ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

বাবরি ভাঙার রায়, অ্যামনেস্টি এবং মোদির হিন্দুরাষ্ট্র

আনিস আলমগীর | প্রকাশিত: ১০:৩২ এএম, ০১ অক্টোবর ২০২০

মোগল সম্রাট বাবরের তৈরি বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে ৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২ সালে। তার কয়েক বছর আগে থেকে রথযাত্রা করে, সারা দেশে হিন্দুত্ববাদের উন্মাদনা তৈরি করে- সেটি ভাঙার প্রেক্ষাপট তৈরি করা হয়েছিল। এর নেতৃত্ব দিয়েছেন এল কে আদভানি, মনোহর যোশী, বাল থেকারে, উমা ভারতীর মত উগ্র হিন্দু মৌলবাদী রাজনৈতিক নেতারা। মৌন সমর্থন ছিল কংগ্রেস দলীয় তখনকার প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাওয়েরও। মসজিদ ভাঙার পর এই কাজের নেতৃত্ব আর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে ৪৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। মামলা চলতে চলতে বাল থেকারে, অশোক সিংহল, মহন্ত অবৈদ্যনাথ, গিরিরাজ কিশোর, এবং বিজয়ারাজে সিন্ধিয়াসহ মারা যান ১৭ জন। তাদেরকে বাদ দিয়ে আদভানি, যোশী, উমাসহ আসামী ছিল বাকী ৩২ জন।

কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো (সিবিআই) মামলাটি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিল। বিচার চলাকালীন ৩৫১ জন সাক্ষী এবং ৬০০টি নথি প্রমাণ হিসাবে সিবিআই আদালতে হাজির করেছিল। কিন্তু বিশেষ আদালতে ঘটনার ২৮ বছর পর ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০ এই মামলার রায় ঘোষণা করে বলেছে- অভিযুক্তরা কেউ বাবরি মসজিদ ভাঙেনি। ১৫২৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৫২৯ সালের সেপ্টেম্বর সময়ের মধ্যে তৈরি করা হয়েছিল ঐতিহাসিক এই মসজিদটি। এমনই এক সেপ্টেম্বরে নজিরবিহীন, ‘ইতিহাসের নিকৃষ্ট’ রায়টি দিলেন বিশেষ সিবিআই আদালতের বিচারক এস কে যাদব। তার চাকরি জীবনের শেষ দিনটিতে তিনি জানিয়ে দেন, এমন কোনো প্রমাণ মেলেনি আদভানি-যোশী-উমা ভারতীর মতো নেতানেত্রীরা সেদিন মসজিদ ভাঙায় প্ররোচনা দিয়েছিলেন বলে- বরং তারা না কি সেটা আটকাতেই চেষ্টা করেছিলেন!

আদালতে মূল অভিযুক্তরা সবাই যখন খালাস পেয়ে যান, সঙ্গে সঙ্গে কোর্টরুমের ভেতরেই মুহুর্মুহু 'জয় শ্রীরাম' স্লোগান উঠতে থাকে, বাইরেও চলতে থাকে তার রেশ। তারা রায়ের পর মিষ্টি বিতরণ করে। বিজেপির প্রবীণ দুই নেতা মামলায় অব্যাহতি পাওয়ার পর ‘জয় শ্রীরাম’' ধ্বনিতে রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন। আদভানি তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, বাবরি মসজিদ ধ্বংস মামলার রায় আমার বিশ্বাসকে সত্য প্রমাণিত করেছে। আর যোশী বলেছেন, এই রায় ঐতিহাসিক।

এখন প্রশ্ন উঠছে যদি সেই দিনের ঘটনায় এই অভিযুক্তদের কোনো ভূমিকাই না-থাকে তাহলে মসজিদ ভাঙল কারা? করসেবক নামের সন্ত্রাসীদেরকে মসজিদ ভাঙার প্ররোচনা দিয়েছে কারা? সারা দুনিয়া দেখেছে বাবরি ভাঙার দিনে সেখানে মঞ্চের ওপর বসে আদভানি-যোশীরা মিষ্টি বিলি করছিলেন। তাহলে কী কারণে তারা মিষ্টি খাওয়া খাওয়ি করেছেন?

অবশ্য এসব প্রশ্ন করবে কে? নরেদ্র মোদি-অমিত শাহের হিন্দু মৌলবাদী সরকার যারা প্রশ্ন তুলে তাদেরকে জেলে দেয়। মুসলমান হলে জেলে দেওয়া আরও সহজ- সঙ্গে দেশদ্রোহী মামলা। আদালত ‘কিনে নিয়েছে’ মোদি সরকার। মাত্র গত আগস্ট মাসেইতো এই নিয়ে হৈচৈ পড়ে গেল ভারত জুড়ে। প্রশান্ত ভূষণ নামের উচ্চ আদালতের একজন বিখ্যাত আইনজীবী দুটি টুইট করেছিলেন উচ্চ আদালত নিয়ে। একটি টুইটে তিনি বলেছিলেন যে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের চার প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি দুর্নীতিগ্রস্ত ছিলেন। অন্য একটি টুইটে একজন বিজেপি নেতার কেনা ৫০ লাখ রুপি মূল্যের একটি আমদানি করা বাইকে মাস্ক এবং হেলমেট ছাড়া বসার জন্য বর্তমান প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করেছিলেন তিনি। পরিণতিতে আদালত অবমাননা মামলা। আদালত তার সাজা ঘোষণা করার আগে তাকে ক্ষমা চাইতে সময়ও দেয়। কিন্তু প্রশান্ত ভূষণ এটি তার বিবেকবিরোধী হবে বলে ক্ষমা চাইতে অস্বীকার করেন। আদালত না পেরে তাকে এক রুপি জরিমানা, না মানলে জেলসহ আইনপেশা থেকে কয়েক বছরের জন্য নিষিদ্ধ করার রায় দিয়েছিল।

হিন্দুত্ববাদী সরকারের অপকর্মের বিরুদ্ধে বলার মতো ছিল মানবাধিকার কমিশনগুলো। কিন্তু আগের দিন ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০ বিবিসিসহ বিশ্ব মিডিয়ায় খবর হয়েছে- আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, নরেন্দ্র মোদির সরকারের ক্রমাগত 'প্রতিহিংসামূলক আচরণ’ ও ‘হয়রানি’র জেরে তারা ভারতে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছে। অ্যামনেস্টি ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর জারি করা এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ভারত সরকার তাদের সব ব্যাংক অ্যাকাউন্টে লেনদেন বন্ধ করে দেওয়ার পর সেখানে তাদের পক্ষে আর কোনো ক্যাম্পেইন বা গবেষণা চালানো সম্ভব নয়।

সিভিল সোসাইটির যারাই মোদি-অমিত শাহ সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলছিল তাদেরকে তারা জেলে দিচ্ছে। বিনা অপরাধে মাসের পর মাস দেশদ্রোহী হিসেবে জেলে থেকে পরে কেউ কেউ ছাড়া পাচ্ছে। দেশের নিপীড়িত শ্রেণি ও সংখ্যালঘুরা বারবার আক্রান্ত হচ্ছে। কাশ্মিরের স্বায়ত্বশাসন কেড়ে নেওয়া হয়েছে, দেশের নানা প্রান্তেই যখন মানবাধিকার লঙ্ঘিত- তখন মুখ বন্ধ করার বাকী ছিল মানবাধিকার কমিশনগুলোর। ভারতে অ্যামনেস্টির কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যাওয়াটা তাই স্বাভাবিক। কারণ ভারত-অধিকৃত কাশ্মিরের মানবাধিকার পরিস্থিতিই হোক বা কিংবা গরুর গোশত খাওয়ার ‘অপরাধে’ মুসলমানদের পিটিয়ে মারার ঘটনা হোক- সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যে সব সংগঠন সরকারের সমালোচনায় সবচেয়ে সরব, অ্যামনেস্টি ইন্ডিয়া ছিল তার প্রথম সারিতে।
অ্যামনেস্টি দিল্লির দাঙ্গায় মোদি সরকারের পুলিশ সামিল ছিল রিপোর্ট দিয়েছিল। ভারতে কেন এতো বেশি মৃত্যুদণ্ডের সাজা- সেই প্রশ্ন তুলেছে। ভারতের নাগরিকত্ব আইন নিয়ে ছাত্র ও সরকারের মুখোমুখি হওয়ার খবরও দিয়েছে।

বিবিসি, আলজাজিরা, সাউথ এশিয়ান মনিটর জানিয়েছে, ভারতের সরকারি কর্মকর্তারা দাবি করছেন, অ্যামনেস্টি ইন্ডিয়া বহুদিন ধরেই বিদেশ থেকে অবৈধভাবে অর্থ গ্রহণ করছে এবং তার মাধ্যমে 'ফরেন কন্ট্রিবিউশন (রেগুলেশন) অ্যাক্ট' বা এফসিআরএ লঙ্ঘন করে আসছে। দিল্লিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে বলা হয়েছে, অ্যামেনেস্টির ভারতীয় কার্যালয় 'প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগে'র (এফডিআই) রুট ব্যবহার করে ব্রিটেন থেকে বিপুল পরিমাণ অনুদান পেয়েছে - যেটা তারা করতে পারে না।

অবশ্য, অ্যামনেস্টি ইন্ডিয়ার নির্বাহী পরিচালক অবিনাশ কুমার বিবিসিকে বলেছেন, এটা কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। সাম্প্রতিককালে দিল্লির সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় দিল্লি পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা এবং কাশ্মিরের সরকারের মানবাধিকার রেকর্ডের সমালোচনা করার সঙ্গেও এই পদক্ষেপের সম্পর্ক থাকতে পারে।

রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, আদালত, সিভিল সোসাইটি, মানবাধিকার কমিশন সব কিছুকে স্তব্দ করে দিলে প্রতিবাদ করার মতো আর কে থাকে? মিডিয়াই হচ্ছে সেখানে নির্যাতিতদের সহায়। কিন্তু ভারতে প্রধানসারির দু’ একটি ছাড়া সব কয়টি টিভি এবং পত্রিকা মেতেছে মোদির বন্দনায়, সাংবাদিকরা পরিণত হয়েছে হিন্দু মৌলবাদীদের কেনা গোলামে। করোনাভাইরাসের শুরুতে দিল্লির তাবলিগ মারকাজে থাকা করোনা আক্রান্ত মুসল্লিদের দিয়ে প্রচারণা চালিয়েছে যে, মুসলমানরা করোনা ছড়াচ্ছে পরিকল্পিতভাবে। সবজিওয়ালা থেকে শুরু করে রাস্তায় মুসলমান কোনো ফেরিওয়ালা-দোকানদার থেকে ওরা মালক্রয়ের নিরুৎসাহিত করেছে এই বলে যে- ওরা করোনাভাইরাস ছড়াচ্ছে হিন্দুদের লক্ষ করে। দেশ করোনায় আক্রান্তদের মধ্যে বিশ্বে দ্বিতীয় আর মিডিয়া আছে সুশান্ত সিং রাজপুত নামের একজন অভিনেতা আত্মহত্যা করেছে নাকি তাকে তার প্রেমিকা ষড়যন্ত্র করে মেরেছে সেই প্রচারণা দিয়ে। নতুন কৃষিনীতির বিরুদ্ধে কৃষকরা বন্ধ ডেকেছে, দেশের সীমান্তে আগ্রাসন ঘটছে, কৃষকের আত্মহত্যা বাড়ছে, বেকারত্বে রেকর্ড গড়ছে, অর্থনীতির পতন হতাশা বাড়াচ্ছে- ওরা আছে কঙ্গনা রানাওয়াত নামে আরেক বিজেপি চেলা অভিনেত্রীর অফিসের অবৈধ বারান্দা ভাঙা, বলিউডের নায়িকা দীপিকা গাজা খেয়েছে নাকি খায়নি সেটা নিয়ে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এসব ইস্যুর দিকে নজর দেওয়ার বদলে ভারতের মিডিয়া সুশান্ত সিংয়ের আত্মহত্যা নিয়ে অন্ধভাবে মত্ত আছে কারণ সামনে বিহারের বিধানসভা নির্বাচন। বিহারের এই অভিনেতাকে হাজির করা হচ্ছে বিজেপির নির্বচনী বৈতরণী পার হওয়ার সেন্টিমেন্ট হাতিয়ার হিসেবে।

সংখ্যালঘু মুসলমানদেরকে নাগরিকত্বহীন করার জন্য বিজেপি সরকার যখন সিসিএ/এনআরসি বিল আনে দিল্লির জামেয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তখন রাস্তায় নেমেছিল। তাদের শাহীনবাগ আন্দোলনে প্রিয় মুখ হয়ে পড়েন ৮২ বছরের বিলকিস বেগম। এই বিলকিস বেগমকে এবার টাইম ম্যাগাজিন বছরের সেনা ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় ‘সিম্বল অফ রেসিস্টেন্স’ বা প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে স্থান দিয়েছে- সেটাও সহ্য হচ্ছে না মোদির গোদি মিডিয়ার। তারা এটাকে বলছে ভারতের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। অথচ ওই তালিকায় মোদিকেও স্থান দেওয়া হয়েছে প্রভাবশালী নেতাদের দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে।

গত ফেব্রুয়ারিতে দিল্লির দাঙ্গায় ৪০ জনের বেশি মুসলিমকে নৃশংসভাবে হত্যার সময় বিজেপির সোশ্যাল মিডিয়ার প্রোপাগান্ডা সেল এই ঘটনাকে হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের সমান শক্তির মধ্যকার সঙ্ঘাত হিসেবে অভিহিত করেছে। মোদির কেনা প্রভাবশালী এসব টেলিভিশন সাংবাদিকেরা সত্যকে বিকৃত করতে সহায়তা করে বিজেপির চরম হিন্দু এজেন্ডা এগিয়ে নেয়ার কাজটি করেছে।

দুনিয়ার সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক, পরমত সহিষ্ণু এবং মোটামুটি সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসেবে খ্যাত ভারতকে গত সাত বছর ধরে হিন্দু রাষ্ট্র প্রমাণের জন্য গোদি মিডিয়া, নিয়ন্ত্রিত আদালত, হিন্দু মৌলবাদী পুলিশ-আমলা দিয়ে মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি-সংগঠনকে নিষ্পেষণ-নিপীড়ন, সংখ্যালঘু মুসলমানদের নির্যাতন, দমন এবং সর্বোপরি নাগরিকত্বহীন করার পরিকল্পনা নিয়ে আগামীতে কোন জাহান্নাম বানাতে চান একমাত্র মোদি জানেন।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]

এইচআর/পিআর