স্বপ্নের সেতু পদ্মা ও স্বপ্নসারথি শেখ হাসিনা
‘তোমাকে অভিবাদন বাংলাদেশ, তোমাকে অভিবাদন শেখ হাসিনা’ আজি দেশের সকল মানুষের হৃদয়ে হৃদয়ে, আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। যার দু’চোখভরা স্বপ্ন শুধু এই বাংলাদেশের জন্য, যিনি নিজে স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন দেখান এবং স্বপ্নপূরণ করেন সেই স্বপ্নসারথি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর সাথে সারাদেশের মানুষ ধৈর্য ধরে প্রহর শুনেছে, গুনেছে এক-একটি পিলার ও স্প্যান, অপেক্ষার বেলা শেষে আশার ভেলা ভাসিয়ে পদ্মার বুকে ভেসে উঠেছে নতুন সেতু! দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকে ছাপিয়ে সবথেকে বড় অর্জন ভাবমূর্তি আত্মমর্যাদা ও আত্মবিশ্বাসের জানান দিয়েছে বাংলাদেশ, আজ মাথাউঁচু করে বাঁচতে শিখেছে বাংলাদেশ। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ সৃষ্টি করলো আরও এক বিস্ময়! বিদেশি কোনো দেশ বা দাতাসংস্থার সাহায্য ছাড়া বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ ও অনন্য বৈশিষ্ট সম্পন্ন সেতু বানিয়েছে বাংলাদেশ! বাংলাদেশ এখন সাফল্যের প্রতীক, সামর্থ্যের প্রতীক, সমৃদ্ধির প্রতীক সম্মানের প্রতীক।
বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষা বলছে, দেশের প্রায় তিন কোটি মানুষ সরাসরি উপকৃত হবে এই সেতু থেকে। আর এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) জরিপ অনুযায়ী দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়বে ১.২ শতাংশ। এই সংস্থার গবেষণা মতে সেতুর বিনিয়োগ রিটার্ন উঠে আসবে বছরে ১৮ থেকে ২২ শতাংশ এবং বছরে দারিদ্র্য কমবে ২.৯ শতাংশ। গড়ে ১০০ কিমি দূরত্ব কমবে রাজধানীর সাথে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের। এই সেতু দিয়ে একদিকে সমুদ্রপথের নতুন দ্বার পায়রা বন্দরের সঙ্গে ঢাকার অপরদিকে এশিয়ান হাইওয়ের মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে সরাসরি সংযুক্ত করবে। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে গড়ে উঠছে নানা অবকাঠামো নতুন শিল্পকারখানা, উঁকি দিচ্ছে শিল্প বিপ্লবের নতুন সম্ভাবনা। কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হবে প্রায় দুই কোটি মানুষ।
২০১১ সালে সরকার বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণ চুক্তিবদ্ধ হয় বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংক প্রথমেই অভিযোগ তোলে প্রকল্পে আগাম দুর্নীতি হয়েছে। শুধু বিশ্বব্যাংককে সন্তুষ্ট করতে কোনো ধরনের প্রমাণ না থাকা সত্বেও প্রকল্পের স্বচ্ছতা নিয়ে যেন কোনো বিতর্ক সৃষ্টি না হয় সে জন্য বীনাদোষে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয় তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী ও প্রকল্প পরিচালককে। এমনকি সংশ্লিষ্ট সচিবসহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়। তবু্ও অনড় অবস্থানে থাকে বিশ্বব্যাংক, কারণ বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিক বাংলাদেশকে ব্যবহার করেন ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক ভাবমূর্তি সংকট উত্তরণের হাতিয়ার হিসেবে। তিনি দেখানোর চেষ্টা করেন সুশাসনের জন্য দুর্নীতির বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর। তাই বাংলাদেশের মতো দুর্বল অর্থনীতির দেশের বিরুদ্ধে যার পাশে অন্যকোনো দেশ প্রতিবাদে এগিয়ে আসবে না। কিন্তু ভুল ভাঙিয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ত্বরিত প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘যেখানে একপয়সাও ছাড় হয়নি সেখানে দুর্নীতির কথা বলে ঋণ বন্ধ করে দেয়া, উন্নয়ন বন্ধ করা, অর্থাৎ আমাদের উন্নয়ন যেন আমরা করতে না পারি সেদিকে আমাদের পিছিয়ে নেয়া। এটা আমরা কি করে মেনে নেব, এটা আমরা কখনোই মেনে নিতে পারি না। কোনো বাঙালি এটা মেনে নিতে পারবে না।’
আর বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে এমন অভিযোগ তুলে ২০১২ সালে ১২০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি বাতিল করে। এ সময় শুরু হয় ষড়যন্ত্রের খেলা। বিশ্বব্যাংকের চাপে জাইকা, এডিবিসহ দাতাসংস্থাগুলোও সরে দাঁড়ায়। বিশ্বেদরবারে বাংলাদেশকে পরিচিত করানো হতে থাকে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে। আর এই অপপ্রচারে যোগ দেয় খোদ নিজ দেশের আন্তর্জাতিক ‘তকমা’ পাওয়া বুদ্ধিজীবী তথাকথিত সুশীল সমাজের একটি অংশ এবং বিশেষ ধরনের রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিগণ। আওয়ামী লীগ সরকারের ইমেজকে প্রশ্নবিদ্ধ ও কলঙ্কিত করা হয়। বিএনপিসহ দেশের সুশীল সমাজ সরকারের সমালোচনায় মেতে ওঠে। বিএনপি নেত্রী বলেছিলেন, ‘বিদেশ থেকে যেসব টাকা দিয়েছিল, সব টাকা খেয়ে ফেলেছে। আওয়ামী লীগ সরকার কখনোই পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে পারবে না।’ খালেদা জিয়া পদ্মা সেতু চায়নি তা প্রমাণ হয়েছে ও তার কথাও মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
এদিকে ওকাম্পোর ফাঁস হওয়া ইমেইল এবং কূটনৈতিক বার্তায় দেখা যায় যে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তত তিনবার ইমেইলে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনকে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধের জন্য বিশ্বব্যাংককে চাপ দেয়ার অনুরোধ করে লিখেছেন, ‘পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ হলে সরকার গ্রামীণ ব্যাংক প্রশ্নে নমনীয় হবে। ড. ইউনূসের এই অনুরোধের প্রেক্ষিতে হিলারি বিশ্বব্যাংকের বিদায়ী ও নতুন প্রেসিডেন্টকে ন্যূনতম অভিযোগ থাকলেও অর্থায়ন বন্ধ করার পরামর্শ দেন। ভাবতে অবাক লাগে, কীভাবে একজন নোবেলজয়ী নিজস্বার্থে নিজ দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে, দেশের মানুষকে কষ্টে রাখতে চায়। এই চক্রের দেশপ্রেম বলে কিছুই নেই, দেশের মানুষের প্রতি কোনো ভালোবাসা নেই। তাদের দ্বারা দেশ ও জাতির কখনোই কোনো কল্যাণ হতে পারে না।
দেশের এই আত্মমর্যাদার সংকটের কঠিন পরিস্থিতিতে সাহসী সিদ্ধান্ত নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিজেই পথ দেখিয়ে ২০১২ সালে জাতীয় সংসদে তুলে ধরেন কীভাবে নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণ সম্ভব। তিনি বলেন, ‘একই সময়ে একসাথে টাকা লাগছে না, আমাদের উন্নয়নের যে পঞ্চান্ন হাজার কোটি টাকা আছে, সেখান থেকে আমরা আমাদের কাজ শুরু করতে পারি।’ গল্প হলো সত্যি, দুর্নীতির অপবাদ থেকে মুক্ত হয়ে মাথানত না করে ছোট অর্থনীতির দেশের প্রধানমন্ত্রী হবার সীমাবদ্ধতার সীমানা ছাড়িয়ে মাথাউঁচু করে লড়তে জানা বাঙালি জাতির প্রকৃত নেতার সাহস নিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ঘুরে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘কারও কাছে ভিক্ষা চেয়ে নয়, হাত পেতে নয় আমরাও যে পদ্মা সেতুর মতো এ রকম একটা বিশাল সেতু নিজস্ব অর্থায়নের নির্মাণ করতে পারি এবং কর্মক্ষমতা যে বাংলাদেশ অর্জন করেছে এটা হচ্ছে সবথেকে বড় কথা।’
উল্লেখ্য, কানাডার আদালতে প্রকল্পের চুক্তিভিত্তিক কোম্পানি এসএনসি লাভালিনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে একটি মামলা হয়। কিন্তু ২০১৭ সালে গ্লোব অ্যান্ড মেইলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্টারিও কোর্টের বিচারক ইয়ান নরডেইমার পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ পাননি। আর সে-বছরই সেতুর প্রথম স্প্যান বসিয়ে উন্নয়ন এবং সমস্যা সমাধানে শেখ হাসিনার শ্রেষ্ঠত্ব বিদেশিদের চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে উঠে আর তার নেতৃত্বের গ্রহণযোগ্যতা দেশের মানুষের কাছে সকল সময়ের সীমা অতিক্রম করে যায়। সবকিছু মোকাবিলা করে শুধু নিজের ওপর বিশ্বাস রেখে নিজে আত্নবিশ্বাসী হয়ে নিজস্ব অর্থায়নের নিজেদের সেতু পদ্মা সেতু বাস্তবায়িত হলো।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বাংলাদেশকে যেখানে দাঁড় করিয়েছেন, তা এক অসম্ভব সাফল্য, যা অনেকের কাছে অকল্পনীয় আবার অনেকের কাছে ঈর্ষণীয়। মনে রাখতে হবে যে, সাফল্যের হাত ধরেই ছায়ার মতো ষড়যন্ত্র হাঁটে, তবে থেমে গেলে ষড়যন্ত্রকারীরা জিতে যাবে। তাই এক্ষেত্রে Winston Churchill এর একটি উক্তি দিয়ে শেষ করছি, ‘You will never reach your destination if you stop and throw stones at every dog that barks.’
লেখক : ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
এইচআর/বিএ/এমএস