ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

প্রণব মুখার্জি : এক বাংলাদেশির চোখে

আনিস আলমগীর | প্রকাশিত: ১০:১৮ এএম, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২০

দ্বিতীয়বার তার সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে যখন বললাম, আপনি আগের মতো আছেন। একটা লাজুক প্রশান্তির হাসি দিয়ে প্রণব মুখার্জি বললেন, মাত্রতো ১০ বছরের ব্যবধান। যে সাক্ষাৎকারের কথা বলছি সেটিও আজ থেকে প্রায় ১০ বছর আগের, ৭ মে ২০১১ সালে, নতুন দিল্লির নর্থ ব্লকে। তিনি তখন অর্থমন্ত্রী আর আমরা একদল বাংলাদেশি সাংবাদিক গিয়েছিলাম ভারত সরকারের আমন্ত্রণে। প্রথমে সবার সঙ্গে মতবিনিময়, প্রশ্ন-উত্তর পালা হলো। পরে আমার অনুরোধে আমাকে টিভির জন্য একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন। তিনি সময় দিলেও ক্যামরার ব্যাটারি শেষ হয়ে যাওয়ায় সেটা সংক্ষেপই করতে হলো। ফলে ওই সাক্ষাৎকার নিয়ে আমার মনোকষ্ট এখনো রয়ে গেছে। আগের বারের যে উদাহরণ দিলাম সেটা ছিল ২০০১ সালের পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনকালে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যখন প্রথম নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী হলেন।

ঢাকা থেকে সেই নির্বাচন কভার করতে গিয়েছিলাম আমি। প্রণব মুখার্জির সঙ্গে তখন প্রথম সামনাসামনি দেখা, কলকাতায় কংগ্রেসের কার্যালয়ে। ফ্লোরে পেতে রাখা গদিতে বসেছিলেন তিনি। সেখানেই সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন আজকের কাগজ-এর জন্য। জানি না কংগ্রেস এখনো সে রকম গদিতে বসে মিটিং করে কিনা।

একটা জিনিষ লক্ষ করলাম, দু’বারের সাক্ষাৎকারেই বাংলাদেশের সীমান্তে নিরিহ মানুষকে বিএসএফ হত্যা করার প্রসঙ্গ এসেছিল। বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য ব্যবধান নিয়ে প্রশ্ন ছিল। তিনি সবক্ষেত্রেই বাংলাদেশের পক্ষ নিয়ে কথা বলেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য আজও সেই প্রশ্নগুলো অমীমাংসিত রয়ে গেছে। প্রণব মুখার্জি রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরও থামেনি সীমান্তে মানুষ হত্যা। বিজেপির আমলে সেটা আরও বড়েছে।

প্রণব মুখার্জির সঙ্গে তিনি ঢাকায় সফরকালেও একাধিকবার দেখা হয়েছে। সবসময় উনার একটা আন্তরিক ব্যবহার আমি লক্ষ করেছি বাংলাদেশিদের জন্য, যেটা অন্যান্য ভারতীয় নেতাদের মধ্যে কমই দেখেছি। ইন্দিরা গান্ধী ও প্রণব মুখার্জি ‘৭৫ পরবর্তী দুঃসময়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে দিল্লিতে থাকার ক্ষেত্রে সহায়তা করেছেন শুধু তো তাই নয়, বাংলাদেশ থেকে যে কেউ গিয়েছেন, চেয়ে উনার সাক্ষাৎ না পেয়ে ফিরে এসেছেন- এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিতো আমি খুঁজে পাই না। বরং তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঢাকা সফরকালে তারসঙ্গে সাক্ষাৎকার বাতিল করে খালেদা জিয়া ও বিএনপি ভারতের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করেছে- সেটা অনেকেই জানেন এবং পুরোনো বিষয়।

ফলে তাকে যে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু বলা হচ্ছে সেখানে শুধু রাষ্ট্রের দেনা-পাওনানির্ভর হিসাব না করাই ভালো। এমনকি সেই হিসাব করতে গেলেও বলতে হবে তিনি অর্থমন্ত্রী-পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে দু’দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন। ভারত প্রথম যে দুই বিলিয়ন ঋণের ঘোষণা দিয়েছিল বাংলাদেশের জন্য, তিনি মন্ত্রী হিসেবে ঢাকা সফরকালেই তা দিয়েছে।

যাক, সব হিসাব নিকাশের ঊর্ধ্বে উঠে গত ৩১ আগস্ট ২০২০ বিকেল পৌনে ৬টার দিল্লির একটি সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন প্রণব মুখার্জি। রাজনীতিবিদ হিসেবে যোগ্যতা থাকার পরও তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি কিন্তু প্রথম বাঙালি হিসেবে রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। ছিলেন কংগ্রেসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি নেতা।

ভারত উত্তম ব্যক্তিদের মধ্যে যারা সর্বোত্তম তাদের থেকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের এক সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিল, যার কারণে ১৩ জন রাষ্ট্রপতিই বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিলেন। বিপুলা ভারতের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত তারা সবাই জনপ্রিয় এবং শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন। ভারতের ত্রয়োদশ রাষ্ট্রপতি ছিলেন প্রণব মুখার্জি। প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন রাজেন্দ্র প্রসাদ। প্রণব মুখার্জি ছিলেন পশ্চিমবাংলার মানুষ আর প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ ছিলেন বিহারের লোক। মহাত্মা গান্ধী চেয়েছিলেন একজন হরিজনকন্যা ভারতের রাষ্ট্রপতি হোক। মহাত্মা গান্ধীর আশা পূর্ণ হয়নি। রাজনীতি এখন পুরোনো আবর্তে, মানে দেশভাগের আগের সেই সাম্প্রদায়িক পরিবেশে গিয়ে পড়েছে, হয়তো ভবিষ্যতে তা পূরণ হওয়া আরও কঠিন হবে।

প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ ভারতের স্থপতিদের একজন। মহাত্মা গান্ধী, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, রাজেন্দ্র প্রসাদ- মূলত এদেরকেই ভারতের স্বাধীনতার স্থপতি হিসেবে ঐতিহাসিকেরা বেছে নিয়েছেন। সত্যিই স্থপতি নির্বাচনে ঐতিহাসিকরা চূড়ান্ত নিরপেক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। কারণ ভারতের স্বাধীনতার জন্য এদের ত্যাগ তিতিক্ষার কোনো সীমা-পরিসীমা ছিল না। স্থপতিদের মধ্য থেকে শুধু রাজেন্দ্র প্রসাদ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। অবশ্য রাষ্ট্রপতিদের মধ্যে ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন, ড. জাকির হোসেন এবং ফখরুদ্দিন আলি আহমেদ- এরা স্থপতি না হলেও স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন।

ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠী তার ‘স্বাধীনতার মুখ’ গ্রন্থে বলেছেন ভারতে হিন্দু ধর্মাবলম্বী নেতৃবৃন্দের মধ্যে শুধু তিনজন অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি ছিলেন। একজন মহাত্মা গান্ধী, দ্বিতীয়জন জওহরলাল নেহরু আর তৃতীয়জন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। অন্য সব নেতার চরিত্রে ত্রিপাঠী কমবেশি সাম্প্রদায়িকতার লক্ষণ প্রত্যক্ষ করেছেন। নেহরু নিজেই বলতেন, ধর্ম নিয়ে নয় ধর্মের মানুষগুলো নিয়ে তার কারবার। ধর্মের প্রতি নেহরু ছিলেন উদাসীন। ধর্মের প্রতি মানুষের যতটুকু সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকে সুভাষচন্দ্র বসুর সেই দুর্বলতাও ছিল না। আর গান্ধীজি চলনে-বলনে হিন্দু ধর্মের একজন বড় সাধুসন্তের মতো ছিলেন কিন্তু তিনি কখনো কোনো মন্দিরে যাননি বা কোনো মূর্তির সামনে মাথানত করেননি। ভগবত গীতার উপদেশাবলি তার ভালো লাগত বলে তিনি ভক্তিসহকারে গীতা পাঠ করতেন।

প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ এবং সদ্যপ্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির ধর্মের প্রতি অনুরাগ ছিল প্রবল। রাজেন্দ্র প্রসাদ দশ বছর ভারতের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। নেহরুর সেক্রেটারি এম ও মাথাই তার বইয়ে লিখেছেন রাইসিনা হিলের ৩৬০ কক্ষবিশিষ্ট রাষ্ট্রপতি ভবনে তখন নাকি যাগযজ্ঞ লেগে থাকত। নেহরুও নাকি তাতে চরম বিরক্ত হতেন। গুজরাটের সোমনাথ মন্দির সুলতান মাহমুদ আক্রমণ করেছিলেন। তার আক্রমণে মন্দির কিছুটা বিধ্বস্ত হয়েছিল। রাজেন্দ্র প্রসাদ রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর চিনিকল মালিকদের থেকে চাঁদা সংগ্রহ করে মন্দিরের পুনঃসংস্কার মনোযোগ দিয়েছিলেন।

প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি প্রতিবছর শারদীয় দুর্গোৎসবে দিল্লি থেকে কলকাতায় আসতেন এবং নিজ বাড়িতে পূজামণ্ডপে বসে নিজে তন্ত্র-মন্ত্র জপ করে পূজার কাজ সমাধান করতেন। প্রণব মুখার্জি ছিলেন ব্রাহ্মণ। মুখার্জিরা কুলীন ব্রাহ্মণ।

গান্ধী রাজনীতিকে মিশনারি কাজ মনে করতেন, তাই তিনি আশ্রমভিত্তিক রাজনীতি করতে চেয়েছেন। তিনি গুজরাটের আহমেদাবাদ শহরের সবরমতী নদীর তীরে সবরমতী আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সবরমতী আশ্রমের ঐতিহাসিক অবদান আছে। ১৯৩০ সালের ১২ মার্চ ডান্ডি পদযাত্রা বা লবণ সত্যাগ্রহ শুরু হয়েছিল। এই সত্যাগ্রহ ছিল ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ডান্ডি অভিমুখে লবণ আন্দোলনে গান্ধীর পথযাত্রা সবরমতী আশ্রম থেকে শুরু হয়েছিল।

লবণ আন্দোলন সেই সময় ব্রিটিশের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। সবরমতী থেকে গান্ধী যখন ডান্ডি পদযাত্রা শুরু করলেন তখন ১৭ জন লোক ছিল। আর তিনি যখন ডান্ডি পৌঁছলেন তখন লোক সংখ্যা ছিল আট লক্ষ। আসলে এই উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে আন্দোলনের গণভিত্তি প্রদান করেছিলেন মহাত্মা গান্ধী। মহাত্মা গান্ধী ভারতের রাজনীতিতে যোগদানের আগে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ কারো গণভিত্তি ছিল না।

প্রণব মুখার্জি একবার কংগ্রেস থেকে বের হয়ে নতুন কংগ্রেস দল গঠন করেছিলেন। কিন্তু কিছুদিন নতুন কংগ্রেস গঠনের কাজে চেষ্টা তদবির করে অবশেষে ইন্দিরা কংগ্রেসের আবার ফিরে এসেছিলেন। সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করেছিলেন, কেন ফিরে আসলেন? তখন বলেছিলেন আমাদের মতো মানুষ ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে চাইলে কংগ্রেসে থাকা ভিন্ন অন্য কোনো উপায় নেই। প্রণব মুখার্জি সারাজীবন কংগ্রেসেই ছিলেন এবং ক্ষমতা ভোগ করেছেন। প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। এটাই তার বড় সাফল্য।

অর্থমন্ত্রী হিসেবে টি. টি. কৃষ্ণমাচারী ভারতীয় অর্থনীতির ভিত্তি তৈরি করেছিলেন। ভারতের অর্থনৈতিক উদারকরণের জন্য ড. মনমোহন সিংয়েরও প্রশংসা হয়। প্রণব মুখার্জি, মোরারজি দেশাই- ভারতীয় অর্থনীতির কোনো নতুন দিকনির্দেশনা দেননি সত্য, তবে সততার সঙ্গে প্রজাতন্ত্রের সেবা করেছেন। ভারতের মানুষ সেটা স্মরণ করবে, বন্ধু হিসেবে বাংলাদেশের মানুষও তাকে স্মরণে রাখবে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]

এইচআর/জেআইএম