ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

হেফাজতের নতুন নেতৃত্বের ধামাকা অভিষেক!

প্রভাষ আমিন | প্রকাশিত: ০৯:১৫ এএম, ২১ ডিসেম্বর ২০২০

রাজনীতির সবচেয়ে অশ্লীল কথা হলো, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। আজ যে বন্ধু, কাল সে শত্রু। ২০১৩ সালের ৫ মে’তে দাঁড়িয়ে কেউ কি ভাবতে পেরেছিল, এই হেফাজতের সাথেও সরকারের সমঝোতা হবে, হেফাজত সরকারের বন্ধু হয়ে যাবে! ৫ মে হেফাজত শাপলা চত্বরে এসেছিল সরকার পতনের লক্ষ্য নিয়ে। সরকার গঠনের স্বপ্নে বিভোর হেফাজত নেতারা নাকি মন্ত্রণালয়ও ভাগাভাগি করে ফেলেছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের তখনকার সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফের এক ধমক আর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কৌশলী অভিযানে হেফাজতের স্বপ্ন সেই শাপলা চত্বরেই বিলীন হয়ে যায়। সরকার তখন বিএনপি-জামাতের বাইরে শত্রুতার আরেকটা নতুন ফ্রন্ট খুলতে চায়নি। তাই হেফাজতের দাবি মেনে পাঠ্যপুস্তক বদলে, সুপ্রিম কোর্ট চত্বর থেকে ভাস্কর্য সরিয়ে, কওমী মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি দিয়ে হেফাজতকে পোষ মানায়।

তবে সমঝোতায় দৃশ্যমান দাবি মানার বাইরে আরো নগদ লেনদেন, জমি-জমার বরাদ্দের গল্পও বাতাসে ভেসে বেড়িয়েছে। যেভাবেই হোক সরকার আল্লামা শফির নেতৃত্বাধীন হেফাজতকে রাজনীতির মাঠে নিষ্ক্রিয় রাখতে পেরেছিল। কিন্তু সমঝোতা প্রক্রিয়ার মধ্যেই হেফাজতেও বিভক্তি তৈরি হয়। সরকারের কাছ থেকে সুবিধা যা পেয়েছেন তা আল্লামা শফি এবং তার ছেলে আনাস মাদানীর পকেটেই গেছে। তাই ক্ষুব্ধ ছিল জুনায়েদ বাবুনগরী গ্রুপ। সুযোগ বুঝে তারা গত ১৬ সেপ্টেম্বর হাটহাজারী মাদ্রাসায় বিক্ষোভ করেন। দাবি আদায়ের জন্য তারা অসুস্থ আল্লামা শফির ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেন। তার যথাযথ চিকিৎসা দেয়া হয়নি। হাসপাতালে নেয়ার জন্য হেলিকপ্টার ও অ্যাম্বুলেন্সের পথরোধ করা হয়। এমনকি তার স্যালাইনও খুলে ফেলা হয়। ১০৩ বছর বয়সে মারা গেলেও যথাযথ চিকিৎসা পাননি আল্লামা শফি, তার চিকিৎসায় বারবার বিঘ্ন সৃষ্টি করা হয়েছে।

বাবুনগরী গ্রুপের প্রবল চাপের মুখে গত ১৭ সেপ্টেম্বর আল্লামা শফি পদত্যাগ করেন, তার ছেলে আনাস মাদানীকে অব্যাহতি দিতে বাধ্য হন। পরদিনই তিনি ঢাকার একটি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। তখনই আমি আল্লামা শফির মৃত্যুর জন্য বাবুগনরীর অনুসারীদের দায়ী করেছিলাম, তদন্ত চেয়েছিলাম। তখন না হলেও আল্লামা শফির মৃত্যুর ঘটনায় তার পরিবার মামলা করেছে। যাতে হেফাজতের নুতন যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকসহ ৩৬ জনকে আসামী করা হয়েছে। তবে এই মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি সন্দিহান। সে আলোচনায় পরে আসছি।

আল্লামা শফির মৃত্যুর পর হেফাজতে নতুন নেতৃত্ব আসে। শফি আমলে কোণঠাসা বাবুনগরী হয়ে যান নতুন আমির। মহাসচিবের দায়িত্ব পান নুর হোসেন কাসেমী, যিনি সম্প্রতি করোনা আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেছেন। তবে হেফাজতকে আবার নতুন করে আলোচনায় এনেছেন সংগঠনের নতুন যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ফেলার হুমকি দিয়ে তিনি রাতারাতি বাংলাদেশের উগ্র মৌলবাদীদের নেতা বনে যান। আগে হেফাজত মানেই ছিলেন আল্লামা শফি। আর এখন হেফাজত মানেই মামুনুল হক। ভাস্কর্য তো নতুন কোনো বিষয় নয়। ইসলামের ১৪০০ বছর ধরেই বিশ্বে ভাস্কর্য রয়েছে। এই ১৪০০ বছরে ইসলাম সারাবিশ্বে ছড়িয়েছে, জয় করেছে অনেক রাষ্ট্র। কিন্তু কোথাও বিজয়ী মুসলমান শাসকরা ভাস্কর্য ভাঙেননি।

এখনও বিশ্বের প্রতিটি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে তো বটেই, প্রতিটি দেশেই ভাস্কর্য আছে। ভাস্কর্য একটি শিল্পকর্ম, যা একটি দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ধারণ করে। বাংলাদেশেও গত ৫০ বছরে ভাস্কর্য কারো ধর্ম পালনে বাধা হয়নি। কিন্তু হঠাৎ করে মামুনুল হক ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে ক্ষেপে গেলেন কেন? এই প্রশ্নের উত্তর হলো- জানান দেয়া। রাজনীতি বলেন, খেলা বলেন, সিনেমা বলেন, গান বলেন; সবাই নিজ নিজ অভিষেকটাকে স্মরণীয় করে রাখতে চান। মাঠে গোল করে বা সেঞ্চুরি করে খেলোয়াড়রা; ভালো অভিনয় করে বা গেয়ে অভিনেতা বা গায়করা নিজেদের অভিষেককে স্মরণীয় করে রাখার চেষ্টা করেন।

অভিষেকে দারুণ সফলদের ক্ষেত্রে আমরা ‘ভিনি-ভিডি-ভিসি বা এলাম-দেখলাম-জয় করলাম’ ব্যবহার করি। রাজনীতিতেও অভিষেক স্মরণীয় করে রাখার ব্যাপার আছে। ৫ মে শাপলা চত্বর দিয়ে রাজনীতিতে আলোচিত অভিষেক ঘটেছিল হেফাজতে ইসলামের। পরে হেফাজত নেতৃত্ব শাপলা চত্বরকে পুঁজি করেই সরকারের সাথে দর কষাকষি করেছিল। কিন্তু হেফাজতের নতুন নেতৃত্বের হাতে দর কষাকষির কোনো নির্দিষ্ট ইস্যু ছিল না। বরং আল্লামা শফির সাথে সরকারের সমঝোতার দায় নিতে হয়েছিল হেফাজতের নতুন নেতৃত্বকেও। দায় নিলেও তারা কিন্তু কিছু পায়নি। একে তো কাঁধে সরকারের সাথে সমঝোতার দায়, তারওপর পকেট খালি, আবার হাতেও দর কষাকষির কোনো অস্ত্র নেই।

হেফাজতের নতুন নেতৃত্বের একটা ধামাকা অভিষেক দরকার ছিল। আর সেটাই এনে দিলেন চতুর মামুনুল হক। যথারীতি অস্ত্র- ধর্ম। মানতেই হবে মামুনুল প্রথম শটটা দারুণ খেলেছেন। একদম ছক্কা। আমি হলফ করে বলতে পারি, মামুনুল-বাবুনগরীদের এই জোশ বেশিদিন থাকবে না। নতুন পাওয়া অস্ত্র নিয়ে তারা এখন সরকারের সাথে দর কষাকষিতে যাবেন। যেই মন্ত্রে আল্লামা শফি-আনাস মাদানীরা পোষ মেনেছিল, সেই মন্ত্র নিশ্চয়ই বাবুনগরী-মামুনুলদেরও দেয়া হবে।

সরকার জানে কাকে কোন মন্ত্রে ঘায়েল করা যায়। আর মামুনুলদের নতুন অস্ত্রের ধার কমাতে সরকার পাল্টা মামলা অস্ত্র নিয়ে এসেছে। তিন মাস পর আল্লামা শফির মৃত্যুর ঘটনায় মামলা করা হয়েছে। শাপলা চত্বরের ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলো ৭ বছর পর সক্রিয় করা হচ্ছে। আমার ধারণা, মূলত বাবুনগরী-মামুনুলদের দর কষাকষির কাউন্টার হিসেবেই সরকারের নতুন-পুরোনো মামলার চাল। বাবুনগরী-মামুনুলরা সরাসরি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের ওপর হামলা করে হাই স্টেকে জুয়া খেলতে চেয়েছিলেন। নতুন-পুরোনো মামলার চাপ তাদের বাজির দর একটু কমিয়ে দিতে পারে।

দুঃখটা হলো, আমরা সাধারণ মানুষরা ধর্মের নামে ব্যবসায়ীদের এই চাল বুঝি না। না বুঝেই লাফাই। আর তারা আমাদের বিশ্বাস, আমাদের অনুভূতি বিক্রি করে নিজেদের আখের গোছায়।

এইচআর/জেআইএম