কঠোর অবস্থান আর কবে?
দেশের কয়েকটি স্থানে হেফাজতে ইসলাম নামের একটি সংগঠনের সমর্থকরা রীতিমতো রণক্ষেত্র বানিয়ে ফেলেছে। তিন দিনের সংঘাত-সংঘর্ষে চট্টগ্রামের হাটহাজারী এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১০ জনের নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সাংবাদিক, পুলিশসহ আহত হয়েছেন অনেকেই। জেফাজতে ইসলাম এবং কিছু বামপন্থি সংগঠন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করে প্রতিবাদের নামে পুলিশের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ায় দেশে শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ২৮ মার্চ হেফাজতে ইসলাম সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দিয়ে এটা প্রমাণ করেছে যে, তারা সহজে নিবৃত্ত না হয়ে পানি আরো ঘোলা করতে চায়। তাদের কোনো বড় লক্ষ্য ও পরিকল্পনা আছে। তাদের পেছনে সরকারবিরোধী অন্য সব রাজনৈতিক শক্তির নেপথ্য মদদের বিষয়টিও আলোচনায় আছে। হেফাজতের কাঁধে বন্দুক রেখে অন্য কেউ ট্রিগার টিপতে চাইছে কিনা, সেটা দেখা দরকার।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘সংঘাতের ঘটনাসহ যা ঘটেছে, তা পরিকল্পিত ভারতের প্রধানমন্ত্রী না এলেও এমন ঘটনা ঘটতো’। প্রশ্ন হলো, সরকার যদি আগেই এটা জানতো যে হেফাজত একটি পরিকল্পনা নিয়েই অগ্রসর হচ্ছে এবং নরেন্দ্র মোদি না এলেও এমন ঘটতো, তাহলে এমন ঘটনা প্রতিরোধে আগাম ব্যবস্থা কেন নেওয়া হয়নি? কেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হেফাজতের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ দিয়ে তাদের মুখের কথায় বিশ্বাস রাখলেন যে, তারা কিছু করবে না?
দুষ্টের ছলের অভাব হয় না। হেফাজতে ইসলাম নামের সংগঠনটি যে ‘দুষ্ট' কাজে পারঙ্গম এটা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভুলে গেলেন কী করে? এরা শাপলা চত্বরে কী করেছিল তা তো অন্তত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাওয়ার কথা নয়। কিছুদিন আগেই হেফাজত বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যবিরোধী যেসব হুংকার দিয়েছে, তা-ই বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভুলে থাকেন কীভাবে? শাল্লার ঘটনার পর অনেকেই তো বলেছেন যে, হেফাজতের প্রতি নমনীয়তার বড় খেসারত সরকারকে নিতে হবে। কারো সতর্কবার্তা কানে না তোলার একটি ব্যাধি ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের অনেকের মধ্যেই রয়েছে। মোদি বাংলাদেশে নিজের ইচ্ছায় আসেননি। তাকে বাংলাদেশ সরকার আমন্ত্রণ জানিয়ে এনেছে। উপলক্ষ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা। মোদি আসবেন – এই খবর প্রচারের পর কিছু মহল তার বিরোধিতা করতে থাকে। তাকে আসতে দেওয়া হবে না বলেও এই মুখচেনা মহল গরম গরম কথা বলেছে। তখন সরকার কি করেছে? ওরা তো ধরেই নিয়েছিল যে সরকার তাদের কিছু করবে না। তারা নিজেদের সরকারের চেয়েও শক্তিমান মনে করে। কারণ এর আগে সরকার নানা সময় তাদের প্রশ্রয় দিয়েছে।
আমাদের দেশের অতি সাধারণ একজন মানুষও এটা জানেন যে, দুধ কলা দিয়ে সাপ পুষতে নেই। কারণ সাপের ধর্ম ছোবল মারা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগকে হেফাজতের মতো বিষধর একটি সাম্প্রদায়িক শক্তি কী চোখে দেখে সেটা যদি আওয়ামী লীগ এবং সরকারের নীতিনির্ধারকরা না বুঝে থাকেন, তাহলে আসলে আর কিছু বলার থাকে না। হেফাজত এখন তার শক্তি দেখাতে শুরু করেছে এবং এই সংগঠনের নেতারা সরকারের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধে' নামার প্রকাশ্য ঘোষণা দিতেও দ্বিধা করছে না। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে সরকার দেনোমনো ভাব দেখাচ্ছে।
একজন কার্টুনিস্ট, একজন লেখক বা সরকারের কোনো নীতির সঙ্গে একমত হতে না পারা একজন অসংগঠিত মানুষকে ধরে নিয়ে বিনাবিচারে মাসের পর মাস কারাগারে রাখতে সরকারের যে সব অতি উৎসাহী কর্মকতা বা কর্মকর্তারা ভুল করেন না, তারা হেফাজতের মতো উগ্রবাদীদের ব্যাপারে চুপ থাকেন কোন মনের জোরে, সেটা সত্যি বুঝতে কষ্ট হয়। যেখানে গরম হওয়া দরকার সেখানে নরম আর যেখানে নরম হওয়া দরকার সেখানে গরম – এই ধারা অব্যাহত থাকলে সেটা সরকারের জন্য সুখের হবে বলে মনে হয় না।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘আগে যে জঙ্গি সংগঠনগুলো সন্ত্রাস-নৈরাজ্য সৃষ্টি করার জন্য প্রয়াস পেয়েছিল, তারাই এখানে আবার নতুনভাবে সম্পৃক্ত হয়েছে বলে আমাদের মনে হয়েছে। সবকিছু খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যে যেখানে থাকুক, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না'। মন্ত্রীর এই বক্তব্যে কতজন আশ্বস্ত হয়েছেন, আমি জানি না। তবে ‘কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না'-এই বাক্যটি শুনে যে অনেকেই কৌতুক বোধ করেন, সেটা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি। কাউকে কাউকে ছাড় দেওয়া এবং কাউকে কাউকে ছাড় না দেওয়া যে একটি অঘোষিত নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা বুঝতে পারা যায় চোখকান একটু খোলা রাখলেই।
২৮ মার্চ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘স্বার্থান্বেষী মহল এতিম ছাত্র ও শিশুদর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে রাস্তায় নামিয়ে সরকারি সম্পত্তিসহ জনগণের সম্পদ ও রাজনৈতিক নেতাদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগসহ নানা ধরনের অপকর্মে নিয়োজিত করায় প্রাণহানির মতো ঘটনা ঘটছে। তাছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অসত্য, গুজব ছড়িয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করা হচ্ছে। এসব গুজব রটনাকারীসহ আইন অমান্য করে শান্তি-শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে'।
বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়েছে, ‘কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তি ও গোষ্ঠী ধর্মীয় উন্মাদনায় চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলায় এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর, সরাইল ও আশুগঞ্জে সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করেছে, যার মধ্যে উপজেলাপরিষদ থানা ভবন, সরকারি ভূমি অফিস, পুলিশ ফাঁড়ি, রেলস্টেশন, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বাড়িঘর, প্রেসক্লাবসহ জানমালের ক্ষয়ক্ষতি করে যাচ্ছে'।
এই বিজ্ঞপ্তি পড়ে কী মনে হয়? যারা মানুষের জীবন ও সম্পদ বিনষ্টের মতো মারাত্মক অপরাধ সংঘটিত করছে তাদের বিরুদ্ধে সরকার কি শক্ত অবস্থানে আছে? থাকলে আইনি ব্যবস্থা নিতে বিলম্ব কেন? কারা প্রকাশ্যে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন, কারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অসত্য ও গুজব ছড়াচ্ছে, সেটা কী সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর অজানা? প্রশ্ন হচ্ছে, জেনেশুনেও কেন এক ধরনের কালক্ষেপ করার কৌশল নেওয়া হচ্ছে?
মোদি বিরোধিতার নামে আসলে যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রধান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিরোধিতায় নেমে চরম ঔদ্ধত্য দেখানো হচ্ছে – এটা বুঝতে যত দেরি করা হবে, দেশের সামনে ততই বিপদ বাড়বে। একটি বিষয় এখন পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। সেটা হলো, দেশে কী বঙ্গবন্ধুর অনুসারী সংখ্যা বেশি, নাকি হেফাজতের সমর্থক বেশি? আওয়ামী লীগের মধ্যে হেফাজত অনুসারীর সংখ্যা কি বঙ্গবন্ধুর সমর্থকের চেয়ে বেশি? বাইরে মুজিব কোট, অন্তরে ‘হেফাজত' এমন ব্যক্তি কি আওয়ামী লীগে নেই? বিভিন্ন স্থানে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল, ছবি ভাঙচুরের ঘটনা থেকে কিন্তু যে কারো এটাই মনে হবে যে, দেশে হেফাজতের সংখ্যাই বেশি।
তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সরকারের নমনীয় মনোভাবকে দুর্বলতা না ভাবতে বলেছেন। সরকারকে দুর্বল না ভাবলেও সরকারের নমনীয়তা নিয়ে ভাবনার কারণ তো একের পর এক ঘটেই চলেছে। কার প্রতি কখন নমনীয় হতে হবে আর কখন কাকে কঠোরতা দেখাতে হবে, সেটা কী সরকার স্পষ্ট করতে পেরেছে? বিশৃঙ্খলা রোধে সরকারর কঠোরতা এখন পর্যন্ত কথায় সীমাবদ্ধ আছে।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
এইচআর/জেআইএম