ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

প্রয়োগের চেয়ে অপপ্রয়োগ যখন বেশি হয়

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা | প্রকাশিত: ১০:১৪ এএম, ০৬ মার্চ ২০২১

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (আইসিটি) মামলায় কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরকে ছয় মাসের জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট। বুধবার এ খবরটি ফেসবুকে আনন্দের সাথে শেয়ার করেন লেখক, কবি, সাংবাদিক ও সংস্কৃতি কর্মীরা। প্রায় সবার ধারণা কারাগারে লেখক মুশতাকের মৃত্যুর পর সারাদেশে যে তোলপাড় হয়েছে সে কারণেই কিশোরের জামিন হয়েছে, অন্যথায় হতো না।

২০২০ সালের ৫ মে র‌্যাব-৩, সিপিসি-১ এর ওয়ারেন্ট অফিসার মো. আবু বকর সিদ্দিক বাদী হয়ে ১১ জনের নামে রমনা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এ মামলা করেন। এছাড়াও মামলায় অজ্ঞাত আরও ৫/৬ জনকে আসামি করা হয়। ওই রাতে করোনাভাইরাস নিয়ে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে কার্টুনিস্ট কিশোর ও লেখক মুশতাক আহমেদকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। মামলার আসামি লেখক মুশতাক আহমেদ গত ২৫ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে মারা যান।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি পাসের সময় সাংবাদিক, লেখক, মানবাধিকার কর্মীসহ বিভিন্ন মহল থেকে আশঙ্কা করা হয়েছিল যে, এই আইনের অপপ্রয়োগ হবেই। গত দুই বছরে এই অপপ্রয়োগের অংসংখ্য নমুনা আমরা দেখেছি। তবে লেখক মুশতাকের মৃত্যু এই আইনটি কতটা খারাপ ভাবে কিছু কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী ব্যবহার করছে তার দৃষ্টান্ত নতুন করে সামনে নিয়ে আসল।

এই আইনে মামলা হলেই গ্রেফতার এবং তা অজামিনযোগ্য। পুলিশের একজন এস আই-কে এমন ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে যে, তার সন্দেহ হলেই যে কারও মোবাইল বা কম্পিউটার জব্দ করতে পারবেন এবং জেলেপুরে দিতে পররবেন যেকোন ব্যক্তিকে। বিএনপি সরকারের আমলা করা আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা ছিল। এই সরকার সেই ৫৭ ধারাকেই নতুন আইনের ৩২ ধারায় আরও বিস্তৃত ও কঠোর করেছে।

সমাজবিরোধীদের জন্য এই আইন এক অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। লেখক, সাংবাদিক, সংস্কৃতি ও মানবাধিকার কর্মীসহ যে কাউকে হেনস্থা ও হয়রানি করতে এই আইন ব্যবহৃত হচ্ছে। গত বছর ৩২ জন সাংবাদিক গ্রেফতার হয়েছেন এই আইনে এবং এদের বেশিরভাগই দুর্নীতি ও অনিয়মের সংবাদ পরিবেশনের জন্য।

অবস্থাটা এতই সঙ্গীন হয়ে পড়েছে যে, কে বলবেন, কতখানি বলবেন সে সব নিয়ন্ত্রণের পর্যায় পর্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর শাসন নেমে এসেছে। বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায়, টেলিভিশনে, ফেসবুকে, ইউটিউবে অনেক মতই প্রকাশিত হচ্ছে, কিন্তু দেশের একটা ভাবমূর্তি সৃষ্টি হয়েছে যে. এই আইনের কারণে মত প্রকাশ করতে না পেরে শিল্পী-সাহিত্যিক আর সাংবাদিকরা গুমরে মরছেন।

সমস্যা হলো এ আইনের অপরাধ ও শাস্তি–সংক্রান্ত প্রায় ২০টি ধারার মধ্যে ১৪টি জামিন অযোগ্য। এই আইন পুলিশকে বাসাবাড়িতে প্রবেশ, অফিসে তল্লাশি, লোকজনের দেহ তল্লাশি এবং কম্পিউটার, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, সার্ভার ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম-সংক্রান্ত সবকিছু জব্দ করার ক্ষেত্রে সীমাহীন ক্ষমতা দিয়েছে। পুলিশ এ আইনে দেওয়া ক্ষমতাবলে পরোয়ানা ছাড়াই সন্দেহবশত যেকোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে পুলিশের কোনো কর্তৃপক্ষের কোনো ধরনের অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজন নেই। এতেই বোঝা যায় এই আইন কতটা ভয় পাইয়ে দিতে পারে মানুষকে, বিশেস করে লেখক, সাংবাদিক ও মানবাধিকার নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের একটি বড় ত্রুটি হলো ‘অপরাধীদের’ শাস্তির মাত্রা নির্ধারণের বিষয়টি। এ প্রসঙ্গে একই সময়ে পাস করা সড়ক নিরাপত্তা আইনের কথা বলা যায়। এ আইনে দুর্ঘটনায় মানুষ মেরে ফেলার সর্বোচ্চ শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ বছরের কারাদণ্ড। আর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিধান করা হয়েছে, ঔপনিবেশিক আমলের অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট (১৯২৩) লঙ্ঘনের জন্য সাংবাদিকদের যাবজ্জীবন পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। কোনো সাংবাদিক তাঁর মোবাইল ফোনে অপ্রকাশিত কোনো সরকারি নথির ছবি তুললে অপরাধী বলে গণ্য হবেন, অথচ এটি আজকাল খুবই সাধারণ একটি চর্চা। যে সরকার তথ্য অধিকার আইন করল সে আবার একশ বছর আগের অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ফেরত আনে ডিজিটালের নিয়ে এল।

আমরা এটা বুঝতে পারছি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে, বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যম যাকে আমরা সভ্যতার মহসড়ক বলছি সেখানে বড় ধরণের অসভ্যতা চর্চা হচ্ছে। যা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। মিডিয়ার গর্ভে সোশ্যাল মিডিয়া নতুন দিগন্ত খুললেও এই উন্মেষটাকে আমরা শেষ পর্যন্ত ইতিবাচক রাখতে পারছি না। নারী ও প্রগতিশীল মানুষ, সংখ্যালঘূদের টার্গেট করে ভুয়া সংবাদ ও রটনা চলছেই। সাম্প্রদায়িক গুজব, উগ্র জঙ্গিবাদী মিথ্যাচার, সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক জল্পনা, গণ-আতঙ্ক সৃষ্টির মতো তথ্য অত্যন্ত বিপজ্জনক ভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার নজির আমরা দেখেছি। এই ভয়ঙ্কর প্রবণতা যে বিপর্যয় আনতে পারে সেটা জেনেই আমরা মনে করি ছাঁকনিটা খুব দরকার। তাই এই আইনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে দ্বিমত করছি না।

কিন্তু আড়াই বছরের প্রয়োগে আমরা অপপ্রয়োগই বেশি দেখেছি। এবং এই আইনে মামলা তারাই করেছে বেশি যারা কর্মে, স্বভাবে ও আচরণে দুর্বৃত্ত। আমরা মনে করি সরকারের উচিত হবে এই আইন আবার পর্যালোচনা করা। এই আইনে কোনো অপরাধের অভিযোগ এলে পুলিশের তদন্তের আগে কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না বা তার বিরুদ্ধে মামলা নেয়া যাবে না- এমন একটা বিধান জরুরি হয়ে পড়েছে। লেখক মুশতাক ছয়বার জামিনের আবেদন করেও পান নি। বিচারিক আদালতের কাছে সেই ব্যাখ্যা আমরা চাইতে পারব না, কিন্তু জামিন হওয়া না হওয়ার প্রশ্নের সমাধান হতেই হবে। আইনের অব্যাহত অপপ্রয়োগ কারা করছেন তাদের একটা পরিসংখ্যানও সরকারের পক্ষ থেকে নিতে হবে।

এই আইনের কারণে গণমাধ্যমের পাশাপাশি সাধারণ নাগরিকদের মধ্যেও একটা ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। সরকারের নিজস্ব ভাবমূর্তি রক্ষায় বিষয়টি ভাবা প্রয়োজন। সব আইনই একটা ট্রায়াল এন্ড এরর বা পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যায়। আমরা মনে করি যথেষ্ট ‘এরর’ বের হয়েছে। এর প্রয়োগের চেয়ে অপপ্রয়োগ বেশি হচ্ছে। সেটা কি করে বন্ধ করা যায় ভাবতেই হবে। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে আইনটি নিয়ে বিতর্ক ও সমালোচনায় সরকারের ভাবমূর্তির ওপর দেশে ও বিদেশে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

এইচআর/এমএস