আওয়ামী লীগের ‘উপ’ বাছাই : দুটি প্রস্তাব
ভয়ে বলবো না নির্ভয়ে বলবো বুঝতে পারছি না। আমার মতের সাথে ভিন্ন মত পোষণ করে যে কেউ অবস্থান নিতেই পারেন। কিন্তু আজকালতো যুক্তি আর তথ্যের লড়াইয়ে কেউ আসতে চান না। কাউকে বা কারো বক্তব্য পছন্দ না হলেই সারমেয় শাবক দল ব্যক্তিগত মাধ্যমে ঘেউঘেউ শুরু করে। এই দেশীয় সারমেয় শাবকদের সাথে ঘেউঘেউয়ে সামিল হয় নানা কারণে দেশ থেকে তাড়া খেয়ে বিদেশে পাড়ি দেয়া সারমেয় দলও ।
তবুও ঝুঁকি নিয়ে বলি আওয়ামী লীগের মতো বড় দলের 'উপ' দরকারটা কী? কোনো বিশেষ বিষয়ে, যেমন সম্মেলন করার সময় বিষয়ভিত্তিক উপ-কমিটিতো হয়ই। তবু যদি লাগেই তাহলে সেটি ৫/৭/৯/১১ সদস্যের মধ্যেই থাকুক। যেটি একটি কার্যকর কমিটি হবে। কিন্তু যা দেখছি তাতে তো কলেবর বাড়ছেই, কলহেরও সমূহ সম্ভাবনা। সংগঠন পরিচালনার জন্য, নাকি কতিপয়কে পুনর্বাসনের জন্য এই কমিটি করার উদ্যোগ ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তৃণমূল থেকে নেতৃত্ব তুলে আনা যদি লক্ষ্য হয়, তা হলে তো কাউকে পদ না দেয়াই উচিত। দেখা যাক পদ না পেয়ে কে কী ভূমিকা রাখে। সেখান থেকে যোগ্যদের নিয়ে আসা হবে। যোগ্যরা নেতাদের চোখে পরবেনই, যদি নেতাদের জহুরী চোখ থাকে। অজগ্রাম টুঙ্গিপাড়ার খোকাকে তো হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ঠিক্ই বেছে নিয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের গন্ডগ্রামের এক অখ্যাত কলেজ শিক্ষক প্রণব মুখার্জীকে চিনতে তো শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ভুল করেননি।
আওয়ামী লীগে 'উপ' নেয়া হবে এই খবরে সাজ সাজ রব। 'ভাই' 'দাদা' আর 'লিডার'দের চেম্বার নাকি সরগরম। এই 'ভাই' 'দাদা' আর 'লিডার'দের নেক নজর কাড়তে 'উপভাই' 'উপদাদা' আর ' উপলিডার'দেরও দ্বারস্থ হওয়া শুরু হয়ে গেছে।
এই 'উপ' নিয়ে দলে কেলেঙ্কারি কম হয়নি। যদিও এবার বলা হচ্ছে এইসব 'উপ’দের দায় দল নেবে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো একবার 'উপ’ হয়ে গেলে দল তাদের দায় এড়াতে পারবে না। মূল নিয়ে এদিক সেদিক হলে হয়তো মেনে নেয়া যায় কিন্তু 'উপ' জ্বালায় যখন সংসারে আগুন ধরে তখন কাহাতক সহ্য করা যায়! সেজন্য এক প্রবীণ রসিক বলছেন: ভাই 'উপ' মানেই সমস্যা। এক পত্নী সামলাতেই হিমসিম অবস্থা, সেখানে উপপত্নীর আগমন আর দাপটে সংসার টেকানোই মুশকিল। দলের মধ্যে উপদল হলে সেইদলের সর্বনাশের বারোটা বাজতে আর বাকি থাকে না।
এই টুকুতেই শত্রু বাড়লো বিলক্ষণ বুঝতে পারছি। 'উপ' প্রত্যাশীরা যে তেড়ে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন সেটাও বুঝি। অনেক 'উপ' প্রত্যাশী ভাবছেন তাদের বাড়াভাতে ছাই দেয়ার জন্যই এই রচনা। জবাবে বলি : একেবারেই না। আমিতো বলি যোগ্য হলে 'উপ' কেন, মূল পদেই ঢুকে পড়ুন।
এই 'উপ' নিয়ে অতীত অভিজ্ঞতা কী? তরুণ সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম রনি রিপোর্ট লিখেছেন: বহুমুখী প্রতারক সাহেদরা যেন আর আওয়ামী লীগের উপকমিটির সদস্য হতে না পারে সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় সম্পাদককে সতর্ক করা হয়েছে। একই সঙ্গে দায়দায়িত্ব বহন করতে হবে বলে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠকে তাদের সতর্ক করেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। দলের যুগ্মসম্পাদকরাও বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করে বলেন, কোনো ভুল হলে এর দায়ভার দল বহন করবে না, সংশ্লিষ্ট সম্পাদকদেরই বহন করতে হবে।
বৈঠকে আওয়ামী লীগের সাবেক আন্তর্জাতিক উপকমিটির সদস্য বহুমুখী প্রতারক সাহেদকে নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পাদক ড. শাম্মী আহমেদের সঙ্গে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের মৃদু বাদানুবাদ হয়। সাহেদরা কীভাবে দলের আন্তর্জাতিক কমিটিতে স্থান পান জানতে চান দলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। দলের আন্তর্জাতিক সম্পাদক ড. শাম্মী আহমেদ প্রত্যুত্তরে একটি তালিকা দেখিয়ে বলেন, ‘সাহেদ করিম আমার কমিটিতে ছিল না।’ এ সময় সম্পাদকমণ্ডলীর দুজন সদস্য বলেন, ‘সাহেদ করিমকে তো বিভিন্ন প্রোগ্রামে দেখা গেছে এবং বক্তৃতা করেছেন।’ জবাবে শাম্মী আহমেদ বলেন, ‘চেয়ারম্যান যদি কাউকে নিয়ে যান আমার কী করার আছে?’
দলের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস বলেন, ‘আমি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক। গত কমিটিতেও একই পদে ছিলাম। কিন্তু কাজ করতে পারিনি। কেন পারিনি তাও কেউ জিজ্ঞেস করেনি।’ তিনি বলেন, গত মেয়াদে একজনকে আমার উপকমিটির মিটিংয়ে জিজ্ঞেস করলাম আপনি কে?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘আমি উপকমিটির সদস্য।’ সে উপকমিটির সদস্য, অথচ আমি সদস্যসচিব হিসেবে জানি না! বোঝেন ঠেলা! দলের মূল সম্পাদক বা উপ কমিটির সদস্য সচিব চেনেন না কিন্তু কমিটিতে হাজির হয়েছে 'উপ'রা। নিশ্চয়ই গোড়ার মাটি শক্ত।
এতো দেখি বিএনপির অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানকে নিয়ে শোনা গল্পের মতো। সাইফুর রহমান নাকি মন্ত্রণালয়ে যাবেন বলে লিফটে উঠেছেন, হঠাৎ একজন নাকি উঠে পড়েছেন তার সাথে। একটু বিরক্ত অর্থমন্ত্রী বনেদি সিলেটী উচ্চারণে সেই আগন্তুককে প্রশ্ন করেছেন, তুমি কে? আগন্তুক বিগলিত হাসি দিয়ে জানালেন স্যার, আমি অর্থ প্রতিমন্ত্রী। হায় রাজনীতি! মন্ত্রী তার প্রতিমন্ত্রীকে চেনেন না! বিস্মিত মন্ত্রীর স্বগতোক্তি : ম্যাডাম যে কোথা থেকে লোক এনে মন্ত্রিসভায় ঢুকিয়ে দেন? আওয়ামী লীগের উপকমিটিতে এই কাণ্ড ঘটেছে তা তো জানাই গেল।
গত আমলে এক 'উপ'র খপ্পরে পড়েছিলাম। সেই 'উপ' যদি দল পর্যন্ত থাকতো ক্ষতি হতো না। সে আবার সাংবাদিক হতে চায়। স্বয়ং দেবের আশীষ পাওয়া এই 'উপ'র জন্য তদবিরে অতিষ্ট। যতই বলি তাকে রাজনীতিতে আরও বড় পদে যান। কিন্তু অপকর্মের কারণে আগের অফিস থেকে চাকরি যাওয়া এই 'উপ'কে গিলতে হবে, গিলতে হলো। করতে চায় সাংবাদিকতা কিন্তু দেখায় প্রতিদিন যেতে হয় তিন নম্বরে। কোন ভাই বা দাদা তার জন্য অপেক্ষা করে। দাপটটা দেখানো আর কী! এই 'উপ'র ঘেউ ঘেউ এখনও শুনি।
একটি প্রশ্ন, সহযোগী সংগঠনগুলোর পূর্ণাঙ্গ কমিটির আগে এই 'উপ' নিয়ে তাড়াহুড়া কেন? মাঠে থাকবেন, ভবিষ্যতে দলের নেতৃত্ব দেবেন এমন নেতাকর্মীদের বাছাই করে আগে সহযোগী সংগঠনে যুক্ত করা হোক। পরে ভাবা হোক 'উপ'দের নিয়ে। কারণ অতীত অভিজ্ঞতা বলে এই 'উপ'দের দিয়ে দলের কোনো উপকার হয় না, যা উপকার হয় 'উপ'দের নিজেদের। ব্যাতিক্রম যে নেই তা নয়, হবে হয় তো হাতে গোনা ।
অধিকাংশ 'উপ' ভাই, দাদা বা লিডারের বদান্যতায় 'উপ' হন, কাজ করেন তার লাঠিয়াল হিসেবে, দলের জন্য নয়। 'উপ' পদটি পাওয়ার সাথে সাথে ছাপানো হয় একটি ভিজিটিং কার্ড। এই 'উপকার্ডে'র দাপটে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ বা প্রশাসনের কী অবস্থা হয় সেটি ওই সব কর্মকর্তাদের যে এসোসিয়েশন আছে তাদের কাছে শোনার অনুরোধ জানাই।
প্রকৃত পেশাদারদের এলাকা ছাড়তে হয়, আর না হয় বিলীন হতে হয় 'উপ'দের অপতদবিরে, অপকাজের মধ্যে। চতুর কর্মকর্তারাও এই ’উপ’র পেছন পেছন ঘোরেন নিজের প্রমোশন আর বদলির জন্য।
নেতারা যে এ সব জানেন না এমন নয়। প্রতিদিন প্রত্যূষে হেঁটে ফিরি মন্ত্রিপাড়া দিয়ে। ভোরবেলা 'উপ'দের হাত ধরে কতজন যে হাজির হন মন্ত্রী মহোদয়ের বাসভবনে তা চোখ বন্ধ করেও দেখা যায়। কান পাতলে মজাদার আলোচনাও শোনা যায় ।
যত কথাই বলি, দল যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটি কার্যকর হবেই। আওয়ামী লীগের শুভানুধ্যায়ী হিসেবে 'উপ' বাছাইয়ে দুটি প্রস্তাব রাখতে চাই ।
প্রস্তাব- ১: 'উপ'দের মধ্য ১০ ভাগ আসবে বিশিষ্টজন/ পেশাজীবীদের কোটা থেকে। দলীয় রাজনীতির প্রতি আনুগত্যে শর্তহীন হবেন এই বিশিষ্টজনরা। যেমন ধরা যাক, পরিবেশ বিষয়ক উপ কমিটিতে ১০ ভাগ থাকবেন হয় পরিবেশ বিজ্ঞানী, পরিবেশ বিষয়ে পড়ান এমন শিক্ষক বা শিক্ষার্থী। তেমনি স্বাস্থ্য বিষয়ক কমিটিতে চিকিৎসক, নার্স। ক্রীড়া বিষয়ক উপ কমিটিতে কৃতি ক্রীড়াবিদ, ক্রীড়া সংগঠক। নিশ্চয়ই ধারণা পাওয়া গেল। চাইলে মূল দলের নেতারাও এদের বাছাই করে দিতে পারেন।
প্রস্তাব ২ : আসলে এটি হচ্ছে আগের প্রস্তাবের বাকি অংশ। ১০ ভাগ যদি উল্লিখিত পদ্ধতিতে হয় বাকি ৯০ ভাগ হবে বাছাই পরীক্ষার মাধ্যমে। হ্যাঁ, পরীক্ষার মাধ্যমে। উপ কমিটির সম্পাদকরা যাদের নাম দেবেন তাদের একটি পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে। প্রশ্নপত্রটিও ফাঁস করে দিচ্ছি। ১০টি প্রশ্ন, মোট নম্বর ১০০। পরীক্ষার সময় এক ঘণ্টা।
প্রশ্নগুলো হচ্ছে:
১. কবির নামসহ বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ও রণ সঙ্গীত লিখুন।
২. বঙ্গবন্ধুর তিনটি বই থেকে তিনটি বিষয় উল্লেখ করা হবে। কোন বই থেকে বিষয়টি নেয়া হয়েছে সঠিকভাবে সেই বইটির নাম লিখুন।
৩. ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকরা কাদের হত্যা করেছিল তাদের সবার নাম লিখুন।
৪. এই হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের সবার নাম লিখুন।
৫. ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ কে কবে জারি করেছিল, কে কবে এটি আইনে পরিণত করেছিল, এটি কবে বাতিল হয় সন তারিখ লিখুন।
৬. বাংলাদেশের আয়তন কত? সমুদ্রসীমা বিজয়ে বাংলাদেশ কত আয়তন সমুদ্রের মালিক হয়েছে?
৭. বাংলাদেশের ইতিহাসে জড়িয়ে থাকা কয়েকটি তারিখ উল্লেখ করা হবে। লিখতে হবে এই তারিখগুলো কেন উল্লেখযোগ্য ।
৮. আপনার বিবেচনায় বাংলাদেশের ইতিহাস ও অগ্রযাত্রায় ৫ জন নেতা/নেত্রীর নাম লিখুন। কেন নামটি বললেন সেটি দুই লাইনে বলুন।
৯. দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা রচিত ৫টি বইয়ের নাম লিখুন।
১০. আপনি কেন উপকমিটির সদস্য হওয়ার যোগ্য ১০ লাইনে লিখুন।
এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের প্রাপ্ত নম্বর ও উত্তরপত্র সরাসরি দলীয় সভানেত্রী ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে দেয়া হবে। তারাই তালিকা চূড়ান্ত করবেন। এতে কাকে নেয়া হলো, কাকে বাদ দেয়া হলো তা নিয়ে বিতর্ক হবে না।
এই পরীক্ষায় অংশগগ্রহণকারীদের মেধা দেখে এটাও বোঝা যাবে, উপকমিটির সম্পাদকরা আসলে যোগ্যজনদেরই বাছাই করেছেন কি না। একটা কথা বলি এই প্রশ্নপত্রে কেউ যদি পাস নম্বর পায় তাকে দলের যেকোনো পর্যায়ে দায়িত্ব দিয়ে অনেকটাই নিশ্চিত থাকা যাবে। প্রশ্নপত্রতো দেয়াই হলো, প্রস্তুতি নিয়ে আসুন ও জবাব লিখুন।
কাঙ্গালের কথা বাসী হলেও ফলবে না তা জেনেই উলু বনে মুক্তা ছড়ানোর মতোই মুক্তা ছড়ালাম। কাজ নেই তাই খই ভেজেই বেড়াই বলে বলি : এই বাছাই প্রক্রিয়ায় কোনো সহযোগিতা চাওয়া হলে সানন্দে তাতে সংযুক্ত হতে সম্মত আছি, কোন 'উপ' হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে নয়।
এনএফ/এমএস