ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

দুর্নীতি না থামলে দুর্দিন আসন্ন!

ব্যারিস্টার এবিএম আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার | প্রকাশিত: ০৯:১২ এএম, ২১ ডিসেম্বর ২০২০

ইতিহাসের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির দ্বিতীয় বিপ্লব বাকশাল প্রতিষ্ঠার সময় ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বলেছিলেন, "আজকে করাপশনের কথা বলতে হয়। এই বাংলার মাটি থেকে করাপশন উৎখাত করতে হবে। করাপশন আমার বাংলার কৃষকরা করে না। করাপশন আমার বাংলার মজদুর করে না। করাপশন করি আমরা বাংলার শিক্ষিত সমাজ। যারা আজকে ওদের টাকা দিয়ে লেখাপড়া করেছি। আজ যেখানে যাবেন করাপশন দেখবেন - আমাদের রাস্তা খুঁড়তে যান - করাপশন। খাদ্য কিনতে যান -করাপশন। বিদেশ গেলে টাকার ওপর করাপশন। তারা কারা? আমরা যে ৫% শিক্ষিত সমাজ, আমরা হলাম দুনিয়ার সবচেয়ে করাপ্ট পিপল,আর আমরাই করি বক্তৃতা। আমরা লিখি খবরের কাগজে, আমরা বড়াই করি......"

জাতির পিতার মহান আত্মত্যাগ ও অর্জন আমরা তুলে ধরতে পারি নাই, এমনকি তার আদর্শ ধারণ তো করিই নাই বরং তার নাম ও ছবি ব্যবহার করে হীনস্বার্থ হাসিল করছি। আজও আমাদের দেশের প্রধান সমস্যা দারিদ্রতা নয়, দুর্নীতি। ছাত্রনেতা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসা ব্যবসায়ী থেকে ধর্ম ব্যবসায়ী অর্থাৎ রাষ্ট্র থেকে ব্যক্তি প্রতিটি ক্ষেত্রে রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। অনস্বীকার্য যে, অনেক সৎ ও রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও সরকারি আমলাদের রক্ত-ঘাম, ত্যাগ-তিতিক্ষায় এই আধুনিক উন্নত বাংলাদেশ। তবু্ও অভিযোগ রয়েছে, কিছু অখ্যাত 'রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী এবং আমলা'র যোগসাজশের ত্রিপক্ষীয় সিন্ডিকেট অনিয়মের সাথে জড়িত।

উন্নয়ন প্রকল্পের যেনতেন কাজ করে অর্থ উত্তোলন অথবা নিম্নমানের অ-টেকসই কাজ করে বারবার টেন্ডার দিয়ে বিল বানানো হয়। এমনকি কিছু অসাধু ঠিকাদার বাস্তবিক কাজ না করেই শুধু পেপার ওয়ার্ক দেখিয়ে অর্থ তুলে নেয়! এই অবৈধ কাজগুলো কেবল রাজনৈতিক নেতা বা ঠিকাদার একক ভাবে নয়, বরং সরকারি কর্মচারীদের সহিত আঁতাত ছাড়া সম্ভব নয়। আর রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় ছাড়া সরকারি কর্মচারীদের পক্ষেও দুর্নীতি করা অনেক দুরূহ। যদিও রাজনৈতিক নেতা, এমপি মন্ত্রীদের জবাবদিহিতার শেষ নাই এবং প্রত্যেক পাঁচ বছর পর নির্বাচনের মাধ্যমে মানুষের আস্থা অর্জন করে আসতে হয় ও থাকতে হয়। কিন্তু একজন সরকারি কর্মচারীকে সমর্থন আদায় করে চাকরিতে টিকে থাকার দরকার হয় না।

তবে কোন সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত এবং দুদকে অভিযোগ দিতে হবে, মামলা করতে হবে। কিন্তু অভিযোগ প্রমাণের পরও অভিযুক্তকে বদলি বা ওএসডি বা সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়, যা কোন শাস্তি নয়। বঙ্গবন্ধু 'আমার দেখা নয়া চীন' বইয়ে বলেন, ঘুষ খাওয়ার অপরাধে সরকারি কমচারীকে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল। সেই হতে কর্মচারীদের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার হয়েছে। কেউই ঘুষ খেতে সাহস পায় না (পৃষ্ঠা ৯০)। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, চীনের প্রেসিডেন্ট মাও সে তুং এর বন্ধু দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হলে তিনি কোন হস্তক্ষেপ করেননি এবং তার ফাঁসি হয় (পৃষ্ঠা ১০৪)!

বিশ্ব রাজনীতির গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘পিপলস অ্যান্ড পলিটিক্স’ ১৭৩ টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের মধ্যে সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন ও সৎ সরকার প্রধান হিসেবে এই তালিকায় তৃতীয় স্থানে আছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি মেধা, যোগ্যতা, দক্ষতা এবং সততার সহিত দেশ পরিচালনা করে শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে নয় সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ উন্নতির শিখরে! বাংলাদেশ আজ একটি সম্ভাবনার নাম। এডিবির 'কি ইনডিকেটরস ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্যা প্যাসিফিক 'শীর্ষক প্রতিবেদনে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশ এখন এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ১৩তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকারে গত দুই যুগে সিঙ্গাপুর ও হংকংকে ছাড়িয়ে বাংলাদেশ এই অবস্থানে উঠলো।

'দ্য স্পেক্টেটর ইনডেক্স' কর্তৃক প্রকাশিত ২০০৯ থেকে গত ১০ বছরে জিডিপিতে কারেন্ট প্রাইস মেথডে (চলতি বাজার মূল্য) বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার বিশ্বের সবদেশের উপরে শতকরা ১৮৮ভাগ। বিশ্বব্যাংকের সহজ ব্যবসা সূচক বা 'ইজ অব ডুয়িং বিজনেসে' সবচেয়ে বেশি উন্নতি করেছে এমন ২০ টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশও আছে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক (এডিও) ২০১৯-এ বলা হয়েছে, "বাংলাদেশের অর্থনীতির দ্রুততম প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২০১৮ সালে, ৭.৯০ শতাংশ। এটি এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের ৪৫ টি অর্থনীতির মধ্যে দ্রুততম।" ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ আশা করা হয়েছিল, কিন্তু বৈশ্বিক মহামারির কারণে কাঙ্ক্ষিত অর্জন নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনোমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর) প্রকাশিত প্রতিবেদনে, ২০৩২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের বড় ২৫টি অর্থনীতির দেশের একটি হবে। তখন বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৪ তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। বর্তমানে অবস্থান ৪১ তম। ২০৩৩ সালে আমাদের পেছনে থাকবে মালয়েশিয়া, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশ। প্রণিধানযোগ্য, করোনাভাইরাসের মহামারিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা সংকটে থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৫ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে! এসকল মানদণ্ড বাংলাদেশের বর্ধনশীল অর্থনীতির উজ্জ্বল দিকই নির্দেশ করে।

শিক্ষা যদি হয় জাতির মেরুদণ্ড, তাহলে অর্থ দেশের মেরুদণ্ড! অদূর অতীতে ২০০৬-০৭ সালে ইউরোপ আমেরিকায় চরম অর্থনৈতিক মন্দা পরিলক্ষিত হয় এবং গ্রীসকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বেল আউট সহায়তা করে বিপর্যস্ততা থেকে রক্ষা করে। বর্তমানে পাকিস্তানে সামরিক ও বেসামরিক খাতে প্রকাশ্যে সরকারি দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্রীয় ভাবে দেউলিয়া ঘোষণা সময়ের ব্যাপার মাত্র। দেশে সবক্ষেত্রের লাগামহীন আর্থিক অনিয়মের ক্ষতি কাটিয়ে অগ্রসর হতে পারবে কি সবেমাত্র মধ্যম আয়ে উন্নিত বাংলাদেশ? অর্থ পাচারে বিশ্বের শীর্ষ ৩০ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। প্রতি বছর গড়ে পাচার হয়েছে প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা।

দুঃখজনক; আমাদের দেশের দায়িত্বশীল ব্যক্তিগণ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বলতে নিজেদের সন্তান বোঝেন, জনগণ নয়! তাই তারা নিশ্চিত জীবনের আশায় দেশের মায়া ত্যাগ করে গরীব মানুষের রক্তচোষা টাকা কানাডা মালেয়শিয়াসহ বহুদেশে অর্থ পাচার করে সেকেন্ড হোম বানিয়েছেন! তাই নিউইয়র্কের নাগরিক সংবর্ধনায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'আমরা ব্যাপকভাবে উন্নয়ন প্রকল্প নিচ্ছি। যে পরিমাণ উন্নয়ন প্রকল্প আমরা নিচ্ছি তার প্রতিটি টাকা যদি সঠিকভাবে ব্যয় হতো, ব্যবহার হতো, তবে আজকে বাংলাদেশ আরও অনেক বেশি উন্নত হতে পারতো। এখন আমাকে খুঁজে বের করতে হবে এখানে কোথায় লুপহোল, কোথায় ঘাটতিটা, কারা কোথায় কীভাবে এই জায়গাটা ক্ষতিগ্রস্ত করছে।' আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে ওনার জিরো টলারেন্স অবস্থান আজ দৃশ্যমান।

সর্বশেষ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন কানাডার টরন্টোতে অর্থ পাচার বিষয়ে যে তথ্য প্রকাশ করেন, তার ২৮টির মধ্যে রাজনীতিবিদ চারজন আর কিছু পোশাকশিল্পের ব্যবসায়ী। কিন্তু সংখ্যার দিক থেকে অনেক বেশি সরকারি কর্মচারীর বাড়িঘর সেখানে আছে এবং তাদের ছেলেমেয়েরা সেখানে থাকে। এই তথ্য যেমন সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আগের অভিযোগ সত্য প্রমাণ করেছে তেমনি দেশের অধিকাংশ মানুষ হতচকিত ও হতাশ হয়েছেন। কারণ সকলের ধারণা ছিল রাজনীতিবিদদের সংখ্যা বেশি হবে। যদিও এটি সামগ্রিক তথ্য নয় এবং পাচারে শুধু কানাডা নয়, মালয়েশিয়াতেও একই অবস্থা। তারপরও হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হওয়ার যে তথ্য বের হয়, সংখ্যাটি তত নয়।

আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিও কম দায়ী নয়। দুর্নীতিবাজ ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের তৈলমর্দন করি এবং উৎসাহও দেই! বঙ্গবন্ধু বর্ণনা করেছেন, এক ছেলের সরকারি চাকুরি নিয়ে তার পিতা বলেন, "একশত টাকা বেতন পায় আর কিছু উপরিও আছে।" এই কথা শুনে বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি প্রকাশ করেন যে, "ভেবে দেখুন, সমাজ কোথায় গিয়াছে! ছেলে ঘুষ খায় পিতা তাহা গর্বের সাথে ঘোষণা করে। সমাজ কত নেমে গেলে এই অবস্থায় আসতে পারে (আমার দেখা নয়া চীন, পৃষ্ঠা ১০৬)!"

এর অর্থ হলো প্রশাসন থেকে সমাজ সব জায়গায় মন ও মগজের পরিবর্তন দরকার। সোনার বাংলা গড়তে বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই হাঁটতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না ১৯৭৫ সাল পরবর্তীতে সরকার স্বয়ং অপরাধীদের ইনডেমনিটি দেয় এমনকি পুরস্কৃতও করেছে! তবে আশার কথা, বর্তমান সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ অনেক বড় পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট! তাই শুধু ছিদ্রান্বেষীর মতো সমালোচনাই করা নয় গঠনমূলক আলোচনাও প্রয়োজন।

লেখক : ব্যারিস্টার, ডেপুটি এটর্নি জেনারেল, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ও আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট।

এইচআর/জেআইএম