পিএসসির বিসিএসের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি হতাশাজনক
গত ৩০ নভেম্বর ২০২০ তারিখে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) ৪৩তম সাধারণ বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে, যেখানে ১ হাজার ৮১৪ জনকে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগ দেয়া হবে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, আবেদন পত্র পূরণ ও ফি জমাদান শুরু হবে আগামী ৩১ ডিসেম্বর, ২০২০ তারিখে এবং আবেদন পত্র জমাদানের শেষ সময় নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০ জানুয়ারি ২০২১। প্রিলিমিনারি পরীক্ষার সম্ভাব্য সময় হিসেবে আগামী বছরের মার্চ মাসকে উল্লেখ করা হয়েছে। (তথ্যসূত্র: ৩০ নভেম্বর ২০২০, প্রথম আলো)
অন্যদিকে, ৮ মার্চ ২০২০ তারিখে বাংলাদেশে করোনা আক্রান্ত সর্বপ্রথম রুগী চিহ্নিত হবার পর এই ভাইরাসের বিস্তার রোধে বাংলাদেশ সরকার ১৭ই মার্চ, ২০২০ থেকে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছে এবং সেই ছুটি বিভিন্ন ধাপে বাড়িয়ে সর্বশেষ ১৯ ডিসেম্বর, ২০২০ পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। যার কারণে, দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস সমূহ অনলাইনে চললেও সব ধরণের পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে এবং অনেক বিভাগের ৪র্থ বর্ষ সম্মান ফাইনাল ও মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষাগুলো দুর্ভাগ্যজনকভাবে আটকে গিয়েছে। (তথ্যসূত্র: ১২ নভেম্বর ২০২০, বিবিসি নিউজ, বাংলা)
শুধু তাই-ই নয়, করোনার বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে ২০২০ সালের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষাসমূহ বাতিল করে জেএসসি ও এসএসসির ফলাফলের ভিত্তিতে উচ্চশিক্ষা লাভের মানদণ্ড নির্ণয়ের গুরুত্বপূর্ণ এই পরীক্ষার ফলাফল আগামী ২০ থেকে ২৫ ডিসেম্বর, ২০২০ এর মধ্যে প্রকাশ করা হবে। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি সাম্প্রতিক সময়ে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ দ্বিতীয় দফায় বাড়ছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং বলেছেন, করোনাভাইরাসের প্রকোপ না কমলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা হবে না। বরং আগামী বছরে এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষাও পিছিয়ে যেতে পারে তিনি আশংকা প্রকাশ করেছেন (তথ্যসূত্র: ২৬ নভেম্বর, ২০২০, কালের কণ্ঠ)।
করোনার বর্তমান পরিস্থিতিতে সোনালী ব্যাংক লিমিটেড, জনতা ব্যাংক লিমিটেড, রূপালী ব্যাংক লিমিটেড, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন বাংলাদেশ ও কর্মসংস্থান ব্যাংক ৫ ডিসেম্বর, ২০২০ তারিখে সমন্বিত পরীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছিল। এই পরীক্ষাগুলো রাজধানীর ৬৭ টি কেন্দ্রে হবার কথা ছিল, কিন্তু করোনার প্রকোপ বৃদ্ধির কারণে ইতোমধ্যে এই পরীক্ষা স্থগিত করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে (তথ্যসূত্র: ১৯ নভেম্বর ২০২০, প্রথম আলো)।
এদিকে চলতি বছরের জুলাই মাস থেকে অধিকাংশ পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে ক্লাস নেয়া শুরু করলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের পরীক্ষা কার্যক্রম কিভাবে পরিচালিত হবে সেই বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। বছরের শেষ সময়ে এসে বিভিন্ন বর্ষের অসম্পূর্ণ পরীক্ষাগুলো কিভাবে শেষ করা যায় সেই বিষয়ে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের ডিন এবং বিভাগীয় চেয়ারম্যানগনদেরকে একটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা এবং যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য উপাচার্য মহোদয়গণ নির্দেশ দিয়েছেন।
করোনার বর্তমান পরিস্থিতিতে যেখানে সকল পাবলিক পরীক্ষা স্থগিত করে দেয়া হচ্ছে, সেখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪র্থ বর্ষ সম্মান ফাইনাল ও মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষাগুলো ৩০ জানুয়ারী, ২০২১ তারিখের মধ্যে শেষ করে দেয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে যে আবেদন আসছে তা সত্যিই উদ্বেগজনক। মাত্র দু'মাসের মধ্যে কোনো পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই পরীক্ষা কমিটিরগুলির জন্য এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা সকল সংক্রম ঝুঁকি এড়িয়ে আয়োজন ও অনুষ্ঠিত করা যেমন কঠিন, তেমনি ইতোমধ্যে মাস্টার্সের ক্লাসে যোগ দেয়া শিক্ষার্থীদের আগের পাঠ্যক্রমে ফিরে গিয়ে কোনো প্রস্তুতি-সময় না নিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে বাধ্য হওয়াটাও হতাশাজনক।
সবচে' বড় কথা একটি ব্যাচ এর সকল শিক্ষার্থীই বিসিএস পরীক্ষায় বসে না, আবার অনেকেই আছেন যারা অর্থনৈতিক মন্দা ও আবাসন সংক্রান্ত বিভিন্ন কারণে নাজুক অবস্থায় আছে; তারা বিশ্বজুড়ে এই তীব্র ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে যথোপযুক্ত আবাসন ও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত না করে বিশ্ববিদ্যালয় ও কর্ম কমিশন - এই দুই পরীক্ষায়ই বসার জন্য প্রস্তুত কিনা, সেটি যাচাই করা ভীষণ জরুরি। একটি শিক্ষার্থীর জন্যও যদি এটি ক্ষতিকর হয়, তবে এই দায় নেবে কে?
তাছাড়াও, পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে যদি কোনো শিক্ষার্থী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয় তাহলে কি হবে, আক্রান্ত শিক্ষার্থী থেকে তার সহপাঠীরা আক্রান্ত হতে পারে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আক্রান্ত হতে পারে। এই সকল স্বাস্থ্য ঝুঁকির দায়বদ্ধতা কার? এই দায়বদ্ধতা কি বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরীক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গরা এড়িয়ে যেতে পারবেন? যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যায়, তাহলে এই পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত কি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে দাঁড়াবে না? এইটুকু ভেবে দেখা দরকার।
কর্ম কমিশন কি ভেবেছেন তারা কি উপায়ে মার্চ মাসে এই পরীক্ষা নিবেন? শেষ পর্যন্ত যদি চাকুরির পরীক্ষা পিছাতেই হয়, তাহলে তড়িঘড়ি করে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এই অস্থির সময়ে একটি বা দু'টি ব্যাচের অসংখ্য শিক্ষার্থীকে পিছিয়ে দেয়া কেন? এই করোনাকালীন সময়ে বিভিন্ন হতাশার মধ্যে তাদেরকে আরেকদফা নিরাশ করার প্রয়োজন আদৌ আছে কি? অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একই ব্যাচের শিক্ষার্থীরা অনলাইনে পরীক্ষা দিয়ে ইতোমধ্যে গ্র্যাজুয়েট হয়ে গেছে এবং তারা এই বিজ্ঞপ্তিতে আবেদনের সুবিধা পাবেন। আমরা মনে করি এটি একটি বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্ত। চিকিৎসা ক্যাডারের অধীনে বিজ্ঞাপিত বিশেষ বিসিএসের জন্যও একই কথা প্রযোজ্য; যেখানে সরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রায় একটি বছর বসে রয়েছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলিতে যারা অনলাইনে গ্র্যাজুয়েশন করে ফেলেছেন, তারাই আবেদন করার যোগ্যতা রাখেন!
আমরা মনে করি, করোনাকালীন এই জটিলতা নিরসনে করোনা পরবর্তী সময়ে চাকুরির বয়স বৃদ্ধি ও বেশ কয়েক দফায় বিশেষ বিসিএসসহ বেশ কিছু জরুরি নিয়োগের ব্যবস্থা করে এই শূন্য পদ সমূহ পূরণ করা সম্ভব। কিন্তু এই মুহূর্তে পরীক্ষা অনুষ্ঠান বিষয়ে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ও শিক্ষার্থীদের অযথা দুর্ভোগের কারণ ঘটানো ছাড়া আর কিছুই নয়। এটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির জন্য ভীষণ উদ্বেগজনক ও বৈশ্বিক মন্দার যুগে শিক্ষার্থীদের জন্য চরম হতাশাজনক। আমরা আশা করি, সরকারি কর্ম কমিশন অবিলম্বে এই বিজ্ঞপ্তির বিষয়ে পুনঃবিবেচনা করবেন এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া অব্দি নিয়োগ সংক্রান্ত এই বিজ্ঞপ্তি স্থগিত করবেন।
লেখকবৃন্দ: মিলি সাহা, সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ড. গৌতম সাহা, সহযোগী অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/এমএস