ক্ষুদ্র, অতি ক্ষুদ্রদের জন্য ব্যাংক ঋণ
ব্যাংকে তারল্যের পাহাড়, কিন্তু ঋণ নেওয়ার লোক নেই। এ খবরটা ইদানিং শুনছি। তবে এমন খবরে অনেকেরই অভিযোগ যে, টাকা পড়ে থাকলেও ব্যাংক সাধারণ মানুষকে ঋণ দেয় না ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ব্যাংক খুঁজে খুঁজে বের করে বড় বড় শিল্প গ্রুপকে, যাদের অনেকেই বড় ব্যবসায়ী খেতাব তকমা জুগিয়ে বড় বড় ঋণ খেলাপী।
তবে এবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক নাকি ব্যবস্থা নিচ্ছে যাতে সাধারণ মানুষও সহজে ঋণ পেতে পারে। এর মধ্যেই ভোক্তা ঋণে নিরাপত্তা সঞ্চিতিতে বড় ছাড় দিয়েছে। এর ফলে ভোক্তা ঋণ বিশেষ করে ব্যক্তিগত ঋণ, গাড়ি ঋণ, আবাসন ঋণ, শিক্ষা ঋণ পাওয়া সহজ হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, এখন ভোক্তা ঋণের চাহিদা মেটাতে ও ব্যাংকগুলোকে উদ্বুদ্ধ করতে সব ধরনের অশ্রেণিকৃত ভোক্তা ঋণে ২ শতাংশ নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হবে। যেখানে আগে রাখতে হতো ৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সিদ্ধান্তের ফলে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বাড়ি বা গাড়ি কিনতে চান বা কোনও আসবাব বা অন্য কোনও প্রয়োজনীয় কিছু কিনতে চান ব্যাংক তাদের আগ্রহ সহকারে ঋণ দেবে। ব্যাংকাররা আশাবাদী যে, নতুন এই সিদ্ধান্তের ফলে কনজুমার ঋণ বাড়বে। ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণে উদ্বুদ্ধ হবে। কনজুমার ঋণে ব্যাংকের আর আগের মতো লোকসান গুণতে হবে না।
তবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা সহজেই ঋণ পাবেন কিনা সেটা বুঝতে সময় লাগবে। নতুন বিনিয়োগে জন্য ঋণ চাইলে আগের ঋণ শোধ হয়নি বলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পত্রপাঠ বিদায় করে দেওয়া হয় ছোট-মাঝারি উদ্যোক্তাদের। আর যদি একেবারে নতুন হয়, তাহলেতো ব্যাংক পর্যন্ত পৌঁছানোই কঠিন হয়ে যায় অনেকের জন্য। তা ছাড়া ব্যাংকারদের মনস্তত্বে আছে ভিন্ন হিসেব। ব্যাংক খাতে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ বেঁধে দেওয়া হলেও খুচরা, ক্ষুদ্র ও ছোট ঋণে খরচ পড়ে ১৩/১৪ শতাংশ। ফলে তারা উৎসাহিত নয় এদের খুঁজতে।
বাংলাদেশে ব্যবসা বাণিজ্য করে সম্পড়ের পাহাড় গড়েছেন যারা তাদের বড় অংশ ব্যাংকের টাকাতেই হয়েছেন। এদের জন্য ব্যাংকগুলো, বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলো, এক দিকে দরাজ হাতে ঋণ বিলি করেছে, অন্য দিকে ঋণ শোধের কিস্তি সহজ করতে গিয়ে খেলাপী ঋণ বেড়েছে। তবুও এরাই ঋণ পান, অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা যাতে সহজে ঋণ পান সেই ব্যবস্থা প্রায় অনুপস্থিত। আর বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অনেকগুলোই পর্যদুস্ত মালিকদের স্বেচ্ছাচারি কর্মকাণ্ডে।
বাংলাদেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলো শুরু থেকেই দক্ষতা আর সক্ষমতা দেখিয়ে আসছে, প্রতিকূল, অবস্থায়ও প্রোডাক্ট ইনোভেশন দেখিয়ছ এবং লাভজনকভাবে পরিচালিত হয়েছে। কিন্তু ‘কোল্যাটারাল সিকিউরিটি’- নামের যন্ত্রণায় ক্ষুদ্র, অতি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার জন্য ঋণ নেই, নেই কোন প্রডাক্টও। মোবাইল বা টিভি মেকানিক, স্যালুন, ছোট ছোট দোকান যারা চালান, তারা কি ঋণ পেতে পারেন না? ট্রেড লাইসেন্স নেই এমন যোগ্য প্রার্থিও নিশ্চয়ই আছে। নিশ্চয়ই ব্যাংক কয়েকটি বিষয় নিশ্চিত হতে চাইবে- ব্যবসার বাৎসরিক আয়, ঋণের প্রয়োজন এবং ঋণ পরিশোধ করার ক্ষমতা। ব্যাংকিং জগত থেকে বিচ্ছিন্ন এই ক্ষুদ্ররা বাধ্য হয়ে চড়া সুদে ঋণ নেয় ব্যাক্তিগত সুদ ব্যবসায়ী বা ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবসায়ী এনজিও’র কাছে থেকে।
তথ্য বলছে গত আগস্ট মাসের শেষে ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্য বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা। ব্যাঙ্ক টাকা নিয়ে বসে আছে, কিন্তু ঋণ লওয়ার লোক নেই– এমন অবস্থা অর্থনীতির জন্য ভাল নয়। বোঝা যায় সমস্যা অনেক গভীরে। ব্যাংকগুলো ঋণ প্রদান করে ব্যাংক যে সুদ অর্জন করে, তার একটি অংশ যায় আমানতের উপর সুদ দিতে, আর একটি অংশ দিয়ে ব্যাংকের নিজস্ব ব্যয়নির্বাহ হয়। ঋণের চাহিদা কমে যাওয়ার অর্থ ব্যাংকের আয়ও হ্রাস পেতে শুরু করেছে। মানুষ টাকা রাখতে আসছে, আর সেইসব আমানতের উপর সুদ ব্যাংককে মিটাতেই হচ্ছে।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলির ক্ষেত্রে আয়-ব্যয়ের এই অসঙ্গতি আশংকজনক। তবে এটিকে এখনই ব্যাংকিং-সঙ্কট বলবার কারণ নেই। কিন্তু সঙ্কটের পথে যে চলছে সেটা বলতেই হবে। বড় বিনিয়োগকারীদের কাছে এ মুহূর্তে ঋণের চাহিদা নেই, কারণ বাজারে পণ্য ও সেবার চাহিদা তলানিতে। যারা এমন অবস্থায়ও ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করতে চান তাদের ঝুঁকি নিচ্ছেন। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ব্যাঙ্ক এমন ব্যবসায়ীদের এড়িয়ে চলতে চায়। এখন ঋণ দেওয়ার তাগিদে এমন ঋণপ্রার্থীদেরও ঋণ দেওয়া হলে তার ফল বিষম হবার সম্ভাবনা আছে।
আমানতের সুদহার ৬ শতাংশের নিচে নেমে এলেও ব্যাংকগুলোতে আমানত আসার প্রবণতা বাড়ছে। ব্যাংকে আমানত এলেও তারা সেভাবে বিনিয়োগ করতে পারছে না। সাধারণ মানুষের কাছেও কোন বিকল্প নেই। নিশ্চিত মুনাফা ও নিরাপত্তা ভাবনায় তারা ব্যাংকগুলোতেই টাকা রাখছে।
বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খাতায় অনাদায়ী ঋণের পাহাড় জমেছে। সেই বোঝা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে ব্যাংকগুলো। ঋণ খেলাপি যেমন বড় ব্যবসায়ী আছে, রাজনৈতিক ও বিভিন্ন প্রভাবে ব্যাংক ঋণ নেয়ে গোষ্ঠীও আছে। বলবার বিষয় এটুকুই যে, ব্যাংকগুলো এবার ক্ষুদ্র, অতি ক্ষুদ্রদের কথা ভাবুক। ফলাফলটা ভাল হবে আশা করি। তাদের জন্য বিশেষায়িত প্রোডাক্ট আসুক।
এইচআর/এমএস