ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

জননেত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিনে শুভ কামনা

বিভুরঞ্জন সরকার | প্রকাশিত: ০৯:০৭ এএম, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, দেশের বৃহত্তম ও প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার আজ জন্মদিন। ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তার জন্ম গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায়। বাবা শেখ মুজিবুর রহমান, মা বেগম ফজিলাতুন্নেছা। বাবা রাজনীতিবিদ। স্কুলজীবন থেকেই শেখ মুজিবের রাজনীতিতে হাতেখড়ি। পাকিস্তান আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পরই নতুন উপলব্ধি। বাঙালির অধিকার ও মর্যাদা পাকিস্তান রাষ্ট্রে পূরণ হওয়া সম্ভব নয়। সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী প্রমুখ সিনিয়র নেতাদের নিয়ে গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই এগিয়ে নেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ নামের রাজনৈতিক দলের সৃষ্টি। তারপর তো ইতিহাস। জেল-জুলুম-অত্যাচার উপেক্ষা করে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর অব্যাহত সংগ্রাম। অনিশ্চিত জীবন। মানুষকে ভালোবেসেছিলেন শেখ মুজিব। মানুষও তাকে ভালোবাসা দিয়েছেন হৃদয় উজাড় করে। শাসকগোষ্ঠী তার জন্য ফাঁসির মঞ্চ তৈরি করেছে আর বাংলার দুঃখী মানুষ তার জন্য জায়গা করেছে হৃদয়মন্দিরে। গণশক্তির প্রবল চাপ তাকে কারামুক্ত করেছে। বঙ্গবন্ধু হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সত্তরের নির্বাচনে দিয়েছে একচেটিয়া ভোট। বাঙালির হয়ে লড়াই-সংগ্রামে নেতৃত্বদানের বৈধ অধিকার।

পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বুঝতে ও চিনতে ভুল করেছে বাঙালিকে। বাঙালির নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের তেজ ও দীপ্তি নিয়েও তাদের সঠিক ধারণা ছিল না। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার বদলে ইয়াহিয়া-ভুট্টোচক্র বাঙালির ওপর সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের পতন অনিবার্য করে তোলে। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের। তাই শেখ হাসিনার বাবা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা তথা জাতির পিতা। তার মা গৃহবধূ হলেও রাজনীতিবিমুখ ছিলেন না। বরং বলা যায়, রাজনীতিবিদ স্বামীর সুখ-দুঃখের চিরসাথী হয়ে একদিকে তাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন, অন্যদিকে নানা উপায়ে দলের নেতাকর্মীদের ভরসাস্থল হয়ে উঠেছেন। সংসার, ছেলেমেয়ে মানুষ করা, স্বামীকে কারারমুক্ত করার আইনি লড়াই—সবদিক সামলে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক বিকাশের পথ বাধামুক্ত করেছেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা।

এমন বাবা-মায়ের বড় সন্তান শেখ হাসিনা। রাজনীতি তার অস্থিমজ্জায়। তিনি তার বাবার রাজনৈতিক উত্থান নিজের চোখে দেখেছেন। একদিকে শেখ মুজিব রাজনীতির গগনে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছেন, সবাইকে পেছনে ফেলে একদল বিশ্বস্ত সহযোগী নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন, অন্যদিকে শেখ হাসিনাও বেড়ে উঠছেন। ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে রাজনীতির পাঠ গ্রহণ করছেন। স্কুল-কলেজে পড়তেই নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতাও অর্জন করছিলেন। ১৯৬৬ সালে বেগম বদরুন্নেছা কলেজ ছাত্রী সংসদ নির্বাচনে ছাত্র লীগের প্রার্থী হিসেবে বিপুল ভোটে সহসভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন।

শেখ হাসিনা একজন রাজনীতিবিদ হয়ে উঠুন কিংবা রাজনীতির মতো একটি অনিশ্চিত ও ঝুঁকিপূর্ণ জীবন তার কন্যা বেছে নিক—সেটা সম্ভবত শেখ মুজিবুর রহমান চাননি। বিশেষ করে তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দেওয়ার পর তিনি হয়তো পরিবারের, স্ত্রী-সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠায় ছিলেন। সে জন্যই হয়তো বড় মেয়ে শেখ হাসিনার পড়াশোনা শেষ না হতেই বিয়ে দিয়ে দেন পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে। স্বামীর সংসারে গিয়ে মেয়ের জীবন নিরাপদ হবে—বঙ্গবন্ধু হয়তো তা-ই ভেবেছিলেন। হয়েছেও তাই। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ হাসিনা যদি স্বামীর সঙ্গে বিদেশে না থাকতেন, তাহলে তার কি পরিণতি হতো—কল্পনা করলেও গা শিউড়ে ওঠে।

শেখ হাসিনা যে রাজনীতিতে এলেন, তিনি যে আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নিলেন, রাজনৈতিক পণ্ডিতদের সব ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা প্রমাণ করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনলেন—এর কোনোটাই কি হওয়ার কথা ছিল? তার রাজনীতিতে আসা কোনো আনন্দযাত্রার মাধ্যমে নয়। তিনি রাজনীতিতে এলেন শোক, বেদনা, অশ্রুর সরণি বেয়ে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদল কুলাঙ্গার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা—বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা সেদিন দেশের বাইরে থাকায় সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। বাবা-মা, ভাই-ভ্রাতৃবধূসহ আরও অনেক আপনজন হারানোর দুর্ভার বেদনা নিয়ে তাদের এই বেঁচে থাকা কত কষ্টের, সেটা শুধু তারাই জানেন।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। রাজনীতির গতিপথ বদলে দেওয়াই ছিল মূল লক্ষ্য। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ যেন আর মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, স্বাধীনতার চেতনাবাহী কোনও দল বা ব্যক্তি যেন রাজনীতির মূলধারা হয়ে উঠতে না পারে, সে অপচেষ্টাই মুজিব-হত্যা পরবর্তী সময়ে ক্ষমতাসীনরা পরিকল্পিত ভাবেই করছে। আওয়ামী লীগকে দুর্বল করা, দলের মধ্যে বিভেদ-কোন্দল তৈরি করে দলকে অজনপ্রিয় ও জনবিছিন্ন রাখা— এসব পরিস্থিতির মধ্যে ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয় দলের কাউন্সিল অধিবেশনে। তখন তিনি দিল্লিতে নির্বাসিত জীবন যাপন করছিলেন। ১৯৮১ সালের ১৭ মে এক বর্ষণমুখর বিকেলে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দেশে ফেরেন।

প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠতে কিছুটা সময় অবশ্যই লেগেছে। কিন্তু খুব দ্রুতই সবার কাছে, এমনকি দলের ‘চাচা'দের কাছেও এটা স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে যে, তিনি মুজিব-কন্যা। রক্তে তার রাজনীতি। বাবা যেমন ক্রমাগত নিজেকে অতিক্রম করে সবার থেকে আলাদা হয়ে উঠেছেন, ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন, কন্যাও তেমনি ধাপে ধাপে নিজেকে প্রস্তুত করেছেন, কেবলই সামনে এগিয়েছেন। মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জন করেছেন। চলার পথটা মোটেও মসৃণ ছিল না। ষড়যন্ত্র ছিল—ভেতর থেকেও যেমনি, বাইরে থেকেও তেমনি। পিতার মতো নেতৃত্বগুণ শেখ হাসিনার মধ্যে আছে কিনা, সে সংশয় কারও কারও মধ্যে ছিল। তাকে অসফল প্রমাণ করার অপচেষ্টাও ছিল। কিন্তু সব বাধা ডিঙিয়ে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের একজন সফল রাজনীতিবিদ, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একজন রাষ্ট্রনায়ক হয়ে উঠেছেন । নানাভাবে এই স্বীকৃতি তিনি পেয়েছেন। বিশ্বের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় তাকে যেমন সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি যেমন দিয়েছে, তেমনি তিনি তার কাজের স্বীকৃতি হিসেবে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক পদক ও পুরস্কার পেয়েছেন।

শেখ হাসিনা একাধিকবার বলেছেন, তিনি রাজনীতি করেন দেশের মানুষকে কিছু দেওয়ার জন্য। সবাইকে হয়তো এখনো চাহিদামতো সবকিছু দিতে পারেননি, তবে তিনি তার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। তিনি ধৈর্য, সাহস ও বিচক্ষণতার সঙ্গে পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে রাখার নজির স্থাপন করেছেন। সংকট সমাধানে তার রয়েছে এক জাদুকরি ক্ষমতা। বিশ্বে দীর্ঘস্থায়ী নারী সরকার প্রধান। দুনিয়াব্যাপী সৎ নেতৃত্বের তালিকায় তার অবস্থান তৃতীয়। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ পেয়েছে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা। এরপর তার লক্ষ্য মধ্যম আয়ের দেশ এবং উন্নত দেশের কাতারে বাংলাদেশকে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু তার এই যাত্রাপথ নিষ্কণ্টক ছিল না। তাকে একাধিকবার গৃহবন্দি কিংবা কারাগারে রাখা হয়েছে। তাকে হত্যার চেষ্টাও করা হয়েছে অসংখ্যবার। কিন্তু কথায় বলে -রাখে আল্লাহ, মারে কে!

শেখ হাসিনা নির্ভীকভাবে দেশ ও মানুষের খেদমত করে চলেছেন। তিনি ক্ষমতায় এসে দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে যেমন মনোযোগী হয়েছেন, তেমনি মানুষের জীবনমান উন্নয়নেও অবদান রাখছেন। দেশের ভেতরে শান্তি ও স্থিতি রক্ষার পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তাবলয় তৈরি করে সুস্থ অসহায় মানুষদের জীবনের অনিশ্চয়তা দূর করেছেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ তারই উপহার। তিনি ক্ষমতায় এসে দেশে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমিয়েছেন, তার সময় মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমেছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতুর মতো বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের দৃঢ়তা দেখিয়ে বাংলাদেশকে বিশ্বসভায় ভিন্ন মর্যাদায় আসীন করার কৃতিত্ব শেখ হাসিনারই।

রাজনীতি যদিও তার সার্বক্ষণিক কাজ, তবু সময়-সুযোগ পেলেই তিনি লেখালেখি করেন। লেখালেখিটাকে হয়তো তিনি তার অবসর ও বিনোদনের উপায় হিসেবে গ্রহণ করেন। তার লেখা বেশ কয়েকটি বই পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বই হলো : শেখ মুজিব আমার পিতা, ওরা টোকাই কেন?, দারিদ্র্য বিমোচন, কিছু ভাবনা, বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের জন্ম, আমার স্বপ্ন আমার সাধনা, আমরা জনগণের কথা বলতে এসেছি, সামরিকতন্ত্র বনাম গণতন্ত্র, সবুজ মাঠ পেরিয়ে ইত্যাদি। বইগুলোর নাম থেকেই এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা তিনটি বই -অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা এবং দেখে এলাম নয়াচীন- প্রকাশ করে পাঠকদের হাতে তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রেও শেখ হাসিনা যে নিরলস শ্রম দিয়েছেন, তার জন্য তিনি অবশ্যই প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। শেখ হাসিনার উদ্যোগ ও লেগে থাকার ধৈর্য্য ছাড়া এই বইগুলো আলোর মুখ দেখতো না। বঙ্গবন্ধুর লেখক সত্তাও দেশবাসীর কাছে অজানা থাকতো।

শেখ হাসিনা মানেই এখন নতুন এক সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ। তিনি প্রমাণ করেছেন যে, তিনি দেশ অন্তঃপ্রাণ। তিনি সুস্থ এবং কর্মক্ষম থাকলে বাংলাদেশের এগিয়ে চলা বন্ধ হবে না। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে তিনি বিশ্বব্যাপী নন্দিত হয়েছেন। মাদার অব হিউমিনিটি খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। জন্মদিনে শেখ হাসিনাকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

এইচআর/জেআইএম