ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ময়নাতদন্তকারীর দুষ্কর্মের তদন্ত করবে কে?

অধ্যাপক ড. ডা. মোহাম্মদ নাসিমুল ইসলাম | প্রকাশিত: ০৯:২৯ এএম, ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২১

বিদেশে যে কোনো সরকারি চাকরি বা পাবলিক ইউনিভার্সিটির চাকরিতে যোগদানপত্র স্বাক্ষরের আগে একটি শপথ নামায় স্বাক্ষর করা পূর্বশর্ত। সেখানে স্পষ্টাক্ষরে লেখা থাকে, চাকরিকালীন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজনীতিতে অংশ নেয়া যাবে না। সেই চাকরি যদি হয় মেডিকোলিগ্যাল সেবায় যারা জড়িত তাদের জন্য তবে, সেখানে বলা থাকে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজনীতিতে অংশ নেয়া ফরবিডেন। এই পার্থক্যই বলে দেয় মেডিকোলিগ্যাল সেবায় যারা নিয়োজিত তারা দল বা স্বজনপ্রীতিতে যুক্ত হলে বিচারব্যবস্থায় তার প্রভাব পড়তে পারে এবং সেটি এড়াতেই চাকরির শুরুতে এ ব্যবস্থা। এটি সত্য যে কোনো বিচারকার্যে ফরেনসিক প্রতিবেদন একমাত্র বিবেচ্য না হলেও কোর্টে এর মূল্য অপরিসীম।

ফরেনসিক প্রতিবেদন কোন বিচারের রায়কে প্রভাবিত করতে পারে, ভুল রায়ে একজন দোষমুক্ত হতে পারেন বা কম সাজাও পেতে পারে। বাংলাদেশে একটি হত্যা মামলার রায়ের সময় আমি বিচারকের অনুমতি নিয়ে আদালত কক্ষে হাজির থেকে দেখেছি, কীভাবে একজন বিচারক তার রায় দিয়ে থাকেন। রায়ের শুরুতেই তিনি বলেছিলেন, আমরা বিচার করি সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে। এই সাক্ষ্য প্রমাণে ভুল থাকলে তাদের রায়ে ভুল হতে পারে।

সেদিন তিনি তার রায়ের পক্ষে অনেক প্রমাণকে পাশ কাটিয়ে শুধু কিশোর এক চা দোকানির স্বচক্ষে দেখা এবং তার বর্ণনার ওপর আস্থা রেখে রায় দিয়েছিলেন। সেই দোকানি যদি কোনো রকম প্রভাবিত হয়ে বা ইচ্ছাকৃত ভুল সাক্ষী দিয়ে থাকেন তাহলে সাজাপ্রাপ্ত মানুষটির জীবনের বিশাল এক অংশ অন্ধ কুঠুরিতে থাকার দায় কে নেবে?

বাংলাদেশে কেউ কি এর ধার ধারে? যে দল ক্ষমতায় সেই দলে ঘেঁষতে পারলেই যেন সৌভাগ্যের চাবিকাঠি হাতে পাওয়া যায়। সরকারি কর্মকর্তারা যখন রাজনৈতিক নেতাদের সুরে কথা বলেন তখন সরকারি দলে ঘেঁষতে একরকম প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এ দল ঘেঁষে উচ্চ এবং লোভনীয় পদে পদায়ন এবং পদোন্নতিপ্রাপ্তদের অনেকেই সেই পদের যোগ্য নন। ফলে এর প্রভাব পড়ে কর্মক্ষেত্রে। আমি যদি আমার ফরেনসিক পেশাকে বিবেচনায় নেই সেখানেও চেয়ারকে কলুষিত করে দুর্বৃত্তায়নের হলিখেলায় মেতে উঠেছে এসব সুযোগ সন্ধানীরা।

বিএনপি আমলে এরা পরিচিত ছিলেন বিএমএ, ড্যাব আর বর্তমান আমলে চেয়ারের মানুষ বদল হয়ে বিএমএ, স্বাচিব! আগে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নেতা বনে যাওয়ার সাথে যোগ্যতা দেখা হলেও এখন যোগ্যতাটা নির্বাসনে। যোগ্যতা যেদিন থেকে নির্বাসনে গেছে সেদিন থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কথাটা যোগ হয়েছে। মেডিকোলিগ্যাল সেবায় ফরেনসিক মেডিসিনের ভূমিকা এবং গুরুত্ব অপরিসীম। চিকিৎসা শাস্ত্রের এ বিষয়টি একাধারে অবহেলিত অন্যদিকে মুষ্টিমেয় কিছু দুর্নীতিবাজের কারণে ফেসবুক জরিপে মেডিকেল বিষয়সমূহের মধ্যে দুর্নীতিতে শ্রেষ্ঠতম স্থানে অধিষ্ঠিত। মাছের পচন শুরু হয় মাথা থেকে। এখানেও এ বিষয়েরও পচন মাথা থেকেই।

কী আজব উপায়ে উটের পিঠে হাঁটছে দেশের মেডিকোলিগ্যাল ব্যবস্থা। রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় সীমাহীন অনিয়মের কারণে আজকাল নিজ পেশার মানুষ পর্যন্ত বিব্রত। অথচ ঢেউয়ের মতো একের পর এক আসা অভিযোগ আর শাস্তির খড়্গ মাথায় নিয়ে তারা শাস্তি মোচনের মিশনে ব্যস্ত থাকে।

যেখানেই অনিয়ম সেখানেই এসব দুর্নীতিবাজের উপস্থিতি থাকায় জনমনে এক বিভ্রান্তি বদ্ধমূল হয়েছে যে ফরেনসিকে কাজ করা মানেই উপরি উপার্জন, এখানে যারা কাজ করেন তারা সবাই দুর্নীতিবাজ। সে কারণে এ সেবায় নিয়োজিত ডাক্তার এবং শিক্ষার্থীরা এখন প্রতিনিয়ত তির্যক হাসির খোঁরাক হচ্ছেন। আমাকেও সেই কাতারে ফেলে অনেকেই ভুল বোঝেন এবং একই হাসি উপহার দিতে চান। বলাই বাহুল্য, সেই হাসি সহ্য করা আমার জীবনের এক অসহ্য অধ্যায়।

দেশ বিদেশের অভিজ্ঞতা নিয়ে বলতে পারি, যদি আপনার মাঝে সততা থাকে, এ পেশায় চাকরি করা মহাশান্তি, স্বস্তি এবং সম্মানের। বিদেশে প্রতিনিয়ত সায়েন্টিফিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের সময় কাটে। নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে গবেষণা করে সমাধানের দিকে এগোনোর আনন্দই আলাদা।

এখানে অনৈতিক লেনদেনের কোনো সুযোগ নেই। আমরা সামনের দরজা দিয়ে মর্গে ঢুকে সুরতহাল পড়ে প্রয়োজন হলে মৃত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজনের সাথে কথা বলে ময়নাতদন্ত শুরু করি। শেষ হলে পেছনের দরজা দিয়ে নিজ দফতরে পৌঁছে প্রতিবেদন লিখে তা ছেড়ে দেই। এখানে অনিয়মের সুযোগ কোথায়? আমাদের দেশে ময়নাতদন্তের পর মৃত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজনের সাথে কোর্টের আদেশ ছাড়া কথা বা সাক্ষাৎ বন্ধ করা উচিত।

আমার ধারণা, যত অনিয়ম সে সময়ই হয়। ময়নাতদন্তকারীর ময়নাতদন্ত সীমিত করে সমহারে বণ্টন ও তাৎক্ষণিক ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুতের ব্যবস্থা করা উচিত।

এ প্রসঙ্গে একটি সত্য ঘটনা বলে আমি আমার আজকের লেখা শেষ করব। মালয়েশিয়ায় আমার বাংলোর নাইটগার্ড পর পর দুই রাত অনুপস্থিত থাকায় আমার নালিশে, কৈফিয়ত তলবসহ বেতন কাটা হয়। গরিব গার্ড সশরীরে এসে আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। সে জানায়, দুদিন আগে সড়ক দুর্ঘটনায় তার একমাত্র সন্তান নিহত হলে সে তাকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি যায় এবং সেখানে সামাজিক কর্মকাণ্ডে আটকে পড়ায় ডিউটিতে আসতে পারেনি। আমি ফাইল ঘেঁটে দেখি, আমি নিজে তার ছেলের ময়নাতদন্তকারী ছিলাম, যা আমি সে বলার পরে জানলেও সে হয়তো কোনো দিনও জানবে না।

লেখক : ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান। বর্তমানে অধ্যাপক, ফরেনসিক মেডিসিন, ইউনিভার্সিটি টেকনোলোজি মারা (UiTM) মালয়েশিয়ায় কর্মরত।
[email protected]

এইচআর/ফারুক/জেআইএম