ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

আজকের ৭ মার্চের প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের বাস্তবতা

ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল | প্রকাশিত: ১০:০৯ এএম, ০৭ মার্চ ২০২১

৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর প্রথম বিপ্লবের সাক্ষ্যবহ। বাংলাদেশকে স্বাধীন করায় বঙ্গবন্ধুর দুই যুগের যে পথ পরিক্রমা তার ঘটনাবহুল ক্যালেন্ডারে সর্বশেষ ল্যান্ডমার্ক এই তারিখটি। এ দিন ঐতিহাসিক রেসকোর্সে লাখ লাখ মানুষের জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু ডাক দিয়েছিলেন চূড়ান্ত অসহযোগ আর মুক্তির সংগ্রামের। একাত্তরের রক্তঝড়া নয়টি মাসে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত আর তিন লাখ বীরাঙ্গনার সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের পথ বেয়ে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পথচলা মোটেও মসৃণ ছিল না।

এদেশটি ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সৃষ্টি। এই দেশের নাম, এর জাতিয় স্লোগান এমনকি জাতীয় সঙ্গীতটি পর্যন্ত তার নির্ধারণ করা। তার প্রথম বিপ্লবের ফসল স্বাধীন বাংলাদেশকে তিনি একেবারে অঙ্কুর থেকে সযতেœ লালন করে মহিরুহুতে পরিণত করেছিলেন। এই প্রক্রিয়ায় তিনি অসন্তোষভাজন হয়েছিলেন পৃথিবীর অধিকাংশ ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর। একাত্তরে পাকিস্তান ছিল পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম সামরিক শক্তি। সার্বক্ষণিক ইসরায়েলি হুমকি-ধামকির মধ্যে থাকা মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো পাকিস্তানকে দেখতো তাদের অন্যতম খুঁটি হিসেবে।

চীনের কাছে দেশটি ছিল চির বৈরী ভারতকে শায়েস্তায় রাখার অন্যতম করিডোর আর চীনের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে ‘পিংপং ডিপ্লোমেসি’ তার কেন্দ্রবিন্দুতেও ছিল পাকিস্তান। কাজেই বাংলাদেশের কাদামাটিতে পাকিস্তানের ভড়াডুবি এদের কারও কাছেই স্বস্তিদায়ক ছিল না। শুরু থেকেই তারা বঙ্গবন্ধু আর বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশকে অকার্যকর আর ব্যর্থ প্রমাণে সচেষ্ট ছিল।

স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদা প্রাপ্তি, জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ কিংবা ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি, এত কিছুর পরও বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে প্রাণ দিয়ে এসব বিরাজভাজন শক্তির অসন্তোষের মূল্য দিতে হয়েছিল। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের সেই কালো রাতে গুটিকয়েক সেনা কর্মকর্তাকে আমরা সামনে দেখেছি। নেপথ্যে ছিল আরও অনেকে আর ছিল এসব বৈরী শক্তিগুলো, যাদের বেশিরভাগই স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর।

বঙ্গবন্ধু তার প্রথম বিপ্লবটি সফল করে যেতে পেরেছিলেন। সময় পাননি দ্বিতীয় বিপ্লবের সফল বাস্তবায়নের। বঙ্গবন্ধুর দর্শন ছিল এমন একটি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা যেখানে থাকবে সমাজতন্ত্র আর শোষিতের গণতন্ত্র। বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্র ছিল মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন আর মাওসেতুংয়ের সমাজতন্ত্রের চেয়ে ভিন্ন ধারার। তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের সমাজতন্ত্র হবে দেশজ ও গণতান্ত্রিক সমজাতন্ত্র। আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। জনগণ যাদের নির্বাচন করবে তারাই সরকার চালাবে। শক্তির উৎস বন্দুকের নল নয়। শক্তির উৎস হলো জনগণ’। পাশাপাশি তার শোষিতের গণতন্ত্রের অন্যতম ভিত্তি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সেটিও ছিল লেনিন কিংবা কামাল আতাতুর্কের ধর্মনিরপেক্ষতার চেয়ে একেবারেই অন্যরকম।

১৯৭২-এর ৪ নভেম্বর জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে, বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে। কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের আপত্তি শুধু এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না’।

১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের যে ভূমিধস বিজয় তার ম্যান্ডেট ছিল পাঁচ বছরের। তারপরও স্বাধীন দেশে ৭৩’এ আরেকটি জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে তিনি তার সেই ম্যান্ডেটটি পুনরায় যাচাই করে নিয়েছিলেন। জাতীয় সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে এককভাবে যে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার সাংবিধানিক বৈধতা ছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের। তারপরও তার দ্বিতীয় বিপ্লবের স্বপ্ন বাস্তবায়নে তিনি সাথে নিয়েছিলেন স্বাধীনতার সপক্ষের প্রতিটি রাজনৈতিক দল এবং শক্তিকে।

‘বাকশালের বাংলাদেশে’ নির্বাচন নিষিদ্ধ হয়নি, নিষিদ্ধ হয়নি মত প্রকাশের স্বাধীনতাও। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় নির্বাচনী প্রচারণায় সমান সুযোগ ছিল প্রত্যেক নির্বাচনী পদপ্রার্থীর আর সেই সুযোগে নেতাকে পরাজিত করে নির্বাচিত হয়েছিলেন স্কুল শিক্ষকও। জেলা গভর্নরদের নেতৃত্বে শক্তিশালী স্থানীয় সরকার আর উপজেলা পর্যায়ে বিকেন্দ্রীকৃত আইন অবকাঠামোর সুফল যদি পঁচাত্তরে বাংলাদেশ পেত, তাহলে গ্রামকে শহর দেখার জন্য আমাদের যেমন এখনও অপেক্ষায় থাকতে হতো না, তেমনি উন্নত দেশের স্বীকৃতি পেতে আমাদের অপেক্ষার প্রহর গুনতে হতো না ২০৪১ অবধি।

আজ যখন আবার সঠিক পথে বাংলাদেশ তখন আবারো সক্রিয় বাংলাদেশ বিরোধী শক্তি। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে এদের আমরা বিভ্রান্তি ছড়াতে দেখেছি গত বছরের শেষ দিকে, ঠিক যেমন এদের পূর্বসূরিরা ছিয়াত্তরের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্সে দাবি তুলেছিল বাংলাদেশের নাম, জাতীয় পতাকা আর জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের। এরাই কদিন আগে ভ্যাকসিন বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে আর এখন পদক বাতিলের তথাকথিত প্রতিবাদের ধুয়া তুলে হামলে পড়ছে পুলিশের ওপর। আল জাজিরার প্রতিবেদনটি দেখুন। দেখবেন পাশ্চাত্য আর মধ্যপ্রাচ্যের কি সুনিপুণ যৌথ প্রযোজনা, সাথে গুটিকয়েক বাংলাদেশী দালাল। ঠিক যেন পঁচাত্তরের ঘৃণ্য নাটকটির ক্ষুদ্র মঞ্চায়ন।

নির্মূল কমিটির সাম্প্রতিক এক ওয়েবিনারে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আহ্বান জানিয়েছেন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে শুধু নিজেদের গৌরবগাথা প্রচার না করে আমরা যেন পাশাপাশি পাকিস্তানিদের সাথে তাদের এদেশীয় দোসরদের একাত্তরের বর্বরতার কথাগুলোও তুলে ধরি।

৭ মার্চকে সামনে রেখে আজ যখন পাকিস্তানি হাইকমিশনারকে দেখি দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতাদের সাথে বৈঠকে বসতে আর ঐসব নেতাকে দেখি দুই দেশের ঐতিহাসিক সম্পর্ককে সুদৃঢ়তর করার যুক্তিতে মুখে খৈ ফোটাতে, তখন বড্ড বেশি বিবমিষা হয়। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত দ্বিতীয় বিপ্লবের বাস্তবায়নটা যে কতটা জরুরি সে কথাটা খুব বেশি মনে পড়ে।

লেখক : চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।

এইচআর/ফারুক/এমএস