতে না পারে সেজন্য তথ্য ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়াকে কব্জা করে অন্যায় কাজে ব্যবহার করা। এই চুরি হচ্ছে- অর্থচুরি, জালিয়াতি, স্বজনপ্রীতি দুর্নীতি ইত্যাদির মাধ্যমে নিজেদের ও বংশবদদের উদর পুর্তির ব্যবস্থা করা। আর ডাকাতি হচ্ছে- গণতন্ত্রের লেবাসে সামরিক কায়দায় গণতন্ত্র নামটি ব্যবহার করে ভোট ডাকাতি, ব্যাংক ডাকতি, বিদেশে অর্থ পাচার করে পরিবারকে দিয়ে সেখানে ভোগ-বিলাসে মত্ত রাখা ও শক্তিশালী বিদেশী প্রভুদের তোয়াজ করে দেশের ক্ষমতাকে জিইয়ে রাখা। গণতন্ত্রহীন গরীব দেশগুলোর ক্ষেত্রে এটাই হচ্ছে দীর্ঘদিনের প্রচলিত অনুশীলন। তাই কোন দেশের মানুষ নিজেদের অধিকার হরিত হয়ে দীর্ঘদিন রাজনৈতিক ও সামাজিক সচেতনতা হারিয়ে ফেললে সেখানে পুনরায় জেঁকে বসে এই ধরণের মানবাধিকার হরণের হোলিখেলা।
অং সান সুচির ক্ষমতা লাভের পূর্বে মিয়ানমার দীর্ঘদিন যাবত সামরিক শাসনের অধীনে থাকায় সেদেশের জনগণের কন্ঠরোধ করা ছিল। তারা জান্তাদের ভয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার ভাষা ভুলেই গিয়েছিল। সামরিক ছত্রছায়ায় সংখ্যাগুরু গোষ্ঠী সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের স্বর্বস্ব কেড়ে নিয়ে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছিল।
আরেকটি হলো- সুচির সময়ে মানুষ কিছুটা সচেতন হয়ে উঠলে শুধু চুরি করে আর মনপুত: হচ্ছিল না জান্তাদের। তাই আবারো সবকিছু নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে গিলে খাবার তাগিদে ডাকাতি প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সামরিক কায়দায় সবকিছুকে দখল করে অধিকারহারা মানুষকে ঘরে বন্দী করে রাখা। ডিজিটাল যুগে এসেও নিজের মনমত যে কেউ অর্ডার না শুনলে গুলি করা- এই অসভ্যতা ও বর্বরতার শেষ নেই যেন।
মিয়ানমারের সাতাশ বছরের এক তরুণ সামরিক বাহিনীর নির্বাচনী পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে যোগদান কারার জন্য অপেক্ষায় ছিল। তার ইচ্ছে ছিল সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা হবে। সে আক্ষেপ করে বলেছে- এখন একাজে ঘৃণা জন্মেছে। আর সেসেনাবাহিনীতে যোগদান করবে না।
সেনাপ্রধান মিন অং হ্লেইং অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করার পর সুচির ঘনিষ্ঠ পুলিশ সদস্যরা ভারতে পালিয়ে গেছে। পালিয়েছে অনেক সরকারী কর্মকর্তারাও। তাদেরকে এসময় জোর করে দেশে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করা হলে আত্মহত্যা করবে বলে হুমকি দিয়ে রেখেছে তারা। হ্লেইং এখন নতুন ফন্দি এঁটে বলছেন দ্রুত নির্বাচন দিয়ে তিনি গণতন্ত্রকে সুরক্ষা করবেন। একদিকে বুলেট দিয়ে নিরীহ মানুষ হত্যাযজ্ঞ চালানো-অন্যদিকে গণতন্ত্র সুরক্ষার কথা বলার মত জান্তা ও তার পরিবারের জন্য অসহায় আন্দোলনকারীরা ‘সামাজিক শাস্তির’ যৌক্তিক দাবি তুলেছেন বলে মনে হয়।
এখন মিয়ানমারে থেকে যারা আন্দোলন করছেন তারাও বলছেন আত্মত্যাগ করার কথা। তারা অভিমত দিচ্ছেন- এমন কষ্টময় জীবনের কোন ভাল ভবিষৎ নেই। এ নিয়ে বেঁচে কি লাভ? এজন্য কারফিউ মানছে না তারা। এ বিপ্লবে তারা জয়ী হতে চায়। এজন্য তাঁরা অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছেন দেশের গণতন্ত্রের জন্য, মুক্ত জীবনেরজন্য, সামগ্রিক অধিকার লাভের জন্য নিজের ও পরবর্তী প্রজন্মের মুক্ত ভবিষ্যতের কথা ভেবে। পাশাপাশি বিতাড়িত রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে নিজ দেশে ফেরার বিষয়টি অর্ন্তভুক্ত করে সকল রোহিঙ্গা যবুকদেরকে এই আন্দোলনে শরীক করে নেবার উদারতা দেখাতে হবে।
আন্দোলনকারীগণ ভাবছেন- একটি ব্যাপক ‘সামাজিক শাস্তি’ প্রক্রিয়া চালু না হলে জান্তাদের অপতৎপরতা সমূলে উৎপাটন করা সম্ভব হবে না। শুধু মিয়ানমারেই নয় বরং ‘সামাজিক শাস্তি’ প্রক্রিয়া চালু হবার মাধ্যমে অবৈধ সামরিক কায়দায় নিরীহ মানুষ হত্যাকারী ও তাদের দোসরদের উৎপাটিত করে বিশ্বব্যাপী নিপীড়িত জনগণের সার্বিক অধিকার ফিরে আনতে হবে তাবৎ মুক্তিকামী তরুণদেরকে।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।
এইচআর/জেআইএম