ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ভ্যাকসিনকেন্দ্রিক গুজব ও ভীতি

ডা. পলাশ বসু | প্রকাশিত: ১০:১৯ এএম, ২৩ জানুয়ারি ২০২১

প্রথমেই বলে নিই ভ্যাকসিন নিয়ে একটা ভয়ভীতি সবসময়ই ছিল। এ অবধি ২০ ধরনের রোগের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন বিশ্বব্যাপী বিরাজমান আছে। আমাদের দেশেও এসব ভ্যাকসিনের সবগুলো না পাওয়া গেলেও অধিকাংশই পাওয়া যায়। রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের এখানে বাচ্চাদের ভ্যাকসিনেশন করা হচ্ছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে প্রাথমিক বা প্রাইমারি স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বাংলাদেশের এ সাফল্য বিশ্ববাসীরও নজর কেড়েছে। সম্প্রতি করোনার ভ্যাকসিন ২১তম ভ্যাকসিন হিসেবে এ জগতে নতুন করে সংযোজিত হয়েছে।

করোনা মোকাবিলার জন্য তৈরি এ ভ্যাকসিনটি এখন আমাদের দেশেও পৌঁছেছে। বলা যায় বিশ্বে যে স্বল্প সংখ্যক দেশ এ কাজে যুক্ত হতে পেরেছে সেখানে বাংলাদেশও শরিক হতে পেরেছে সময়োপযোগী পরিকল্পনা নেয়ার কারণেই। যদিও শুরুতে ভ্যাকসিন আমরা পাব কিনা, পেলেও তা সঠিক সময়ে আসবে কিনা- এসব উদ্বেগের বহিঃপ্রকাশ দেখতে পেয়েছি। এখন ভ্যাকসিন দেশে এরই মধ্যে চলে আসায় এটার অবসান ঘটেছে ঠিকই। তবে নতুন করে ভ্যাকসিনবিরোধী নানা তত্ত্ব আমরা দেখতে পাচ্ছি।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে অবশ্য সঠিকভাবেই “ষড়যন্ত্র তত্ত্ব” হিসেবে অভিহিত করেছে। কারণ তারা ভ্যাকসিন নিয়ে গুজব, মিথ্যা তথ্য দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার ইতিহাস বেশ ভালোভাবেই জানে। তারা ভ্যাকসিনবিরোধী “অ্যান্টিভ্যাক্স” গ্রুপের প্রচার, প্রপাগান্ডার খবরও জানে। এ কারণে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত ভ্যাকসিন সংক্রান্ত সকল গুজবকে তারা রিপোর্ট করতে বলেছে। তাছাড়া ২০১৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য প্রকাশিত যে ১০টি স্বাস্থ্য সমস্যাকে গুরুতর সমস্যা হিসেবে অভিহিত করেছে তার মধ্যে “ভ্যাকসিন হেসিটেন্সি” বা “ভ্যাকসিন দোদুল্যমানতা” অন্যতম।

পিউ রিসার্চ সেন্টারের ২০২০ সালের নভেম্বরের শেষদিকে প্রকাশিত গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, আমেরিকার প্রায় ৪০ শতাংশ জনগণ “সুনির্দিষ্ট” অথবা “সম্ভাবনাজনক” বিষয় হিসেবে ভ্যাকসিনবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। এ কারণে জো বাইডেন, বারাক ওবামাসহ অনেক নামি ব্যক্তি প্রকাশ্যে ভ্যাকসিন নিয়ে দেশবাসীকে ভ্যাকসিন সম্পর্কিত বিষয়ে আস্থা সৃষ্টিতে প্রয়াসী হয়েছেন। অন্যান্য দেশেও এমন হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

যদিও আমাদের দেশে ঠিক কত শতাংশ মানুষ ভ্যাকসিন নিয়ে অনীহা প্রকাশ করেছে তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবু এখন বিশ্বায়নের এ যুগে আগুন যখন কোথাও লাগে তখন কেউই তা থেকে সে অর্থে নিরাপদ থাকে না বলেই ধরে নিতে হবে। তার মানে হচ্ছে “অ্যান্টিভ্যাক্স” গ্রুপের প্রচার, প্রপাগান্ডায় আমাদের এখানেও অনেকেই হয়তো না জেনে বুঝেই শামিল হয়েছে! অথবা এমনও হতে পারে সচেতনভাবেই অহেতুক গুজব, বিভ্রান্তি ছড়িয়ে একটা অস্থিরতা তৈরি করতে চায় তারা! বর্তমান শ্বাসরুদ্ধ বাস্তবতা থেকে জনগণের ইতিবাচক মনোভাবকে কিছুটা হলেও অন্যদিকে নিয়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থাসহ অর্থনীতির ওপর সৃষ্ট চাপকে আরও দীর্ঘায়িত করতে চাওয়াও তাদের উদ্দেশ্য কিনা সেটাও জানি না। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে- এটাকে সঠিকভাবে মোকাবিলা না করতে পারলে জটিলতা বাড়বে ছাড়া কমবে না।

করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে গুজব বা বিভ্রান্তির সদ্যফোটা বাচ্চা হচ্ছে- ভারত আমাদের তাদের নিজের তৈরি “কোভ্যাকসিন” উপহার হিসেবে দিয়েছে। এটা অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন নয়। বাস্তবতা কিন্তু তা নয়। কারণ ভারতের নিজের তৈরি এ ভ্যাকসিনটি ফেজ ৩ ট্রায়াল সম্পন্ন করার অনুমতি পেয়েছে। ফলে সেটার ২০ লাখ ডোজ তৈরি করে বাংলাদেশে দেয়ার কোনো সুযোগই নেই। বাংলাদেশে এটার ট্রায়াল চালাতে হলে বিএমআরসির অনুমতি নিতে হবে। যেমন চীনের সিনোভ্যাক নিয়েছিল জুলাই মাসের দিকে। পরে আর সেটা এগোয়নি।

বিজ্ঞাপন

বিশ্বব্যাপী টিকার ট্রায়াল, বিপণন এসবের লিখিত নীতিমালা রয়েছে। চাইলেই যা ইচ্ছে তা করা যায় না। ব্রাজিলে সিনোভ্যাকের টিকার সংবেদনশীলতা মাত্র ৫০ শতাংশ পাওয়া গেছে। ফলে এটার আপাত পরিণতি ভালো নয়। আর ফাইজার ও মডার্নার টিকা যে পরিমাণ উৎপাদিত হচ্ছে তা আমেরিকা এবং ইউরোপের চাহিদা মেটাতেই ব্যস্ত রয়েছে। তাছাড়া এ টিকা দুটো সংরক্ষণ করতে হলে মাইনাস ৭০ ডিগ্রি তাপমাত্রা লাগে। এটা তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশে তাই ব্যবহৃত হতে পারবে বলে মনে হয় না।

রাশিয়ার উৎপাদিত ভ্যাকসিনের খবরাখবরও তথৈবচ। ফলে বাকি থাকে এই অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন। এটা উৎপাদিত হচ্ছে টিকা উৎপাদনে বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটে। “কোভিশিল্ড” নামক এ ভ্যাকসিন তৈরির প্রতিটি ধাপ অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পরীক্ষা করে তার সর্বশেষ ফলাফল জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। ফাইজার, মডার্নাসহ অন্য কোনো ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেই সেটা হয়নি। ফলে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি এ ভ্যাকসিন নিয়ে তাই বিভ্রান্তির কোনো সুযোগ নেই।

পরিশেষে বলব, যেকোনো ওষুধেই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। এই যে আপনি জ্বর হলে প্যারাসিটামল খেয়ে থাকেন এটারও কিন্তু তাৎক্ষণিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। তাই বলে কি আমরা জ্বর হলে প্যারাসিটামল না খেয়ে থাকি? নিশ্চয় তা নয়। মোটাদাগে বললে বলতে হয়, যেকোনো ওষুধে যেটা হয় সেটা হচ্ছে- হাইপারসেনসিটিভিটি বা অতি সংবেদনশীল প্রতিক্রিয়া। ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেও তেমন হতে পারে। তবে তা দেখা দিতে শুরু করে দেয়ার অল্প সময় পরই। যেহেতু ভ্যাকসিন যারা দেবেন তাদের প্রশিক্ষিত করা হয়েছে ফলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলে সেটা তারা বুঝতে পারবেন। আবার স্বাস্থ্য অধিদফতর গুরুতর প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে হাসপাতালে নিতে হলেও সে ব্যবস্থা করে রেখেছেন।

বিজ্ঞাপন

সিরাম ইনস্টিটিউটের তৈরি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার যে ভ্যাকসিন আমাদের দেশে এসেছে তা ভারতেও প্রয়োগ হচ্ছে। এরই মধ্যে লাখের উপরে মানুষকে তারা ভ্যাকসিন দিয়েছে। কিন্তু গুরুতর কোনো প্রতিক্রিয়া তারা পায়নি। মেয়েদের মুখে দাড়ি গজিয়েছে অথবা ছেলের কণ্ঠ মেয়েদের মতো হয়ে গেছে কিংবা এটা নিলে পুরুষত্বহীনতা দেখা দেবে বলে অনলাইন এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকে মিথ্যা, আজগুবি কথা প্রচার করছেন নিখুঁত ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে। অথচ এসবের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।

ফলে এসব গুজবে বিভ্রান্ত না হয়ে আমাদের দেশে যে “সুরক্ষা অ্যাপ” তৈরি হয়েছে সেখানে নিবন্ধন করুন। যদিও এখন ভ্যাকসিন কারা পাবেন বা পাবেন না সেটারও একটা নির্দেশনা তৈরি করা হয়েছে। ফলে সে অনুসারেই সবকিছু যেহেতু হবে তাই অহেতুক গুজব, মিথ্যা বা কানকথা বিশ্বাস না করে নিজের যুক্তি, বুদ্ধি ও বিবেক দিয়ে বিচার করুন এবং যথাযথ সিদ্ধান্ত নিন। নিজে সুরক্ষিত থাকুন এবং অন্যকেও সুরক্ষিত রাখুন।

লেখক : চিকিৎসক ও শিক্ষক। সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, এনাম মেডিকেল কলেজ।

বিজ্ঞাপন

এইচআর/বিএ/এমএস

বিজ্ঞাপন