ক্রিস্টাল মেথ বাজারে দুশ্চিন্তার ভাঁজ কপালে
প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
১৮৮৭ সালে মারাত্মক সব ড্রাগের ওপর গবেষণা ও উৎপত্তি হয়েছিল জার্মানিতে। যুদ্ধবিমান চালকদের সারাক্ষণ নির্ঘুম রাখতে তারা নিজেদের সৈন্যের সাথে জাপানিজ পাইলটদেরও কড়া ড্রাগ ব্যবহারে উৎসাহিত করে। সে সময়ে আবিষ্কৃত হয় ক্রিস্টাল ড্রাগ। পরে এর নাম পরিবর্তিত হয়ে কোথাও ক্রিস্টাল মেথ, কোথাও আইস, এক্সথেসি, কোথাও ‘ম্যাড-ড্রাগ’ এবং এলাকাভেদে নানা ছদ্মনামে এর ব্যবহার চালু থেকে যায়।
১৯৬০ সালে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এর ব্যবহার শুরু হয়ে যায়। এরপর উত্তর আমেরিকার যুবকদের হাতে কোনোভাবে পৌঁছে গেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭০ সালে এটাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এরপর ১৯৯০ সালে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ক্রিস্টাল ড্রাগ ঢুকে পড়ে। ২০১০ সালে অস্ট্রেলিয়া হয়ে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, লাওস, চীন, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার হয়ে বাংলাদেশে এর ব্যবহার শুরু হয়। দাম অনেক বেশি হওয়ায় আমাদের দেশে সে সময় সাধারণের মাঝে এর ব্যবসা জমে ওঠেনি।
////////////////ভারতেও একই কারণে ক্রিস্টাল মেথের ব্যবসা জমে উঠেনি। বছর তিনেক আগে কোলকাতার এক নববর্ষের কনসার্ট অনুষ্ঠানে বিখ্যাত ড্রাগ ব্যবসায়ী ‘পেড্রো’ ১৪ গ্রামের ২৪টি এক্সথেসি কিউব (লজেন্স/ক্যান্ডি) নিয়ে ধরা পড়েছিলেন। তার আসল নাম হেনরী লরেন্স। তিনি হিমালয়ের কুলু থেকে দিল্লী হয়ে কোলকাতার অনুষ্ঠানে আসছিলেন। গোয়েন্দাদের কাছে তিনি ‘পেড্রো’ নামে পরিচিত। তার নিকট থেকে ক্যান্ডি সদৃশ এসব ‘ম্যাড-ড্রাগ’ উদ্ধার করে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ক্যান্ডির মাধ্যমে এই নেশা ছড়ানোর কাজ করতেন। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা ছিল তার টার্গেট। এভাবে ভারত, বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে বাজার তৈরির চেষ্টা করেছেন। পর্যটক বেশি হওয়ায় থাইল্যান্ডে তিনি বেশি সফল হন।
সম্প্রতি ইয়াবা ব্যবসায় সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ শুরু হলে বাংলাদেশে নতুন পন্থায় ক্রিস্টাল মেথ বাজারে চালু হতে থাকে। ইয়াবার চেয়ে ৫০ গুণ বেশি ক্ষতিকর এই ড্রাগ এখন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার কর্মীদের কপালে শুধু দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলে দেয়নি। তাঁদের দুশ্চিন্তা অনেকের কপালে বলিরেখায় রূপ নিয়েছে। কারণ আমাদের বাজারে ঢুকে পড়েছে নতুন মাদক ক্রিস্টাল মেথ বা আইস। এটা জীবনসংহারী উচ্চমাত্রার ক্ষতিকর মাদক।
আমরা জানি ইয়াবা, হেরোইন ইত্যাদি আফিমের বাই-প্রোডাক্ট। সেটাকে আরো প্রসেস করে ক্রিস্টাল মেথ তৈরি করা হচ্ছে। এর ক্রিয়া বেশি, ক্ষতি বেশি, দামও বেশি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭০ সালে এটাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার কারণ ছিল উঠতি বয়সের ছেলেমেয়রা দ্রুত এর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়াশুনায় ফাঁকি দিতে শুরু করে এবং বাবা-মায়ের অর্থ সটকাতে থাকে। খুব দ্রুত ১০০ গুণ বেশি উত্তেজনা তৈরি করায় সেবনকারীদের চেহারা বিকৃত হয়ে জঘন্য রূপ ধারণ করতে থাকে।
ক্রিস্টাল মেথ বা আইসের ক্ষতিকর দিকগুলো খুব ভয়ংকর। উন্নত পদ্ধতিতে প্রসেস করে অতি উচ্চমাত্রার মাদক সঞ্জাত দ্রব্য এটি। ফলে এটি সেবনে অনিদ্রা ও অতি উত্তেজনা তৈরী হয়। এর ফলে স্মৃতিভ্রম ও মস্তিষ্ক বিকৃতি, স্ট্রোক, হৃদরোগ, কিডনী, লিভার নষ্ট হয। দাঁত ক্ষয়, অতিরিক্ত ঘাম, চুলকানি, রাগ ও আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি হয়। একজন সেবনকারী বলেছেন, রাগ-ক্ষোভ থেকে অন্যকে খুন করার ইচ্ছে করে। এছাড়া স্বাভাবিক যৌন ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়।
ক্রিস্টাল মেথ বা আইস তৈরির জন্য গভীর বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের প্রয়োজন হয় না। একজন অপারেটর একবার এ মাদক তৈরির পদ্ধতিটি পর্যবেক্ষণ করার পর মেশিনের মধ্যে সে অনুযায়ী শুধু কেমিক্যাল কম্পোজিশন অদল-বদল করে দিলেই বেরিয়ে আসে ইয়াবার মত মারাত্মক ড্রাগ। সেটা রপ্ত করা যে কেউই আরেকটু মনযোগী হয়ে সেসব মেশিন চালনায় দক্ষ হলে মারাত্মক একট্যাসি বা ক্রিস্টাল মেথ বা আইসের মত মাদক উৎপাদন করার দক্ষতা অর্জন করে ফেলতে পারে। যার রাসায়নিক নাম ‘মিথাইলডিঅক্সিমেথামফেটামিন’।
বাংলাদেশে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ক্রিস্টাল মেথ বা আইস নিয়ে বেশ তটস্থ হয়ে পড়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। তখন এর এশীয় অঞ্চলের ডিলার হিসেবে খ্যাত নাইজেরীয় নাগরিক আজাহ আনাত্তুচাওয়া অরিয়েনকে ঢাকার বারিধারা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এজন্য ভাটারা থানায় মামলা হয়। তবে এ ব্যাপারে গবেষকগণ বেশি কিছু জানতে পারেননি।
কখনও লবণের দানার মত দেখতে, কখনেও চিনি বা মিসরির মত শক্ত খামিরের মত ক্রিষ্টাল মেথ বা আইসের সন্ধান পাওয়া গেছে। প্রথম দর্শনে এগুলোকে কখনই মাদকদ্রব্য মনে হয় না। ক্যান্ডি বা লজেন্সের মত চুষে খেতে খেতে একসংগে পথ চললেও কারো সন্দেহ করার উপায় নেই। তাইতো ২০১৮ সালে বিখ্যাত ড্রাগ ব্যবসায়ী ‘পেড্রো’ ১৪ গ্রামের ২৪টি এক্সথেসি কিউব (লজেন্স/ক্যান্ডি) নিয়ে কোলকাতার কনসার্টে হাজির হতে পেরেছিলেন।
কাঁচের পাইপে ক্রিস্টাল মেথের ধোঁয়া নিয়ে নেশা করার চাইতে ইন্জেকশনের মাধ্যমে সেবনে মাত্র ৩০ সেকেন্ডে শরীরে এর কার্যকারিতা শুরু হয়। ফলে বর্তমানে ইঞ্জেকশন পদ্ধতি বেশি জনপ্রিয় হতে চলেছে।
বাংলাদেশ এখন মাদক ভোক্তা চাহিদার বিরাট চারণভূমি। সরকারি হিসেবে দেশে ৩৬ লক্ষ মাদক ব্যবহারকারী থাকলেও বেসরকারী হিসেবে এ সংখ্যা ৭০ লক্ষের উপরে। এত বড় মাদকের বাজারে বিশ্বের নামী-দামী মাফিয়াদের নজরদারী রয়েছে এদশে। আছে অবৈধ অস্ত্র ও সোনার ব্যবসা। সহযোগিতায় আছে দেশীয় অনৈতিক ব্যবসায়ী ও অসৎ কর্মচারীর বিরাট চক্র। যারা ঘুষ-দুর্নীতির অর্থকে হারাম জ্ঞানে মনে-প্রাণে ঘৃণা ও বিশ্বাস করে না।
এদের অসৎ তৎপরতায় অকালেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে আমাদের নবীন প্রজন্মের মেধা ও বিষিয়ে উঠছে মনন। সারা পৃথিবীতে আজ মগজের শুন্যতা বিরাজ করতে শুরু করলেও বাংলাদেশে এটা বেশি লক্ষ্যণীয়। কারণ মেধাহীনরা ভেজাল ও নকলবাজ হয়। চুরি, দুর্নীতিতে দ্রুত জড়িয়ে পড়ে। অসততাকে পুঁজি করে অবৈধ পন্থায় দ্রুত ধনী হতে দৌড়ঝাঁপ করে।
এভাবে লাগামহীন মাদকের প্রভাবে আমাদের তাজা মানুষগুলো দিন দিন অথর্ব হয়ে যাচ্ছে। জ্ঞান ও বিবেক হারিয়ে নিজেদের যে কোন দায়িত্বে চরম অবহেলা করছে। অতি মুনাফা লাভের আশায় পারস্পরিক অসহযোগিতার ফলে করোনার মত বৈশ্বিক মহামারি মোকাবেলা করতে গলদঘর্ম হচ্ছে। একদল মানুষ ক্রিস্টাল মেথ, আইস বাজারে ছেড়ে দিয়ে চুড়ি পরে নিশ্চিন্তে আরাম কেদারায় বসে আদেশ করছে, আরেকদল মানুষ দুশ্চিন্তার ভাঁজ কপালে নিয়ে হতাশায় দিন গুজরান করে চলেছে। এ অবস্থা চলতে দেয় যায় না। কারণ, এভাবে ক্রমাগতভাবে সুস্থ মগজ বিগড়িয়ে গিয়ে মানুষ অথর্ব হতে থাকলে পৃথিবী নিশ্চল হতে দেরি নেই!
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।
এইচআর/জিকেএস