ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

দেশের স্বার্থে শেখ হাসিনার শতায়ু চাই

প্রভাষ আমিন | প্রকাশিত: ০৯:১৫ এএম, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০

শেখ হাসিনা আমার প্রিয় রাজনৈতিক চরিত্র। তাঁকে নিয়ে কিছু লিখতে আমার একই সঙ্গে প্রচণ্ড আগ্রহ এবং তীব্র অনীহা রয়েছে। শেখ হাসিনা একজন মানবিক মানুষ, ভালো-মন্দ মিলিয়েই মানুষ। তাই তাঁকে ভালো যেমন বাসি, তেমনি কিছু সমালোচনাও আছে। আমি জানি, খোলা মনে সমালোচনা গ্রহণ করার ঔদার্য্য শেখ হাসিনার আছে। সমালোচনা গ্রহণ করার ব্যাপারে তার সহনশীলতায় আমার আস্থা আছে। পরিবারের প্রায় সবাইকে হারিয়ে, ১৯ বার হত্যা চেষ্টা থেকে বেঁচে যাওয়া শেখ হাসিনা আসলে সর্বংসহা। আমাদের এসব সমালোচনা আর কথার বাণ তাঁর অসীম সহ্যক্ষমতার দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে। তবে সহনশীলতা ও ভিন্নমতের ব্যাপারে তাঁর দলের লোকজন একদম জিরো টলারেন্স।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললেই তারা মামলা ঠুকে দেন, হামলা করেন। অথচ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে যৌক্তিক সমালোচনা, এমনকি অযৌক্তিক সমালোচনাও অপরাধ নয়। সরকারের সমালোচনাকেও রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বঙ্গবন্ধু আমলে জাসদ নেতারা যে ভাষায় তাঁর সমালোচনা করেছে, এখন তা কল্পনা করতেও ভয় লাগে। শেখ হাসিনা একজন মানুষ। তাঁর ভালো যেমন আছে, মন্দও তেমনি আছে। কারো দৃষ্টিতে ভালো বেশি, কারো দৃষ্টিতে মন্দ। কিন্তু ভুল ত্রুটির উর্ধ্বে অমানবিক করে তোলাটা তাঁর জন্য শুভ নয়। শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের পছন্দ করেন, আবার তাদের নানা কাজের, লেখার, বলার হুল ফোটানো সমালোচনাও করেন। এটাকে আমি সবসময় ইতিবাচকভাবেই নেই। তাঁকে সমালোচনা করা যদি আমার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হয়, সেটার জবাব দেয়াও তো তাঁর মতপ্রকাশের স্বাধীনতা।

আমার শঙ্কা, শেখ হাসিনা সম্পর্কে লিখলেই একটা পারসেপশনের কবলে পড়তে হবে। কারণ সত্যি কথা লিখলেও তা তাঁর প্রশংসাসূচকই হবে। আমি দলনিরপেক্ষ, তবে আদর্শ নিরপেক্ষ নই। আমি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদার, গণতান্ত্রিক, উন্নত, সমৃদ্ধশালী, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ চাই। আর এটাও জানি, এই লক্ষ্য অর্জনে এখনও শেষ আশ্রয় শেখ হাসিনাই। শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের অনেক কাজের সমালোচনা করলেও স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আমি ব্যক্তিগতভাবে শেখ হাসিনার অনুরাগী। অনেক ভেবে দেখলাম, আমি কখনো রাজনীতি করবো না, সাংবাদিক নেতাও হবো না, কোনো পোস্টিংএ আগ্রহ নেই, কোনো পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, টেলিভিশনের মালিক হতে চাইবো না; তাই আশা করি যাই লিখি, তা ব্যক্তিগত স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে লিখতে পারবো। প্রশংসাসূচক লিখলেও, তা কোনো প্রাপ্তির প্রত্যাশায় নয়, সেটা নিশ্চিত। সমালোচনাটুকুও রাজনৈতিক স্বার্থে নয়।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে দু’জন মানুষের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন রাজনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১০ মাস পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকার পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার প্রতীক্ষায় তখন গোটা জাতি। তিনি এসে শুরু করেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কাজ। কিন্তু ৭৫এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর দেশে নেমে আসে অমানিশার অন্ধকার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে দেশে শুরু হয় পাকিস্তানীকরণ। স্বাধীনতা বিরোধীরা প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত হয়ে যান। রাজনীতি ঢুকে পড়ে ক্যান্টনমেন্টে। এই সময় ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। তখন তাঁর বয়স মাত্র ৩৪ বছর। আওয়ামী লীগের মত বড়, কোন্দল কবলিত এবং বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর সরকারি নিষ্পেষণে ধ্বংসপ্রায় একটি দলের সভাপতির দায়িত্ব নেয়াটা ছিল ঝুঁকিপূর্ণ।

শেখ হাসিনা সেই দায়িত্ব কতটা পালন করতে পারবেন, তা নিয়ে সংশয় ছিল অনেকেরই। দলের ঐক্যের প্রতীক হিসেবেই শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। যারা তাঁকে ফিরিয়ে এনেছেন, তাদেরও ধারণা ছিল, শেখ হাসিনাকে সামনে রেখে তারাই দল চালাবেন। কিন্তু শেখ হাসিনা সবাইকে চমকে দিয়েছেন। টানা ৩৯ বছর ধরে আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব শুধু পালনই করেননি; আওয়ামী লীগকে তুলে এনেছেন অন্যরকম উচ্চতায়। এখন শুধু দল নয়, দেশ, এমনকি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও অনেকের আগ্রহের কেন্দ্রে শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা যখন দেশে ফেরেন, তখন আমি স্কুলের ছাত্র। তখন থেকেই রাজনীতির ব্যাপারে আমার আগ্রহ। তাই শেখ হাসিনাকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি, আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর প্রতি মুগ্ধতা বেড়েছে।

শেখ হাসিনা যে এখনও বেঁচে আছেন, এটা বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দেশে থাকলে, সেদিনই পরিবারের আর সবার সঙ্গে নিহত হতে পারতেন। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় বেঁচে যাওয়াটা তো অলৌকিক। ১৯৭৫ সালে যখন বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন, তখন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ছিলেন জার্মানিতে। রাষ্ট্রপতির কন্যা থেকে হঠাৎ বনে যান অসহায়, এতিম। আগের দিন যারা মাথায় তুলে রেখেছিল, পরদিন তারাই মুখ ঘুরিয়ে নেন। দুই সন্তান আর ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে যাপন করেন উদ্বাস্তু জীবন। সেই উদ্বাস্তু জীবন থেকে কীভাবে শেখ হাসিনা বিশ্বের অন্যতম সেরা নেতায় পরিণত হলেন, তা এক অপার বিস্ময়।

সবকিছু ঠিক থাকলে হয়তো শেখ কামালই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক উত্তরসূরি হতেন। ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনাই শেখ হাসিনাকে রাজনীতিতে টেনে এনেছে। সাদা চোখে দেখলে শেখ হাসিনা উত্তরাধিকার সূত্রেই রাজনীতিতে এসেছেন। তবে ভুলে গেলে চলবে না তিনি ছাত্রজীবনেই ছাত্রলীগের মাঠের কর্মী ছিলেন। বড় সন্তান হিসেবে কাছ থেকে দেখেছেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, দেখেছেন তাঁর মা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের দৃঢ়তা। বাবার কাছ থেকে পেয়েছেন রাজনীতির দীক্ষা আর মায়ের কাছ থেকে পেয়েছেন শত কষ্ট সয়েও আদর্শে অবিচল থাকার শিক্ষা।

শেখ হাসিনা যখন দেশে ফেরেন, তখন চলছে জিয়াউর রহমানের শাসন, যিনি ক্যান্টনমেন্টে বসে গণতন্ত্র চর্চা করছিলেন। কিন্তু একবছরের মাথায় জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর নানা নাটকীয়তা পেরিয়ে ক্ষমতায় আসেন আরেক সেনা প্রধান এইচ এম এরশাদ। তিনিও তার পূর্বসূরিকে অনুসরণ করে গণতন্ত্র চর্চা করেন ক্যান্টনমেন্টে বসেই। এরশাদের টানা নয় বছরের স্বৈরশাসনের সময়ে শেখ হাসিনা গণতন্ত্র মুক্তির আন্দোলন করে গেছেন রাজপথে। শেখ হাসিনা এই ৩৯ বছরে নিজেকে এবং বাংলাদেশকে আজকের অবস্থানে নিয়ে আসবেন, ৮১ সালে এটা কেউ ভাবেননি, আমার ধারণা শেখ হাসিনা নিজেও না।

শেখ হাসিনার চরিত্রের অনেকগুলো দিক আছে। তিনি আদর্শে অবিচল, প্রয়োজনে ইস্পাতের মত কঠিন। আবার নিমেষেই কুসুমের মত কোমল। মেশিনের মত পরিশ্রম করা এবং দ্রুত ও সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা দল এবং দেশ পরিচালনায় তাঁকে অপ্রতিদ্বন্দী করে তুলেছে। সিনেমায় যেমন এক অভিনেতা একাধিক চরিত্রে অভিনয় করে, তেমনি এক শেখ হাসিনায় যেন বাস করে অনেক শেখ হাসিনা। রাজনীতির মাঠের পাকা খেলোয়াড়কেই দেখা যায় ছেলের জন্মদিনে পোলাও রান্না করছেন। নাতির আবদার মেটাতে মাছ রাধতে বসে যান। গণভবনের পেছনে ব্যাডমিন্টন খেলতে নেমে পড়া শেখ হাসিনার ছবিও ভাইরাল হয়ে যায় সোশ্যাল মিডিয়ায়। নাতি-নাতনিদের সঙ্গে সময় কাটানোর ছবিও হুটহাট প্রকাশ হয়ে যায়। সাগরের পারে গিয়ে খালি পায়ে নেমে পড়েন সমুদ্রে। ছোট বোনের সাথে তুষার নিয়ে খেলা করেন।

রাজনীতি করতে গেলে ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনেক কিছু করতে হয়। ভোটের মাঠে জড়িয়ে ধরতে হয় বস্তির মানুষকেও। কিন্তু শেখ হাসিনা যখন কাউকে জড়িয়ে ধরেন, দেখলেই বোঝা যায়, নিছক রাজনীতি নয়, তাতে মিশে আছে মমতা। নিমতলীর আগুনে সর্বস্ব হারা দুই মেয়েকে বুকে টেনে নেন মায়ের মমতায়। এমনকি জামালপুর থেকে আসা হিজড়াদের জড়িয়ে ধরেন পরম আদরে। সবাইকে কাছে টেনে নেয়ার, আপন করে নেয়ার এক বিরল ক্ষমতা রয়েছে তার। যারা দুজনকেই দেখেছেন, তারা বলেন, এই গুণটা তিনি বাবার কাছ থেকে পেয়েছেন। এমন আটপৌড়ে ভঙ্গিতে কথা বলেন, বোঝাই যায় সেখানে আন্তরিকতার ছোঁয়া রয়েছে। নেতাকর্মী, শিক্ষক, সাংবাদিক, সংস্কৃতি কর্মী- সবার সঙ্গে তার শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-স্নেহের সম্পর্ক।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যেমন ভোলেন না, তেমনি ভোলেন না তৃণমূলের কর্মীদেরও। সবকিছুর ওপরে তাঁর চরিত্রের যে মানবিক আবেদন, তাই অন্য সবার চেয়ে আলাদা করেছে শেখ হাসিনাকে। সাংবাদিকদের মধ্যে যারা তাঁর সঙ্গে সফর করেছেন, তারা পেয়েছেন, তাঁর এই স্নেহের পরশ। এখন হয়তো আর সম্ভব হয় না। তবে আশি ও নব্বইয়ের দশকে নিজে খোঁজ নিয়ে ডেকে সফরসঙ্গী সাংবাদিকদের থাকা-খাওয়ার তদারকি করতেন। সুযোগ পেলে পাতে তুলে খাইয়েছেন। যারা একবার এই স্নেহের সন্ধান পেয়েছেন, তারা আর তাঁকে ছেড়ে যেতে পারেন না। তবে শেখ হাসিনার চরিত্রের সবচেয়ে উজ্জ্বল অংশ তাঁর অসাধারণ হিউমার আর উইট। বুকে এমন বেদনার মহাসাগর ধারণ করে, জীবন থেকে এতটা রস নিংড়ে নেয়ার ক্ষমতা বুঝি শেখ হাসিনার একার।

শেখ হাসিনার জীবনের অনেকগুলো অধ্যায় আছে। কিন্তু জাতির জনকের কন্যা, নিজেও দীর্ঘসময় ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকার পরও তিনি যে এতটাই মাটির কাছাকাছি, আমার ধারণা এর কারণ, তাঁর ছেলেবেলো কেটেছে তখনকার অজপাড়াগা টুঙ্গীপাড়ায়। উদার প্রকৃতি আর মধুমতি থেকে উড়ে আসা কোমল বাতাস তার হৃদয়ে এই বাংলার জন্য যে ভালোবাসার জন্ম দিয়েছে, তা ক্রমশ বেড়েছে, পরিণত হয়েছে এই দেশকে এগিয়ে নেয়ার দায়িত্বে। সেই থেকেই প্রকৃতির প্রতি তাঁর অপার ভালোবাসা, মানুষের জন্য অগাধ দরদ তাঁর মনে।

২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এসেই কাঁধে তুলে নেন ২১ বছরের জঞ্জাল পরিস্কারের দায়িত্ব। প্রথম কাজ জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার বিচারের প্রতিবন্ধকতা দূর করা এবং বিচার শুরু। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফিরিয়ে আনতে করেন শান্তিচুক্তি। ভারতের সঙ্গে করেন গঙ্গার পানিবন্টন চুক্তি। ২০০৯ সালে দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে শুরু শেখ হাসিনার নেতৃত্বের উৎকর্ষের চরম প্রকাশ। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় কার্যকর করেন। এরপর শুরু হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। এই দুটি বিচার করে তিনি গোটা জাতিকে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন। বিচারহীনতার সংস্কৃতির গ্লানি থেকে মুক্তি দিয়েছেন আমাদের। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার না হয় জাতির অপেক্ষার পাশাপাশি কন্যা হিসেবে তার দায়। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলো আদর্শের প্রতি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি তার অবিচল আস্থার প্রকাশ। এই দফায় ভারতের সঙ্গে ৬৮ বছরের সীমান্ত সমস্যা সমাধান করে ছিটমহলবাসীকে স্বাধীনতার স্বাদ দিয়েছেন শেখ হাসিনা।

এই দফায় শেখ হাসিনার মূল লক্ষ্য উন্নয়ন। মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকারের চেতনা উন্নত ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ। সেই লক্ষ্যেই অবিরাম ছুটে চলা তার। এবং এই ছুটে চলা গোয়ারের মত। পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে টানাপোড়েনের পর শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত দেন, নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু বানাবেন। তখন তাঁর মন্ত্রিসভার অনেকেও বিশ্বাস করেননি এটা সম্ভব। কিন্তু পদ্মা সেতু এখন আর কম্পিউটার গ্রাফিক্স নয়, স্বপ্ন নয়; বাস্তবতা। গত সপ্তাহে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে গিয়ে দেখে এসেছি বদলে যাওয়া বাংলাদেশ। হাওড়ের বুক চিড়ে যে সড়ক, তা হাওড়ের মানুষেরই বিশ্বাস হয় না। শেখ হাসিনা বিদ্যুৎ উৎপাদনকে নিয়ে গেছেন অবিশ্বাস্য জায়গায়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিভিন্ন আয়োজনে তাঁর উপস্থিতি ও বক্তব্যে যে আত্মবিশ্বাস ঠিকরে পড়ে সেটাই এখন বাংলাদেশের চিত্র। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। যে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে সরে গিয়েছিল, সেই বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে এসে দারিদ্র্য বিমোচনে বিশ্বকে বাংলাদেশ থেকে শিখতে বলেন।

নেতৃত্বের, ব্যক্তিত্বের এই চরম উৎকর্ষের সময়েই শেখ হাসিনার ইমেজে লেগেছে সবচেয়ে কলঙ্কের কালি। ৭১ বছরজুড়েই গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করা আওয়ামী লীগের ঝুলিতে এখন দুটি বিতর্কিত নির্বাচনের কলঙ্ক। ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’র সময়েই দেশে গণতান্ত্রিক স্পেসের সবচেয়ে বড় সঙ্কটের অভিযোগ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মতপ্রকাশের অধিকার কেড়ে নেয়ার শঙ্কা। বঙ্গবন্ধুর খুনি ও যুদ্ধাপরাধীর বিচার করে যিনি আইনের শাসনের জয়গান করেন, তার আমলেই বিচারবহির্ভুত হত্যা, গুম বড্ড বেমানান। তার আমলে উন্নয়নের দোহাই দিয়ে এখন বাংলাদেশে মানবাধিকার-গণতন্ত্রকে আড়াল করা হচ্ছে। যতই উন্নয়নের দোহাই দেয়া হোক, গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। গণতান্ত্রিক পন্থায় উন্নয়নই টেকসই উন্নয়ন।

শেখ হাসিনার অনেক অর্জন ম্লান হয়ে যায় দুর্নীতি আর দলীয় নেতাকর্মীদের নানান অপকর্মে। দেশ অনেক এগিয়েছে, এগুচ্ছে। উন্নয়ন কাজ হচ্ছে অনেক। এখন শেখ হাসিনাকে নিশ্চিত করতে হবে দুর্নীতিমুক্ত টেকসই উন্নয়ন। নিশ্চিত করতে হবে সুশাসন। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপি-নেতাদের অনেকেই জনবিচ্ছিন্ন, কর্মীবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। অনেক এমপি নিজ নিজ এলাকায় একচ্ছত্র্য আধিপত্য কায়েম করেছেন। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধেও অনেক অভিযোগ। আওয়ামী লীগের অনেকেই বঙ্গবন্ধু বা শেখ হাসিনার সত্যিকারের চেতনা ধারণ করে না। দলের দরজা খুলে দেয়ায় বিভিন্ন দল থেকে ক্ষমতালোভী ধান্দাবাজ হাইব্রিডদের ভিড় এখন আওয়ামী লীগে। এখানে শেখ হাসিনাকে শক্ত হতে হবে, নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে। এমপি-মন্ত্রীদের পাঠাতে হবে মাটির কাছে, মানুষের কাছে।

আগেই বলেছি, শেখ হাসিনা একসঙ্গে অনেক চরিত্রে অভিনয় করেন। শেখ হাসিনা হলেন বাঙালি মুসলমানের চিরন্তন চরিত্র। যার দিন শুরু হয় ফজর নামাজ আর কোরান তেলাওয়াত দিয়ে, তাকেই কিনা শুনতে হয় নাস্তিকদের নেত্রীর অভিযোগ। আমি জানি তিনি একই সঙ্গে ধর্মপ্রাণ মুসলমান এবং সত্যিকারের অসাম্প্রদায়িক। তবুও ভোটের রাজনীতির বিবেচনায় তাকে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার পাশাপাশি রাষ্ট্রধর্ম বহাল রাখতে হয়। শত্রু জেনেও হেফাজতে ইসলামকে আস্থায় রাখতে হয়। ’নাস্তিকদের নেত্রী’ এই বদনাম ঘোচাতে মেনে নিতে হয় হেফাজতের অনেক অন্যায় আবদারও। শেখ হাসিনা নিশ্চয়ই জানেন একটি উন্নত, উদার, অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্নে একাত্তরে দেশ স্বাধীন হয়েছিল। ভোটের জন্য যতই কৌশল করেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূলধারা থেকে কখনো যেন বাংলাদেশ বিচ্যুত না হয়।

এত ব্যস্ততার মধ্যেও বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী শেখ হাসিনা বই পড়েন, সাহিত্যের খোঁজ খবর রাখেন। নিজে লেখালেখি করেন। কোনো অনুষ্ঠানে সুযোগ পেলেই প্রিয় গানে গলা মেলান। প্রিয় শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার জন্মদিনে টেলিভিশনের সরাসরি অনুষ্ঠানে ফোন করে চমকে দেন সবাইকে। চতুর্থ শ্রেনীর ছাত্রের চিঠির জবাব দেন। ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিতে আসা মুক্তামনির জন্য চকলেট পাঠান। তার সঙ্গে কথা বলে চাওয়া শিশুর মোবাইলে ভিডিও কল করে চমকে দেন। কবি নির্মলেন্দু গুণ বা কবি হেলাল হাফিজের অসুস্থতার খবর শুনে তাদের ডেকে এনে পাশে দাড়ান। কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকদের বিপদে এমন মমতা নিয়ে পাশে দাড়ান; কৃতজ্ঞ হয়ে যায় সবাই। বিএনপি সমর্থক হিসেবে পরিচিত আমজাদ হোসেন বা আহমেদ শরীফও তার আনুকূল্য থেকে বঞ্চিত নন। শেখ হাসিনার যেন একশোটা হাত, হাজারটা চোখ। কোনো কিছুই তার দৃষ্টি এড়ায় না।

শত্রুমিত্র খুব ভালো চেনেন শেখ হাসিনা। এটা চিনেছেন তিনি পরিবারের সবাইকে হারিয়ে। তবুও তিনি বিশ্বাস করেন, ক্ষমা করেছি, কিন্তু ভুলবো না। তাই তো মোশতাক মন্ত্রিসভার সদস্যরা তার দলের এমপি হন; ১৫ আগস্ট যিনি বঙ্গবন্ধুকে পালানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন, সেই কাপুরুষ সেনাপ্রধানও বরিত হন আওয়ামী লীগে। যাদের জন্মই হয়েছিল আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করার জন্য, সেই জাসদ নেতারা তার মন্ত্রিসভায় থাকেন। ওয়ান ইলাভেনের মাইনাসপন্থিরাও তার চারপাশে ভিড়ে যায় অনায়াসে। শত্রুকে ক্ষমা করে দেয়ার এই মহৎ গুণটিও তিনি পেয়েছেন, তাঁর পিতার কাছ থেকে। শেখ হাসিনা জেনেশুনেই করেন এসব। তিনি জানেন, সুযোগ পেলে তার চারপাশের অনেকেই ছোবল মারার জন্য বিষ সঞ্চয় করছেন, তবুও শত্রুকে অনুগত রাখতে, চোখে চোখে রাখতেই বুঝি ভালো লাগে তার।

আমার এতকিছু ভালো লাগে না। আমার ভালো লাগে শেখ হাসিনাকে। প্রধানমন্ত্রী নয়, বিশ্বনেত্রী নয়, জননেত্রী নয়, গণতন্ত্রের মানসকন্যা নয়; সবসময়ই শেখ হাসিনাকে আমার মনে হয় পাশের বাড়ির মমতাময়ী বড় বোন। শেখ হাসিনা নিজেকে এমন এক উচ্চতায় তুলে এনেছেন, তার চরম শত্রুও স্বীকার করেন, এই মুহূর্তে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প নেই। শেখ হাসিনার তুমুল সমালোচককে প্রশ্ন করেছি, বলুন তো শেখ হাসিনার চেয়ে ভালো প্রধানমন্ত্রী কে হবেন? উত্তর পাইনি। শেখ হাসিনা অনেকবার দলের দায়িত্ব ছাড়তে চেয়েছেন, পারেননি। আসলে পারবেনও না। বাংলাদেশের স্বার্থে, আওয়ামী লীগের স্বার্থে শেখ হাসিনাই উচিত তাঁর একজন যোগ্য উত্তরসূরি তৈরি করা।

৭৪তম জন্মদিনে শেখ হাসিনার জন্য প্রাণঢালা শুভেচ্ছা। দেশের স্বার্থেই তাঁর শতায়ু চাই।
২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০

এইচআর/জেআইএম