করোনায় শিক্ষা, করোনার শিক্ষা
পরীক্ষা দিতে মরিয়া হয়ে গেছে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রীরা। তারা পাস করতে চায়, কর্মজীবনে প্রবেশ করতে চায়। শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজের চলমান পরীক্ষাগুলো নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সিদ্ধান্তটি নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষক উপাচার্য পদের প্রশাসক নামের শাসক পরীক্ষা নিতে চাননি। এবং বিক্ষোভের মুখেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থগিত হওয়া সব পর্যায়ের পরীক্ষার নতুন সময়সূচি ঘোষণা করা হয়েছে। আগামী ২৪ মে থেকে স্থগিত পরীক্ষাগুলো নেওয়া শুরু হবে। এ ছাড়া ২০২০-২০২১ শিক্ষাবর্ষের প্রথম বর্ষের ভর্তির কার্যক্রম আগামী ৮ জুন থেকে শুরু হবে।
ভয়াল করোনা ভাইরাস সব ক্ষেত্রে ছাপ রেখেছে। তবে সবচেয়ে ভয়ানক ছাপটি রেখে যাচ্ছে শিক্ষা খাতে। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষা ও শিক্ষার্থীরা গভীর অনিশ্চয়তায় পড়েছে। এক বছর ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা তবুও কিছু কথা বলতে পারছে, স্কুল কলেজের অবস্থা আরও নাজুক। সবচেয়ে বেশি নাজুক বেসরকারি পর্যায়ে গড়ে উঠা কিন্ডাগার্টেনগুলো।
আশঙ্কা ছিল যে, দীর্ঘ সময় বিদ্যালয় বন্ধ থাকলে ঝরে পড়ার হার বাড়বে। মেয়েদের বাল্য বিয়ে বাড়বে। বলতে গেলে এটাই হয়েছে। এই মহামারির কালে যারা ভার্চুয়াল শিক্ষার সুযোগ নিতে পারেনি তারা ঝরে পড়ে কোথায় গিয়েছে তা হয়তো কোনদিন আমরা জানতে পারব না, কারণ এসব নিয়ে গবেষণার কোন প্রচেষ্টা কোন কালেই আমাদের শিক্ষক সমাজ করবেন না।
করোনা রোগের যে আঘাত শিক্ষার ওপর পড়ল, তা কেউ ভাবতেও পারেনি। নতুন শিক্ষাবর্ষের তিন মাস পার হয়ে গেল, ঈদের পর খুলতে খুলতে অর্ধেক পার হবে। অথচ ছাত্রছাত্রীরা নূতন শ্রেণির পাঠ শুরু করতে পারল না। ঈদের পর আসলেই শুরু করতে পারবে কিনা সেটাও নিশ্চিত না। এই ক্ষতি অপূরণীয়।
এত বড় সঙ্কট আসবে কেউ ভাবেনি। এই যে না ভাবা সেটা এক সঙ্কট। আবার সঙ্কটে যখন নিপতিত হয়েছি তখন এর থেকে পরিত্রাণের উপায় না ভাবা আরও বড় সঙ্কট। সরকার রোগ বিস্তারের ভয়ে সব বন্ধ রেখেছে। এর বাইরে কোন উপায় তার ছিল না। কিন্তু দীর্ঘ কাল স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলে সর্বস্তরের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাব্যবস্থাটি কী রূপে পরিচালনা করতে হবে, তা নিয়ে জাতির শিক্ষাবিদদের কোন আওয়াজ পাওয়া যায়নি। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কোন সুচিন্তিত মতামত দেওয়ার উদ্যোগ নেননি। শিখেছেন কেবল এক অনলাইন শিক্ষা। কিন্তু এটাও যে শিক্ষাক্ষেত্রে এক বিভাজন- ডিজিটাল বিভাজন- সেটা নিয়েও এই বিবেকদের কোন নসিহত পাওয়া যায়নি। যারা স্মার্টফোন, ল্যাপটপ পেল, যারা দাম দিয়ে ডাটা কিনতে পারল, তাদের শিক্ষা অব্যাহত থাকল। যারা এই সিস্টেমে প্রবেশ করতে পারল না, তাদের পড়াশোনা বন্ধ থাকল। প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র পরিবারে, যেখানে স্মার্টফোন, টিভি- কোনও কিছুরই ব্যবস্থা নেই, ইন্টারনেট থাকলেও গতি নেই সেখানে লেখাপড়া চলবে কী উপায়ে, আজ অবধি তার কোনও উত্তর মিলল না।
আমরা সবকিছু মেনে নেই, নিচ্ছি। মহামারির কারণে একটি শিশুও অশিক্ষিত থেকে গেলে তা হবে অন্যায়। কিন্তু এমন পরিস্থিতি যাতে না-ঘটে সেরকম কোন প্রচেষ্টা বা উদ্বেগ কোথাও ছিল না এবং এখনও নেই।
এমন এক অবস্থা কাটিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ঈদের পর যখন খুলবে তখন দেখা যাবে সব শিক্ষার্থী ফিরেনি। বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারের অনেকেই। তবে এই করোনাকাল নতুন এক বাস্তবতা নিয়ে এসেছে আমাদের সামনে। যদি দেশব্যাপী ফোর-জি’র স্বাভাবিক গতি নিশ্চিত করা যায়, যদি আইটি অবকাঠামো নির্মাণ করা যায় এমন ক্ষতি আগামীতে কম হবে। বাস্তবতা হলো করোনা চলে গেলেও অনেকের জন্যই ফিরবে না একটা ক্লাসের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা একপেশে লেকচারের জন্য অপেক্ষা করা। হয়তো মিশ্র পদ্ধতিতে চলে যাবে ব্যবস্থাটি। কিছু ক্লাস বা পরীক্ষা হবে অফ লাইনে, কিছু অনলাইনে। হয়তো ক্যাম্পাস-ভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকে আমরা ক্যাম্পাসহীন শিক্ষাব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাব।
শিক্ষার্থীরা এই দীর্ঘ সময়ে যে ছন্দ হারিয়েছে তা ফেরানো কঠিন কাজ। সেটা নিয়ে কী ভাবছেন আমাদের শিক্ষকরা? ঘরে বসে পড়াশোনা করার অভ্যাসকে কিভাবে আরও বিস্তৃত করা যায় সেটা নিয়ে ভাবতে হবেই। সবাই ক্লাসে যাবে, সবাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকবে– এমনটা ভাববার কোন অবকাশ নেই। ভবিষ্যতে কাজ এবং পড়াশোনা, দুটোই চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ আসবে সবার জন্য। মুখস্থবিদ্যাও আর চলবে না। শিক্ষা আর ডিগ্রি সর্বস্ব থাকছে বলে মনে হয় না। হয়তো কাগুজে ডিগ্রিকে প্রতিস্থাপন করবে দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা।
করোনা-পরবর্তী জগতে শিক্ষা ছাত্রদের মধ্যে সৃষ্টিশীলতা বিকাশে সাহায্য করবে। তথ্যভিত্তিক শিক্ষা হয়তো আর থাকে না। এবং বলা প্রয়োজন যে, এসব পরিবর্তন সাময়িক নয়। করোনামুক্তির সঙ্গে আবার আমরা পুরনো শিক্ষাপদ্ধতিতে ফিরলেই চলবে- এমন ভাবনা থেকে বের হওয়া প্রয়োজন। শিক্ষা পাল্টাচ্ছে এবং যারা এই পরিবর্তনকে বুঝবেন না তারা কোথায় যবেন সেটা তারা এখন ভাবতেও পারবেন না। করোনায় শিক্ষা খাত বদলেছে, করোনা আমাদের শিখিয়েছেও অনেক।
এইচআর/এমএস