স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে সুনামগঞ্জের শাল্লা
সারাদেশের মানুষ যখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বর্ষ আর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর উৎসবে মাতোয়ারা তখন সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের চোখে জল। সেখানকার একটি হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামে হামলা ভাঙচুর ও লুটপাট চালিয়েছে কয়েক হাজার মানুষ। হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হককে নিয়ে এক হিন্দু ব্যক্তির স্ট্যাটাস দেয়ার জের ধরে কয়েক হাজার সহিংস মানুষ বুধবার সকালে নোয়াগাঁও গ্রামে হামলা চালায়। এ সময় গ্রামটির চার থেকে পাঁচশ ঘরবাড়িতে ভাঙচুর, লুটপাট চালিয়েছে হামলাকারীরা।
বছরটি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর, বছরটি বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বর্ষ হিসেবে উদযাপিত হচ্ছে। বাংলাদেশ মাত্র কিছুদিন আগে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের পথে যাত্রা করার জন্য জাতিসংঘের সুপারিশও পেয়েছে। গত ১২ বছরে দেশে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দ ‘উন্নয়ন’। কিন্তু অন্ধকারের শক্তির এমন আস্ফালনের পর নব প্রজন্মের কাছে প্রশ্ন দাঁড়ায় - স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অর্থ তাহলে কী?
একবার নয়,দু’বার নয়। স্বাধীনতা বিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তি ও তাদের দোসররা নিয়মিত বিরতিতে এমন ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনে আয়োজিত ১০ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেছেন, স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি সম্পর্কে দেশবাসীকে সতর্ক হতে হবে, কারণ, তারা দেশের অর্জনকে ব্যর্থ করতে চাচ্ছে।
রামু, নাসিরনগর, লালমনিরহাট, ভোলাসহ অসংখ্য ঘটনার পর এবার গানের জনপদ সুনামগঞ্জ। একটার পর একটা ঘটনা গোটা দেশকে নাড়িয়ে দেয়। স্বাধীনতার পর এতগুলো বছর, এতগুলো জমানা, এতগুলো প্রকল্প পেরিয়ে এই দৃশ্য দেখতে হবে আমাদের যখন মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল ক্ষমতায় টানা তৃতীয়বারের মত?
তবে কি বলব উন্নয়ন হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু আমরা যাত্রা করছি অন্ধকারের পথে? না হলে অন্ধকারের শক্তির প্রতি সব পক্ষের এত নতজানু মনোভাব কেন? পুলিশ সেই যুবককেই গ্রেফতার করেছে, কিন্তু যারা লুটপাট করল তাদের কিছুই করল না এখনও। ক্ষমতাসীন দলও কেমন নিরব দর্শক।
জানি আবারও বলা হবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে, মন্ত্রীরা তদন্তের নির্দেশ দিবেন, কড়া ব্যবস্থার আশ্বাস পাওয়া যাবে, টকশো হবে, সোশ্যাল মিডিয়ায় চিৎকার হবে। এরপর আবার এমন একটা কিছু ঘটবে অন্য কোথাও, অন্য কোন সময়ে।
দেশটা সবাই মিলে স্বাধীন করেছিলাম। এখন শুধু আমরা আর ওরা’র গল্প। হিন্দুরা শুধু ‘ওরাই’ হয়ে যাচ্ছে কেবল। হয়তো এক সময় আমরা ভুলে যাব এই জুলুমের কথা, এই বে-ইনসাফের কথা। কিন্তু নিকষ কালো অন্ধকারের যে রং-টা দেখা গেল সেটি কি ভুলবে এই দুর্ভাগা এলাকার দাওয়ায় বসে থাকা সেই মায়েরা যাদের সামনে তাদের সংসার পুড়লো, সন্তানেরা লাঞ্ছিত হল? যে মা তার কোলের শিশুকে বাঁচাতে প্রাণপন ছুটেছে সে কি ভুলবে কখনও এই দুঃসময়?
কি এক কারণে স্বাধীনতা যেন হয়ে গিয়েছে শুধু তাদের যারা আসলে দেশটাকে চায় নি। এরা টেলিভিশনে এসে দম্ভ ভরে বলে যায় জাতীয় সঙ্গীত মানে না। এরা জাতির পিতা মানে না। সুনামগঞ্জের শাল্লা গ্রামে এই হামলার পেছনে রাজনীতি আছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বর্ষের অনুষ্ঠানে আসবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। হেফাজতের মামুনুল আর বাবু নগরী হুমকি দিয়েছে তারা মোদিকে প্রতিহত করবে। সেটা তারা পারবে না, কিন্তু দেশের ভেতরে অস্থিরতা তৈরিতে যে তারা পারঙ্গম সেটা বুঝিয়ে দিল আরও একবার। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়িয়ে পরিস্থিতি তাতিয়ে দেওয়ার কৌশল এটি।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর সবচেয়ে বড় দুঃখ এই যে- এক সময় আওয়ামী লীগ নিজে এবং দেশের প্রগতিশীল বাম রাজনৈতিক শক্তি যতখানি সংগঠিত ভাবে মানুষকে সচেতন ও প্রগতিমুখী করার কাজ করেছিল, সেই শক্তিতে বেশ ঘাটতি চলে এসেছে। সেই দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে বিভেদকামী রাজনীতি। বর্তমানে বাম রাজনীতির কণ্ঠ ক্ষীণ। আর আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক চর্চা ছেড়ে মত্ত আছে ক্ষমতার চর্চায়, পাড়ায় পাড়ায়, জেলায় জেলায় আধিপত্য বিস্তারের মহড়ায়।
উদার অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি চর্চা যাদের করার কথা তাদের ভেতর থেকে চিন্তাশক্তির ক্ষয় যে ঘটছে তার প্রমাণ বারবারই পাচ্ছি আমরা। মৌলবাদী শক্তিই এখন সব রাজনীতির হাতিয়ার। যারা সাম্প্রদায়িকতাকে রুখবে তারাই যদি চুপ থাকে কিংবা ছলেবলে কৌশলে মৌলবাদী শক্তির তাবেদার হয়ে ওঠে, তখন তা ভয়ের কারণ হয়। বিশেষত, আমাদের মতো দেশে, যেখানে ছোট্ট এক ভূখণ্ডে বিশাল জনসংখ্যা। মানুষের ভিতরে ঘুমিয়ে থাকা সাম্প্রদায়িক সহিংস মনোভাবকে জাগানোর কাজ করছে রাজনীতি। জঘন্য কুরুচিকর ভাষায় চলে এদের প্রচার। একটা বড় জিজ্ঞাসা আমাদের মনে উকি-ঝুঁকি মারে – স্বাধীনতার ৫০ বছরে সাধারণ মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা কি তবে এটাই যে তাদের আবার এই পরাজিত শক্তির আস্ফালন দেখতে হবে অসহায় ভাবে?
উন্নয়ন নিশ্চয়ই রাজনীতির বাইরের বিষয় নয়। উন্নয়নকে এগিয়ে নিতে হলে সাম্প্রদায়িক সংগঠনকে কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়া উপায় নেই। না করলে তারা দেশজুড়ে আগুন লাগাবে। স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে প্রত্যাশা - সংসদ ভবনকে যেভাবে মুড়ে ফেলা হলো আলোয় আলোয় একাত্তরের মতো তেমন অসাম্প্রদায়িক আলোর স্বপ্ন আবার বিলি হবে অকাতরে দেশব্যাপী।
এইচআর/এমএস