যুক্তরাজ্যে শিক্ষাঙ্গন বিতর্ক এবং নতুন বছরের আলোর ঝিলিক
বছরের শেষ দিনে আনুষ্ঠানিকভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হলো যুক্তরাজ্য। যুক্তরাজ্যের রাত ১১ টায় আর ইউরোপের রাত বারোটায়। ৩১ ডিসেম্বর রাত ১১টার সময়ে ইউরোপ থেকে বিদায় নেয় যুক্তরাজ্য। কারণ তখন ব্রাসেলসে মধ্যরাত, ঘড়িতে ১২টা বাজে। ব্রাসেলস যেহেতু ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাণকেন্দ্র, তাই তাদের সময়েই যুক্তরাজ্যকে বিদায় নিতে হয়েছে।
যুক্তরাজ্যের সাথে যে কোন দেশের অবাধ যাতায়াত বন্ধ হয়ে গেলো এই সময় থেকে। এখন থেকে যুক্তরাজ্য থেকে ইউরোপের কোনো দেশে যেতে গেলে ভিসা লাগবে। ইউরোপ থেকে যুক্তরাজ্যে গেলে একটি নির্দিষ্ট সময় ভিসা ছাড়া থাকা যাবে। তার বেশি সময় থাকতে হলে ভিসা নিতে হবে। যুক্তরাজ্যের ব্রেক্সিটের সিদ্ধান্ত কতটা যুক্তিযুক্ত, তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে, চলবেও কিছুদিন। কিন্তু ব্রিটেনের বেরিয়ে আসায় রাষ্ট্রীয়ভাবে যে সবচেয়ে অস্বস্তিতে আছে ফ্রান্স, তার একটা সুস্পষ্ট ঈঙ্গিত এসেছে ৩১ ডিসেম্বর রাতে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ব্রেক্সিট বিতর্কটি যেন উসকে দিলেন তার নববর্ষের বক্তৃতায়। তিনি বলেছেন, ব্রেক্সিট হলো মিথ্যা এবং মিথ্যা বলার প্রতিশ্রুতি। স্বাভাবিকভাবেই এ ঈঙ্গিত যুক্তরাজ্যের প্রতিই, অন্য অর্থে বরিস জনসনের প্রতি। যদিও তিনি বলেছেন 'যুক্তরাজ্য শুধু ফ্রান্সের প্রতিবেশি নয়, বন্ধু দেশও।' ব্রেক্সিটের পর কীভাবে সেই সম্পর্ক বজায় থাকবে, তা নিয়ে ফ্রান্স উদ্বিগ্ন। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বার বারই তিনি তাঁর জয়ের প্রতিধ্বনিই করছেন সব আলাপ আলোচনায়।
প্রকৃত অর্থে নতুন বর্ষ মানে নতুন কিছু নয়। একটা স্বাভাবিক নিয়মে রাত বারোটা বাজে, মধ্যরাতের পর আবারও ঘড়ির কাটা আগাতে থাকে, বরফে আচ্ছাদিত হয়ে কনকনে ঠাণ্ডায় আমরা জেগে উঠি । আতশজবাজির অলোকচ্ছটা হয়ত অন্ধকার ভেদ করার ঝিলিক দেখায়, মেতে উঠে মানুষ হালকা আমেজে। পশ্চিমা দেশের মানুষগুলো মাতাল হয়; উৎসব যেন মাতলামীরই আরেক অনুষঙ্গ।
এবার এটাও হয়নি এই ব্রিটেনে। আলোর বিস্ফোরণ হয়নি। বিগ বেনের ঘন্টা বেজে উঠলে টেমসের তীরের আগুনের বিচ্ছুরণ দেখেনি বিশ্ব। নদীতে পড়েনি সেইমায়া বীপ্রতিবিম্ব। সারা বিশ্বই হয়ত এরকমই। কিন্তু নিউজিল্যান্ড ছিল ব্যতিক্রম। সারা পৃথিবী বিশেষত যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ যখন থমকে আছে, হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু আর স্বজনের কান্না নিয়ে দেশগুলো আহাজারি করছে, তখন সেখানে এই দেশটি সর্বোচ্চ ছাড় দিয়ে মাসের পর মাস লকডাউন দিয়ে জনসাধারণকে রাখতে পেরেছে তুলনামূলকভাবে অনেক অনেক নিরাপদ, তাইতো মানুষগুলো সেখানে উৎসবের আমেজ পেয়েছে ।
কিন্তু ব্রিটেন এক রুদ্ধশ্বাস সময় কাটাচ্ছে। লন্ডনের প্রতিটি কর্নারে যেন দীর্ঘশ্বাস। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতি দিন যাদের জন্য শুভ কামনা করা হয়, তাদের প্রতিজনই বলতে গেলে আমাদের পরিচিত। প্রতিদিন শহরটিতে বাসা বাঁধছে অদৃশ্য করোনা। বন্ধু-বান্ধব স্বজনদের খবর শংকাগ্রস্ত করছে সবাইকে। বাংলাদেশী কমিউনিটিতে করোনার গত ওয়েভেও একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলেন। এবারে তার চেয়েও অনেক অনেক বেশি। একেকজনের আক্রান্ত হওয়া মানে পুরো পরিবার এ কষ্ট বয়ে বেড়ায়।
মৃত্যুও বাড়ছে প্রতিদিন । তবে আশার কথা, বাঙালি কমিউনিটিতে কিছুটা হলেও সচেতনতা লক্ষণীয়। সেজন্য কমিউনিটিতে জীবন ক্ষয় গত সময়ের তুলনায় কিছুটা কম। এ নিয়ে অস্বস্তির মাঝেও মানুষের এক ধরনের মানসিক শক্তি আছে । যে যে ধর্মের সেই ধর্মের মানুষগুলোই সৃষ্টিকর্তার কাছে চাইছে সহায়তা। এই সহায়তায় বিজ্ঞান এগিয়ে এসে দুসপ্তাহ আগ থেকেই শুরু হয়েছে ফাইজারের ভ্যাকসিন প্রয়োগ। প্রতি সপ্তাহে বিশ লাখ মানুষকে ভ্যাকসিন প্রয়োগেও মৃত্যুর মিছিলে খুব একটা যেন রকমফের হচ্ছে না।
এসময়েই এসেছে আস্ট্রাজ্যানিকার ভ্যাকসিন। যুক্তরাজ্যের উৎপাদিত এ ভ্যাকসিন নতুন আশা জাগিয়েছে দেশটাতে। সহজে সংরক্ষণযোগ্য এ ভ্যাকসিন দেশটাতে আশা জাগিয়েছে একারণে যে, ব্যাপকভাবে এখন থেকে তার প্রয়োগ হবে। কিন্তু এ আশার বিপরীতে কালো মেঘ ও সরছে না ব্রিটেনের আকাশ থেকে । বরফে যেমন প্রতিদিন কোন না কোন শহর আচ্ছাদিত হচ্ছে, ঘোমট আবহাওয়ার সাথে নাগরিকদরে মাঝেও আছে চরম অস্বস্তি। সরকার আর বিরোধী দলের মাঝে চলছে লকডাউন ইস্যুতে চরম দ্বন্দ্ব। বিরোধী দলের প্রধান চাইছেন দেশটাতে পুরো লকডাউন, অন্যদিকে সরকার টিয়ার ৩ আর টিয়ার ৪ এর ব্যাখ্যা দিয়ে ভিন্ন ভাবে চালাতে চাইছে ভিন্ন ভিন্ন শহর।
সরকার ইতিমধ্যে আগামী এপ্রিল পর্যন্ত নাগরিকদের ফাড়লো অর্থাত বেঁচে থাকার জন্য কাজহীন মানুষের বাড়তি অর্থ মঞ্জুর করে রাখলেও কেন জানি দেশটাকে সম্পূর্ণ লকডাউনের আওতায় নিয়ে আসছে না। অন্যদিকে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খোলা নিয়ে একটা বড় ধরনের দ্বন্দ্বে নেমেছ সরকার বিরোধী দল এবং জনগণ ।
লন্ডনে মহামারি ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ায় শুধু লন্ডনের প্রাইমারি স্কুল বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী লন্ডনের বাইরের শহরগুলোর প্রাইমারি স্কুল বন্ধ করতে চাননি। এমনকি ৩ জানুয়ারিও বরিস জনসন গরীব পরিবারের ছাত্র-ছাত্রীদের দোহাই দিয়ে স্কুলগুলো খোলা রাখতে তাঁর দৃঢ়প্রত্যয় ঘোষণা করেন। কিন্তু গণমাধ্যম থেকে শুরু করে অভিভাবক তাঁর এ সিদ্ধান্তের বিপরীতেই অবস্থান নিয়েছে। আর এ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার আর ভিন্ন ভিন্ন শহরের স্থানীয় প্রশাসনের মাঝে চলছে যেন তুমুল বাক-বিতণ্ডা। শিক্ষকদের সর্ববৃহৎ সংগঠনটি (টিচার্স ট্রেড ইউনিয়ন) সাথে সংশ্লিষ্ট অনেক স্কুলই সরকারের ঘোষণাকে মেনে না নিয়ে প্রাইমারি স্কুল অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ ঘোষণা দিয়েছে। অনেক শহরের কিছু কিছু স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবকরা ইতিমধ্যে এ বন্ধের ইমেইল পেয়ে স্বস্তি প্রকাশ করছেন।
বরিস জনসনকে অসহায়ের মতোই তা হজম করতে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর একগুঁয়েমীকে মানুষ খুব একটা গুরুত্বের সাথে নেয়নি ইতিপূর্বে। নাগরিকদের একধরনের সমর্থন নিয়েই তিনি ব্রেক্সিট ঘটিয়েছেন। করোনাকালীন সময়ে তাঁর অনেক ব্যর্থতাকেও মানুষ মেনে নিয়েছে। কিন্তু ৩ জানুয়ারি বরিস বড় ধরনের একটা ধাক্কা খেলেন। গণতন্ত্রের কাঠামোটাই এরকম। সাধারণ মানুষের অস্বস্তির কারণে প্রধানমন্ত্রীকে নাকাল অবস্থায় পড়তে হয়েছে। বিরোধী দল জনগণের প্রতি আহ্বান রাখেনি স্কুল বন্ধ রাখতে, তারা সরকারের কাছেই দাবি রেখেছে। সরকার তাদের কথা শোনেনি যদিও, কিন্তু জনগণ তাদের কাজটি ঠিকই করতে পেরেছে।
২০২০ গেছে প্রকৃতির দ্রোহে অদৃশ্য শত্রুর সাথে যুদ্ধে গত বছর মানুষ পরাজিত হয়েছে। আর তাই দীর্ঘশ্বাস প্রলম্বিত হয়েছে সারা দুনিয়ায়। এরই মাঝে এসেছে দুই হাজার একুশ। যে অদৃশ্য যুদ্ধ চলছে পৃথিবীর দেশে দেশে, নতুন এ বছরে সারা বিশ্ব তাই শুধু মুক্তিই চাইছে এ যুদ্ধ থেকে। নতুন বর্ষে আষ্ট্রাজ্যানিকাসহ অন্যান্য ভ্যাকসিন দিয়ে এ যুদ্ধে জয়ী হবে মানুষ, আতংক শোক আর বেদনা মাড়িয়ে মানুষ জয় করবে করোনা মহামারি। কয়েক মাসের মধ্যেই হেসে উঠবে পৃথিবী, আলিঙ্গনময় হয়ে উঠবে গোটা মানবজাতি। এই-ই-তো হবে দুই হাজার একুশের আলোর ঝিলিক।
লেখক : যুক্তরাজ্যপ্রবাসী কলামিস্ট।
এইচআর/জেআইএম