ভাস্কর্য নিয়ে মনগড়া ফতোয়াবাজি বন্ধ হোক
শহীদুল হক
সম্প্রতি ঢাকার ধোলাইপাড়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ভাস্কর্য স্থাপনের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন, হেফাজতে ইসলাম এবং অন্যান্য কতিপয় আলেম ওলেমা ভাস্কর্য ও মূর্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন। ফতোয়া দিচ্ছেন। বিবৃতি দিচ্ছেন। সমাবেশ ও মিশিল করছেন। তাঁদের বক্তব্য ভাস্কর্য ও মূর্তি ইসলাম বিরোধী। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে ভাস্কর্য ও মূর্তি নিষিদ্ধ। তারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ করলে তা ভেঙ্গে ফেলার হুমকিও দিচ্ছেন। কুষ্টিয়াতে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙ্গেও ফেলেছে। কেউ কেউ মানুষ ও প্রাণির সকল ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলার হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন।
অপরপক্ষে আওয়ামীলীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এবং দেশের প্রগতিশীল ও সুস্থ মননশীল ব্যক্তিবর্গ ঐ আলেমদের বক্তব্যকে খণ্ডন করে বলছেন ভাস্কর্য ও মূর্তি এক নয়। তাঁরা ভাস্কর্য বিরোধী মহল বিশেষের তৎপরতাকে উদ্দেশ্যমূলক এবং কোন কোন ডানপন্থী রাজনৈতিক দলের ইন্ধন ও ষড়যন্ত্র বলে মনে করছেন।
ভাস্কর্য বাংলাদেশে নতুন কিছু না। সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই এ দেশে নানা রকম ভাস্কর্য তৈরি ও স্থাপন করা হয়েছে। কোনটি ইনডোরে, কোনটি জাদুঘরে, কোনটি কোন প্রতিষ্ঠানের সামনে এবং কোনটি সড়ক ও মহাসড়কের পাশে।
এতদিন ভাস্কর্য নিয়ে ঐ শ্রেণির আলেম ও অতি ইসলামী ব্যক্তিবর্গের কোন আপত্তি উত্থাপন করেনি। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের কথা শুনেই তাদের নিদ্রা ভঙ্গ হয়েছে। তাদের চোখ কপালে উঠেছে। কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন। এটাই তাদের প্রকৃত রুপ। এদেশের আলেম সমাজ মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতার পক্ষে তেমন কোন ভূমিকা নিয়েছিলেন বলে আমার জানা নেই। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ, হত্যাকাণ্ড, মা বোনের ইজ্জত লুটে নেয়ার বিরুদ্ধে তাদের একটি বিবৃতি দেয়ার কথাও শুনিনি। বরং তাদের অনেকেই পাকিস্তান বাহিনীর দোসর হিসেবে কাজ করেছিল। তাই তাদের অনেকেরই মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পারেনি। সুযোগ পেলেই তারা তাদের আসল রুপটি প্রকাশ করে।
ভাস্কর্য আর মূর্তি বা প্রতিমা এক নয়। মূর্তি বা প্রতিমা মৃৎশিল্পীদের তৈরি একটি শিল্পকর্ম। প্রাচীন হিন্দু ধর্মের বিশ্বাসী হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা ঐশ্বরিক শক্তির প্রতিভূ হিসেবে প্রতিমা তৈরি করে তা উপাস্য মনে করে পূজা করে থাকে।
অপর পক্ষে ভাস্কর্য চারুকলার একটি শাখা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও চারুকলা অনুষদে ভাস্কর্য একটি বিভাগ আছে। বিশ্বের সকল দেশেই উচ্চ বিদ্যাপীঠে চারুকলা ও ভাস্কর্য ডিপার্টমেন্ট আছে। ভাস্কর্য একটি শিল্প যা মনের মধ্যে অংকিত একটি প্রতিচ্ছবির বাস্তব রুপায়ণ। অর্থাৎ একজন শিল্পীর সৃজনশীল মেধার বিকাশ ও কল্পনার বাস্তব শিল্পকমটিই ভাস্কর্য। এ সৃষ্টির মধ্যে আছে মানসিক প্রশান্তি। সৃষ্টির আনন্দ। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতি বছর ভাস্কর্যের উপর ডিগ্রি ও মাস্টার্স ডিগ্রি নিচ্ছেন। কর্মক্ষেত্রে ও সমাজে তাদের শিক্ষার ব্যবহারিক প্রয়োগ করে ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সামাজিক পটভূমিকে বিচিত্র ভাস্কর্যের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলছেন।
ভাস্কর্য একটি শিল্পকলা বিধায় পৃথিবীর সকল দেশেই সমাদৃত। মুসলিম দেশগুলোতেও ভাস্কর্য আছে। এমন কোন মুসলিম দেশ নেই যেখানে ভাস্কর্য নেই। সৌদি আরব, কাতার, কোয়েত, ইরান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, মিশর, তুরস্ক, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া অর্থাৎ সকল মুসলিম রাষ্ট্রেই ভাস্কর্য দেখা যায়। ঐ সব দেশের জনগণ তো ভাস্কর্য নিয়ে কোন বিতর্ক তুলছে না। কিন্তু আমাদের দেশে কেন?
মূর্তি বা প্রতিমা ইসলামে নিষিদ্ধ। ভাস্কর্যকে যদি মূর্তি হিসেবে ধরা হয় তবে তাও ইসলামে নিষিদ্ধ। কিন্তু ভাস্কর্য মুসলিম দেশগুলোর সংস্কৃতির অংশ হিসেবে যেভাবে মিশে গেছে তা থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়। মানুষ এটা গ্রহণও করে নিয়েছে। মুসলিম দেশগুলোতে ভাস্কর্য সংস্কৃতি নিয়ে কেউ প্রতিবাদও করে না। যদি ভাস্কর্য তৈরি ইসলামে নিষিদ্ধই হত তবে মুসলিম দেশগুলোর আলেম ওলেমা কেন প্রতিবাদ বা ভাস্কযের্র বিরোধিতা করছেন না? এর জবাবে আমাদের দেশের এক শ্রেণির হুজুররা বলছেন কোন দেশ শরীয়তের পরিপন্থী কাজ করলে তা অনুসরণ করা যাবে না। তাহলে পৃথিবীর সকল মুসলিম দেশই শরীয়ত পরিপন্থী কাজ করছে?
আমাদের দেশের এক শ্রেণির আলেম অনেক বিষয়েই নিজের মনগড়া ফতোয়া দিয়ে থাকেন। কোরআন হাদিসের ব্যাখ্যাও নিজের মত করে থাকেন। আমাদের অনেকেরই মনে থাকার কথা এ দেশের আলেমরা ছবির বিরুদ্ধে কঠোর বক্তব্য দিয়েছিলেন। টেলিভিশনকে শয়তানের বাক্স বলতেন। মাইকে আজান দেয়া ও মাইকে কোরআন পড়াকে বেদাত বলতেন। এখন মোল্লারা নিজেরা ছবি তোলেন। ছবি বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করেন। টেলিভিশনে পবিত্র মক্কা ও মদিনার হেরেম শরীফের হজ্ব, ওমরা ও নামাজের লাইভ প্রোগ্রাম ২৪ ঘণ্টায় দেখা যায়। হুজুররা টেলিভিশনকে এখন আর শয়তানের বাক্স বলেন না। মাইকে আজান দেন, নামাজ ও পবিত্র কোরআনও পড়েন। নিজেদেরকে ওয়াজ মাহফিলে টেলিভিশন ও সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখানোর ব্যবস্থা করেন। ইংরেজি শিক্ষা ইসলামে নিষেধ বলে কাঠ মোল্লারা ফতোয়া দিয়ে মুসলমানদেরকে পিছিয়ে রেখেছিলেন। শুধু তাই না জমিতে সার দেয়া এবং সেচের মাধ্যমে জমিতে পানি দেয়াকে নিয়েও তারা একসময় বিতর্ক সৃষ্টি করেছিলেন।
মূর্তি বা প্রতিমা ইসলামে নিষিদ্ধ কেন করা হয়েছে? ইসলাম ধর্ম মতে মূর্তিকে যদি ঐশ্বরিক শক্তি মনে করে উপাস্য বিবেচনায় পূজা করে তবে তা শিরক হবে। অর্থাৎ মূর্তিকে আরাধ্য মনে করলে আল্লাহর সাথে শিরক করা হয়। এটি কবিরা গুনাহ। আইয়ামে জাহেলিয়া যুগে মানুষ মূর্তিপূজা করে শেরেক করত বলে মূর্তি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল মানুষ যেন শিরক না করে। কিন্তু ভাস্কর্য হল একজন শিল্পীর নিজস্ব কল্পনা ও চিন্তা চেতনার বা সৃজনশীলতার পরিচায়ক শিল্পকর্ম। প্রত্যেকটি ভাস্কর্য ইতিহাস, সংস্কৃতি, সামাজিক আচার ইত্যাদি সংক্রান্ত বার্তা দেয়। এটা মানুষের মনের সৌন্দর্য্যের বাহ্যিক প্রকাশিত সৃষ্টি। এটাকে উপাস্য হিসেবে গণ্য করা হয় না। ভাস্কর্য উপাস্য হিসেবে বিবেচিত না হলে তার সাথে ইসলামের কোন সাংঘর্ষিক সম্পর্ক থাকার কথা নয়। তাই সকল মুসলিম দেশেই ভাস্কর্য দেখা যায়।
মূর্তি বা প্রতিমাই বা কেন ভাঙতে হবে। এটা তো হিন্দু সম্প্রদায়ের উপাস্য। ইসলাম ধর্মে তো অন্য ধর্মের লোকের উপাসনালয় ও উপাস্য বস্তুর উপর হামলা করা বা সেটি ধ্বংস করা নিষেধ করা হয়েছে। হযরত মুহাম্মদ (সা) মদিনা সনদের মাধ্যমে সকল ধর্মের লোকের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও নিজ নিজ ধর্ম পালন নিশ্চিত করেছিলেন। সূরা ইব্রাহীমের ৩৬ নং আয়াতে যা আছে তা নিন্মরূপ-
“হে আমার প্রতিপালক। এসব প্রতিমা বহু মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে, সুতরাং যে আমার অনুসরণ করবে সেই আমার দলভুক্ত হবে, কিন্তু কেউ আমার অবাধ্য হলে আপনি তো নিশ্চয় ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।”
৩৬ নং আয়াতের এ কথাগুলো হযরত ইব্রাহীম আঃ মহান আল্লাহর সমীপে পেশ করেছিলেন। ঐ আয়াতেই আছে যারা প্রতিমা পূজা ছাড়বে না তাদের আল্লাহই বিচার করবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।
সুতরাং সম্মানিত আলেমদের উত্থাপিত পবিত্র কোরআনের আয়াতের পর্যালোচনায় দেখা যায় প্রতিমা পূজার মাধ্যমে আল্লাহর শরীক করা ইসলামে নিষিদ্ধ। ভাস্কর্যকে উপাস্য হিসেবে আল্লাহর শরীক করা হয় না। তাহলে ভাস্কর্য কেন ইসলাম বিরোধী হবে? কোরআন হাদিসের মনগড়া ও আংশিক আয়াতের ব্যাখ্যা দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করাও কি ধর্ম ও নৈতিকতা বিরোধী নয়?
২০১২-২০১৩ সালে এক শ্রেণির ব্লগারের উত্থান হয়েছিল। কিছু কিছু বিকৃত মানসিকতার ব্লগার তাদের ব্লগে ইসলাম ধর্ম ও মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) নিয়ে নানারকম কুৎসিত ও আপত্তিকর লেখা লিখে ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের ধর্মীয় সেন্টিমেন্টে আঘাত হেনেছিল। সে কারণে আলেম সমাজ প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল।
শুধু আলেম সমাজ কেন কোন মুসলমানই ঐ সকল আপত্তিকর লেখা সহ্য করে নাই। প্রতিবাদেও ঝড় উঠেছিল। দেশে আইন আছে। কেউ কথা, লেখনী বা অন্য উপায়ে কোন দর্মীয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয় সেন্টিমেন্টে আঘাত হানে তা হবে ফৌজদারী অপরাধ। এই অপরাধে অনেকের বিরূদ্ধে মামলাও হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছে। পুলিশ বাদী হয়েও মামলা করেছিল। আমি সব সময়ই ব্লগারদের ধর্মবিরোধী লেখনীর বিরুদ্ধে কথাও বলেছি। বলেছিলাম, তারা ইসলাম ধর্ম ও নবীজীকে ছাড়া লেখার অন্য কোন বিষয় খুঁজে পান না? ধর্মীয় সেন্টিমেন্টে আঘাত করে এমন সব লেখার লেখকদের বিরুদ্ধে পুলিশ কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নিবে। বাস্তবে নিয়েছিলামও। প্রকাশকদেরকে অনুরোধ করেছিলাম ধর্মীয় সেন্টিমেন্টে আঘাত আসতে পারে এমন কোন লেখা বা পুস্তক যেন তারা প্রকাশ না করে। কারণ তা হবে আইন বিরোধী এবং তাতে আইন শৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কা থাকে।
২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজত ইসলাম ঢাকা মহানগরীতে ভয়াবহ তাণ্ডব করেছিল, অসংখ্য গাড়ি পুড়িয়েছিল, দোকানপাট লুট করেছিল ও পুড়িয়েছিল, অনেকগুলো পবিত্র কোরআন শরীফও পুড়িয়েছিল, আইল্যান্ডের গাছগুলো কেটে ধ্বংস করেছিল, ট্রাফিক পুলিশ অফিসে আগুন দিয়ে পুলিশকে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করেছিল, রাতে একজন পুলিশ অফিসারকে হত্যাও করেছিল। সেই তাণ্ডবের কথা মনে হলে অনেকেরই গা শিউরে উঠে।
হেফাজতের নেতারা তখন বলেছিল বিএনপি ও জামায়াত পন্থী আলেমরা বিএনপি ও জামায়াতের সাথে যোগাযোগ করে ধ্বংসাত্মক ও অপকর্মগুলো করেছিল। হেফাজতের মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী আদালতে ফৌজদারী কার্যবিধি ১৬৪ ধারায় ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে দেয়া জবানবন্দিতেই এ কথাগুলো বলেছিলেন। এবারও কি নেপথ্যে কোন রাজনৈতিক দল ইন্ধন দিচ্ছে? বিষয়টি খতিয়ে দেখার প্রয়োজন।
ভাস্কর্যের পক্ষে ও বিপক্ষে বক্তব্য বিবৃতি, সমাবেশ-মিছিল, মানববন্ধন করে দেশের মধ্যে একটা উত্তপ্ত পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। এতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশংকা সৃষ্টি হয়েছে। দায়িত্বশীল আলেম সমাজ পবিত্র কোরআন ও হাদিসের সঠিক ব্যাখ্যা দিয়ে দেশের আইন শৃঙ্খলা ও উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখবেন এটাই শান্তিপ্রিয় জনগণের প্রত্যাশা।
লেখক : সাবেক ইন্সপেক্টর জেনারেল, বাংলাদেশ পুলিশ।
এইচআর/এমএস