‘যোদ্ধা’র জন্য শুভেচ্ছা
প্রিয় ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন মন ছুঁয়ে যাওয়া এক ছড়ায় প্রশ্ন করেছেন,
“দুই পেয়ে সারমেয় দেখেছো কি কেউ?
কুকুর নিধন চেয়ে করে ঘেউ ঘেউ।”
সারমেয় শব্দের অর্থ খরগোশ, হরিণ, কুকুর, সারস। ছড়াকার কুকুর নিধন চেয়ে ঘেউ ঘেউ করতে থাকা প্রাণীদের মানুষ বলতে পারেননি, সারমেয় শব্দটা ব্যবহার করেছেন তীব্র ঘৃণা প্রকাশে সাহায্য হবে ভেবে। যারা ভাবে সুন্দর পৃথিবীতে কেবল মানুষেরই আছে বেঁচে থাকার অধিকার, পশু-পাখি-প্রাণীদের মোটেও নেই, সেই সব প্রাণীদের মানুষ বলা যায় না। পশুদের কোনো নামও এদের জন্য প্রযোজ্য নয়, কেননা পশুরা সবাইকে বাদ দিয়ে কেবল নিজে বেঁচে থাকার কূটকৌশল করে কি না তা জানতে গবেষক হতে হবে। এদের জন্য মিষ্টি হরিণ-খরগোশ-কুকুর-সারস বোঝাতে ব্যবহৃত সারমেয় শব্দটিও প্রযোজ্য নয়। সারমেয় শব্দটি তীব্র প্রতীবাদ জানাতে বলেছে আমাকে। বলেছে, তোমরা মানুষরা এত কিছু পার, মানুষ হয়েও মানুষের মতো কাজ যারা করছে না, তাদের ডাকতে হলে পশুর নাম টান না দিয়ে নিজস্ব একটা শব্দ বানাতে পার না?
‘অমানুষ’ শব্দটা আমার পছন্দ হয়েছে। মানুষ না, অমানুষ। অমানুষ কিন্তু পশু নয়। মানুষ না হলেই সে পশু হয়, এ জ্ঞান বদলে নিন দয়া করে এবং এরপর খবরটি ছবিসহ পড়ুন মনোযোগ দিয়ে। রাস্তা কুকুরমুক্ত করার জন্য একদল অমানুষ ব্যানার ধরে দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তা নাকি কেবল তাদের, কেননা তারা ট্যাক্স দেয়, রাস্তার ওপর হেঁটে রাস্তাকে ধন্য করে, রাস্তা দখল করার মতো তাকদ দেখিয়ে গর্বিত/বিস্মিত/দুঃখিত করতে পারে অন্যদের।
এই খবর শেয়ার হয়েছে সামাজিক মাধ্যমেও। দেশ আর দেশের মানুষ কত খারাপ, তার বর্ণনা চলছে নানা আঙ্গিকে। মানুষের মনে আর দয়া নাই, মায়া নাই। মমতা শব্দটা বিলুপ্তপ্রায়। এ কথার সাথে আমি মোটেও একমত নই। মাত্র কয়েকটা অমানুষের জন্য দেশের মানুষের বদনাম হয়, এই অমানুষদের জন্ম দেওয়ার কারণে এত সুন্দর দেশটাও গালি খায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসের ২১ তারিখে দেওয়া এক ভাষণে বলেছিলেন, ‘মাত্র কয়েকটা লোকের জন্যই বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ দূর করা যায় না।’ কথা কিন্তু সত্য। কিছু দিন পরই নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া জাতির পিতা জীবন দিয়ে বুঝিয়ে গেলেন, মাত্র কয়েকটা লোকের জন্যই কীভাবে দুর্ভাগ্য ঘিরে ধরতে পারে গোটা একটা জাতিকে!
মাত্র কয়েকটা অমানুষ কুকুর নিধন চাইছে বলে এই বিপদে পশু-পাখিদের পাশে দাঁড়ানো মানুষদের কথা ভুলে যেতে পারি না। তখনি মনে এল শব্দটা। কোইনসিডেন্স!!
‘কোইনসিডেন্স’ ইংরেজি শব্দ হলেও বাংলা হয়ে গেছে। এর অর্থ যে বাংলা শব্দ ‘কাকতালীয়’ তা কাকদের কা কা ডাক শুনলেও মনে পড়তে চায় না। আজ মনে পড়ল। ছড়াটা লিখতে হয়েছে যে ঘটনার জন্য, তার সাথে কয়েক মাস আগে দেখা আরেকটা ঘটনা মনে পড়ে যেতেই মুখ ফুটে বেরিয়ে পড়ে শব্দটা। কাকতালীয়-ই বটে!
দৈনিক যায়যায়দিন পত্রিকায় ছবিসহ খবরটা বের হয়েছিল কোভিড-নাইন্টিন মহামারিতে লকডাউন শুরু হওয়ার পরে পরে। তারিখটা নিশ্চিত হতে গুগলের সাহায্য নেই। ১১ই এপ্রিল। শাড়িপরা এক নারীর মুখে মাস্ক, একটি ক্ষুধার্ত কুকুরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। কুকুরটির ভঙ্গি দেখেই মনে হয়েছিল ও ক্ষুধার্ত, ওর ঘেউ ঘেউ ডাক আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম। অনুভব করেছিলাম ওর ডাকের অর্থ। ও বলছিল, আমার খিদে পেয়েছে। তোমরা কী ঘোড়াড্ডিম লকডাউন-টাউন করছ, হোটেল-টোটেল বন্ধ, দোকান-টোকান বন্ধ, মানুষ-টানুষ বের হচ্ছে না পথে-টথে। তোমাদের ছুঁড়ে মারা উচ্ছিষ্ঠ খেয়েই তো বেঁচে থাকি আমরা। এখন খাবার নেই, কিন্তু খিদে তো আছে। কাজ হারানো মানুষদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাবার দিচ্ছ। আমাদের খোঁজ রেখেছ?
মাস্কের ভেতর থেকে ভেসে আসে নারী কণ্ঠ। বলছেন, কুকুর-বেড়ালদের বেহাল অবস্থার খোঁজ তিনি রাখেন। তাই বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষদের যেভাবে খাবার দিচ্ছেন, কুকুর-বেড়ালদেরও দিচ্ছেন।
এই যে আমি তোমার কাছে এসেছি।
কুকুরটি নরম স্বরে কুঁই কুঁই করে ডেকে ওঠে। এর অর্থ-ধন্যবাদ।
সামনে রাখা খাবারের থালা চোখ ভিজিয়ে দেয় একেবারে। মানুষটাকে আরেকবার দেখতে চেয়েছিল। ভেজা চোখ দেখতে দেয়নি। খিদের তোপে তাকানোর চেষ্টাও করেনি। খাওয়া শেষ হলে দেখেছিল, চলে গেছেন তিনি। তবে আবারো যখন তার সাথে ওর দেখা হয়েছিল, ও দিব্যি চিনেছিল মানুষটাকে। সাথিদের বলেছিল, দেখেছিস্! মানুষ কিন্তু এরকমই হয়। দেখতে মানুষের মতো বলে বলছি না। মনটা একদম মানুষের মতো। তাই কাজটাও মানুষের।
মানুষের মতো কাজ করা সেই মানুষটার নাম ওয়াহিদা খানম। তিনি ঘোড়াঘাট উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে মহামারীর সময়টাকে সামলে নিতে উপজেলার মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন আপন মানুষ হিসেবে। সারা দেশে বিভিন্ন শ্রেনি-পেশার মানুষ এই সময়টায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু পশুদের অসহায়ত্বের কথা ভাবতে পেরেছেন খুব কম মানুষ। তিনি তাদেরই অন্যতম।
এতগুলো দিন পার করে এসে টের পাচ্ছি, বেঁচে আছি এখনো। তাই সেই এপ্রিলের খবরটা এত জোরে ধাক্কা বসিয়ে দেয় আমাকে, যখন শুনি একজন সরকারি কর্মকর্তা মৃত্যুর সাথে লড়ছেন, কেননা তার মাথায় হাতুড়ির বাড়ি-খুলি দেবে গেছে ভেতরে-সরকারি বাসায় রাতে ঘুমিয়ে থাকার সময় দুর্বৃত্তরা ভেন্টিলেটর দিয়ে ঘরে ঢুকে তাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল-হত্যা করাই ছিল একমাত্র উদ্দেশ্য-তার বাবাও গুরুতর আহত-বিছানায় ঘুমিয়ে ছিল তার তিন বছরের শিশু..।
নর্স পুরানের চরিত্র ‘থর’ এর মতো হাতুড়ি নিয়ে ঢোকা দুর্বৃত্তরা সেই মানুষটিকে হত্যা করতে চেয়েছিল, যিনি এই মহামারির সময়ে সম্মুখসারিতে থেকে মানুষের জন্য তো বটেই, পশুদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য যুদ্ধ করছিলেন। কেবলমাত্র সরকারি সাহায্য নয়, ব্যক্তিগত অর্থায়নে এই যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। তার বিনিময়ে জনসাধারণের ভালোবাসা পেয়েছিলেন। মহামারির আগেও সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানো এই মানুষটির নানা কর্মতৎপরতার খবর পত্রিকার অনলাইনপাতায় ভেসে বেড়াচ্ছে ইন্টারনেটে। ৩ সেপ্টেম্বরের পর থেকেই এইসব খবরের সাথে আছে মৃত্যুর সাথে লড়তে থাকা ওয়াহিদা খানমের খবর।
মাঠ পর্যায়ে কর্মরত নারী কর্মকর্তাদের যুদ্ধটা কী রকম, তা কাছ থেকে না দেখলে বোঝা যায় না। চাকরির শুরুতে স্বামীর কর্মস্থল একই জায়গা হয় না বলে প্রায় একাকি ছোট শিশু সামলে, রান্না-সংসার সামলে জনস্বার্থে দায়িত্ব পালনের কষ্ট নিয়ে মেয়ো খুব বেশি কিছু বলেন না। কেননা, তখন শুনতে হবে- কেনো যান্ চাকরি করতে? মেয়েদের কাজ ঘর সামলানো হ্যানো ত্যানো। পুরুষ কর্মকর্তাদের কষ্টও কম নয়, তবে নারীদের ক্ষেত্রে এটি আক্ষরিক অর্থেই যুদ্ধ। নারীর দায়িত্বপালনে বিন্দুমাত্র দোষ ধরা পড়লে তাকে কিন্তু নারী বলেই নোংরা-অশ্লীল সামাজিক আক্রমণের শিকার হতে হয়, পুরুষের ক্ষেত্রে তেমনটি হয় না। এতসব সামলে নারীর ক্ষমতায়নে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাংলাদেশ। কতটা ব্যাপক নারীর এই যুদ্ধ, বেগম রোকেয়া বেঁচে থাকলে সত্যিই খুশি হতেন জেনে।
ওয়াহিদা খানম যুদ্ধ করছিলেন। তিনি আক্রান্ত হয়েছেন। কিছু দিন আগে ডা. রাকিব আক্রান্ত হয়ে মর্মান্তিকভাবে নিহত হয়েছেন, প্রকৌশলী দেলোয়ার নির্মম হত্যার শিকার হয়েছেন। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কর্মকর্তারা আক্রান্ত হবেন, এটা মোটেও কাম্য নয়। এ ক্ষেত্রে নারীর উপর হামলার মাত্রা আরও ব্যাপক। নারীকে সমাজপ্রণীত শিক্ষায় দুর্বল ভাবা হয়, তাই তাকে সহজ শিকার ভাবা হচ্ছে না তো?
হামলার কারণ যা-ই হোক, সত্য বেরিয়ে আসুক তদন্তে। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক, যাতে দেশের মানুষের দেখভালের যুদ্ধে নামা যোদ্ধারা সাহস ফিরে পান আর সমাজ পাক কঠোর বার্তা- অন্যায়ের রেহাই নেই। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াহিদা খানম ফিরে আসুন জীবনের মঞ্চে। মানুষ কেমন হয়, তার কত উদাহরণ সৃষ্টি করছিলেন আপনি, আরও কত কাজ বাকি আছে আপনার। ভয়াবহ আঘাত সামলে নিতে শরীরটা নিয়ে আপনাকে হয়তো আরও একটি যুদ্ধে ব্যস্ত থাকতে হবে বাকি জীবন। বিছানায় ঘুমিয়ে ছিল আপনার শিশুটি, অলৌকিকভাবে যে বেঁচে ছিল ভয়াবহ রাতটায়, তার মানসিক আঘাতের ধাক্কা ভ‚কম্পনের মতো কাঁপিয়ে দেবে আপনাকেও। এ সবই সত্য। তবে, এও সত্য, সব মানুষের ভালোবাসা আর দোয়া আপনাকে ঘিরে রাখবে, যা এই যুদ্ধে কিছুটা হলেও শক্তি জোগাবে। অমানুষদের হটিয়ে পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্য করার যুদ্ধে আপনাকে জয়ী হতেই হবে যে বোন!
লেখক : কথাসাহিত্যিক।
এইচআর/জেআইএম