আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে ‘স্বাধীন ফিলিস্তিন’ রাষ্ট্রের জন্য?
এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া
২৯ নভেম্বর, ২০২০, ফিলিস্তিনকে বিভক্ত করে দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের গৃহীত ‘ঐতিহাসিক’ প্রস্তাবের ৭৩ বছর পূর্তির দিন আজ। ১৯৪৭ সালের এই দিনে জাতিসংঘের যে প্রস্তাব অনুসারে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠা, সেই একই প্রস্তাব অনুযায়ী একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রেরও প্রতিষ্ঠার কথা। কিন্তু দীর্ঘ সাত দশক পরও অধরাই রয়ে গেছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা।
ফিলিস্তিন ভূখণ্ডটি ঐতিহ্যগতভাবে খ্রিষ্টপূর্ব ৪৫০ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ভূমধ্যসাগর ও জর্ডান নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল এবং সংলগ্ন কিছু এলাকা নিয়ে বিরাজমান ছিল। ১৫ মে, ১৯৪৮ সাল। এক দিনে লাখো ফিলিস্তিনিকে তাদের হাজার বছরের আবাসভূমি থেকে সীমাহীন অত্যাচার-নিপীড়ন চালিয়ে উৎখাত করা হয়। সেই ভূমিতে বহিরাগত ইহুদিদের জন্য প্রতিঠা করা হয় আজকের ইসরাইল। দিনটিকে ফিলিস্তিনিরা ‘বিপর্যয়’ বা ‘নাকবা’ দিবস হিসেবে বিবেচনা করে। ১৯১৭ সালে ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেলফোর ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিলে শুরু হয় ফিলিস্তিনিদের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ। সেই থেকে শুরু প্রতারিত, ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত, ভাগ্যবিড়ম্বিত ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। গত ৭০ বছর ধরে এই সংগ্রাম বিরতিহীনভাবে চলছে।
১৯৪৭ সালেই জাতিসঙ্ঘ দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু ওই পর্যন্তই। জাতিসঙ্ঘের ১৮১ নম্বর প্রস্তাব অনুসারে জেরুসালেম একটা আন্তর্জাতিক জোন। আর পূর্ব জেরুসালেম হলো ইসরাইলের অবৈধভাবে দখল করা ভূমি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সেখানেই মার্কিন দূতাবাস সরিয়ে এনেছে। আর সেটা করেছে সেই ফিলিস্তিনিদের বিপর্যয় বা ‘নাকবা’ দিবসে। ১৫ মে’র পর ইসরাইলের বিরুদ্ধে গাজার বিক্ষোভগুলো ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কলেবরে হয়। বিক্ষুব্ধ ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলি সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণে এ দিন গাজায় ৬০ জন নিহত এবং আড়াই হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি আহত হন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফিলিস্তিনের ওপর যুক্তরাজ্যের শাসনের লাগাম ছুটে যেতে থাকে। এর আগে ১৯২২ সালে লিগ অব নেশনসের কাছ থেকে অখণ্ড ফিলিস্তিনের ওপর ম্যান্ডেট লাভ করে ব্রিটিশরা। কিন্তু ইহুদি নিধনযজ্ঞ, বিভিন্ন ইহুদি গুপ্ত গোষ্ঠীর চাপ, আরব লিগের প্রতিষ্ঠা ও মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান সংশ্লিষ্টতার ঘটনায় এই পরিস্থিতি তখন থেকেই রাতারাতি পাল্টাতে থাকে। পরে ১৯৪৭-এর ফেব্রুয়ারিতে ফিলিস্তিনের ওপর থেকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার করে নেওয়ার ঘোষণা দেয় ব্রিটিশরা। একসময়ের লিগ অব নেশনস, বর্তমান জাতিসংঘের কাছে এর দায়িত্ব অর্পণ করে।
১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর, নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ফিলিস্তিনকে বিভক্ত করা নিয়ে বিতর্কিত ‘প্রস্তাব ১৮১’ গ্রহণ করে। প্রস্তাবটি তিন মিনিটের কম সময়ের এক ভোটাভুটিতে পাস হয়। প্রস্তাব পাসের সময়টায় ফিলিস্তিন ছিল ১৩ লাখ ফিলিস্তিনি আরবের বসতি; বিপরীতে সেখানে ছিল ৬ লাখ ইহুদির বাস। এই বিভক্তির প্রস্তাব অনুসারে পরের বছরের ১ আগস্টের মধ্যে স্বাধীন ইহুদি ও আরব রাষ্ট্র গঠনের কথা ছিল। প্রস্তাবিত ইহুদি রাষ্ট্রের জন্য বরাদ্দ হয় ১৪ হাজার বর্গকিলোমিটার (৫ হাজার ৪০০ বর্গমাইল) স্থান। আর সংখ্যাগরিষ্ঠ ফিলিস্তিনি আরবদের জন্য বরাদ্দ হয় সাড়ে ১১ হাজার বর্গকিলোমিটারের (৪ হাজার ৪০০ বর্গমাইল) তিনটি এলাকা। আর জেরুজালেম ও এর আশপাশের এলাকা নিয়ে গঠন করা হয় এক বিশেষ আন্তর্জাতিক অঞ্চল।
১৯৪৮-এ জনসংখ্যার মাত্র ৩০ শতাংশের প্রতিনিধিত্বকারী হয়েও ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল ফিলিস্তিনের ৫৪ শতাংশ ভূখণ্ডের মালিক হয়। ক্ষুব্ধ আরব দেশগুলো পুরো ফিলিস্তিনকে নিয়ে একটি একক, গণতান্ত্রিক ও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের ডাক দেয়।
১৯৪৮-এ ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষিত হলে প্রতিবেশী চারটি আরব দেশ একযোগে ইসরায়েল আক্রমণ করে। যুদ্ধে আরবরা পরাজিত হয়। জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুযায়ী নিজেদের জন্য বরাদ্দকৃত স্থানেরও বেশি মোট ৭৭ শতাংশ ভূমির ওপর আজ দখলদারি প্রতিষ্ঠা করেছে ইসরায়েল। আর আজ ৭২ বছর পরও অধরা স্বাধীন ফিলিস্তিনের স্বপ্ন।
ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাতের দল ফিলিস্তিন লিবারেশন অরগানাইজেশন (পিএলও) সহিংসতার লাগাম টেনে ধরতে এবং জাতিসঙ্ঘের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করার চেষ্টা করে। বিপরীতে গাজা উপত্যকায় জন্ম হয় ইসলামিক প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের, যারা নিজেদেরকে পিএলও’র বিকল্প শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। হামাস তার প্রধান লক্ষ্য হিসেবে যেকোনো কিছুর বিনিময়ে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ঘোষণা করে। এ ঘোষণা আন্দোলনরত যোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করে এবং সাহস জোগায় ইসরাইলি দখলদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার।
এ দিকে, ফিলিস্তিন মুক্তি সংগ্রামের অব্যাহত গতিধারায় আশার আলো জাগায় ১৯৭৯ সালে সংঘটিত ইরানের বিপ্লব। বিপ্লবের পর ফিলিস্তিন ও আল-কুদসের মুক্তির লক্ষ্যে সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করতে মাহে রমজানের শেষ শুক্রবারকে আল-কুদস দিবস ঘোষণা করা হয়। তখন থেকে বিশ্ব মুসলিম এ দিবসটি পালন করে আসছে। বর্তমান ফিলিস্তিনে হামাসের নেতৃত্বে জেগে উঠেছে ফিলিস্তিনের অজুত মানুষ। আর দক্ষিণ লেবাননে বিপুল শক্তি অর্জন করেছে এক লড়াকু সংগঠন হিজবুল্লাহ। তাদের হাতে পর্যুদস্ত হয়ে ২০০৬ সালে ইসরাইলি সেনাবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল।
যে জাতি শাহাদতের মধ্যে গৌরব খুঁজে, তাদের কেউ থামাতে পারে না। তাদেরকে হত্যা করা যায়, বন্দী করা যায় কিন্তু স্বাধীনতার আকাশছোঁয়া স্বপ্ন থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না।
লেখক : মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ ও আহ্বায়ক, জাতীয় কৃষক-শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন।
এইচআর/পিআর