স্মৃতিতে ভয়াল ২১শে আগস্ট
আমরা ’৭৫-উত্তর প্রজন্ম দেখিনি বঙ্গবন্ধুকে। আমাদের জন্মের পূর্বেই ১৫ই আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে জাতিকে করা হয়েছে পিতৃহীন। ৩রা নভেম্বর জেলখানায় মুক্তিযুদ্ধের চার সিপাহসালারকে হত্যা করে আমাদের বঞ্চিত করা হয়েছে আদর্শিক নেতৃত্ব থেকে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করার অপচেষ্টার সাক্ষী হয়েছি আমরা। আমরা বারবার শাসিত হয়েছি রাজাকারদের হাতে। আমরা হয়েছি ইতিহাস বিকৃতির সহজ শিকার। সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পের মাঝে ধুঁকে ধুঁকে বেড়ে ওঠা এক বিভ্রান্ত প্রজন্ম আমরা। আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা দেখেছি ’৭৫-এর ১৫ই আগস্টের অসম্পন্ন অধ্যায়ের শেষ মঞ্চায়ন ২১শে আগস্ট! শুধু বঙ্গবন্ধুর রক্তের শেষ উত্তরাধিকার নয়, তার আদর্শকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করতে একই স্থানে একই সাথে সকল শীর্ষ নেতাকে হত্যা করার বিএনপি-জামায়াত সরকার কর্তৃক স্বয়ং রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টা।
২০০৪ সাল, আমি নবীন আইনজীবী হিসেবে সুপ্রিম কোর্টে প্র্যাকটিস করি এবং আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। তখন আমার প্রাণপ্রিয় সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে, বিরোধী দলের ভূমিকায়। ফলে আমরা স্বাধীনতার পক্ষের প্রায় সকলেই ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে সক্রিয় ছিলাম। আমাদের নেতৃবৃন্দের রাজনৈতিক মামলার আইনি সহায়তা প্রদান ও আদালত প্রাঙ্গণে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। পাশাপাশি প্রায় সকল রাজনৈতিক আন্দোলনে রাজপথে সক্রিয় থাকাটা ছিল অতি স্বাভাবিক ঘটনা।
২১শে আগস্ট, এই দিনে পেশাগত কারণে জনসভাস্থলে পৌঁছাতে আমার কিছুটা দেরি হচ্ছিল। রওনা হয়ে সচিবালয়ের পাশের ভিড়ে পৌঁছাতেই দ্রিম দ্রিম বিকট শব্দ শুনতে পেলাম। প্রথমে কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। ওসমানী উদ্যানের দিক থেকে একজন দৌড়ে এসে বললো, ‘শেখ হাসিনা নাই আমাদের শেখ হাসিনা নাই’। শোনার সাথে সাথে আমার শরীর রক্তশূন্য হয়ে পড়ে, আমি সম্বিত হারিয়ে ফেলি।
কিছুক্ষণ পর চারদিক থেকে কান্নামিশ্রিত একটি শব্দই আসতে থাকে, ‘রক্ত শুধু রক্ত’। আমরা যাওয়ার চেষ্টা করলেও বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ থেকে মানুষের ঢল সচিবালয়ের দিকে আসতে থাকায় বারবার বাধাপ্রাপ্ত হই। জনস্রোতের সাথে কখন যে কদম ফোয়ারা হয়ে শাহবাগের কাছে চলে আসি বুঝতে পারিনি।
আমার মাথার মধ্যে শুধু একটি প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছিল, ‘নেত্রীর কী অবস্থা? জনসভার নেতৃবৃন্দ কেমন আছেন? কেমন আছেন জনসভায় উপস্থিত সাধারণ মানুষ?’ আমার মন বারংবার ১৫ই আগস্টের ভয়াবহতার শঙ্কায় অস্থির হয়ে উঠছিল। তৎক্ষণাৎ বিচলিত হয়ে আমার সবচেয়ে আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গা বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য ব্যারিস্টার তাপস ভাইকে ফোন দেই, জানতে পারলাম ইতোমধ্যে জননেত্রীকে সুধাসদনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এই খবরে আমি সম্বিত ফিরে পেলাম, মনে স্বস্তি এলো। কিন্তু তার কাছেই প্রথম জানতে পারি যে, আইভি রহমান গুরুতর আহত এবং অবস্থা আশঙ্কাজনক। আর ঝরে গেছে বেশ কিছু তাজা প্রাণ।
পরিচিত এক ব্যক্তি ফোন দিয়ে বললেন, ‘আপনার নেতা নাসিম ভাই আহত’। সঙ্গে সঙ্গে আমার রাজনৈতিক অভিভাবক মোহাম্মদ নাসিম ভাইয়ের বাসায় ফোন দিয়ে জানতে পারি তিনি গুরুতর আহত। আমার আইন পেশার সিনিয়র নুরুল ইসলাম সুজন ভাইকে ফোন দেই এবং তাকে নিয়ে নাসিম ভাইয়ের বাসায় যাই। নেতাকে আহত অবস্থায় বিছানায় কাতরাতে দেখি। তখন তার বড় ছেলে জয় সাহেব ছুটে এসে বিচলিতভাবে বললেন, ‘জনসভায় বোমা নয় গ্রেনেড ছোড়া হয়েছে, টিভিতে দেখাচ্ছে’। আমরা আঁতকে উঠি, স্তম্ভিত হয়ে পড়ি। নাসিম ভাই আমাকে বলেন, ‘মতিন খসরু আমার পাশে ছিল, খোঁজ নিয়ে দেখো তার কী অবস্থা?’ খোঁজ নিয়ে জানি যে তিনিও আহত হয়েছেন।
ইতোমধ্যে অ্যাডভোকেট সাহারা আপার আহত হওয়ার খবর আসে। আমাদের অধিকাংশ কেন্দ্রীয় নেতা শমরিতা হাসপাতালে ভর্তি আছেন শুনে আমি ও সুজন ভাই সাথে সাথেই ছুটে যাই শমরিতায়। হাসপাতালে পৌঁছে দেখি শুধু রক্ত আর রক্ত, কান্না আর আর্তনাদ। নেতৃবৃন্দকে দেখতে উপরে উঠে ভেতরে যেতে চাইলে নিরাপত্তার স্বার্থে নিষেধ করা হয় এবং সবার চিকিৎসা চলছে জানানো হয়। তবে সুজন ভাই ভেতরে যান এবং তিনি ফিরে এসে জানান, সিনিয়র নেতারা অনেকেই গুরুতর আহত ও রক্তাক্ত! তারপর আমরা যাই কমফোর্ট হাসপাতালে, সেখানে আহজারিতে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। সেন্ট্রাল হাসপাতালেরও একই অবস্থা, আহতদের আহাজারিতে চারপাশ ভারী হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে করুণ দৃশ্যের অবতারণা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, অশ্রু আর রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। এমনকি আহতদের বাঁচাতে অনেকে রক্ত দিতে চাইলেও রক্তের ব্যাগের স্বল্পতা দেখা যায়। আহতদের স্থানসংকুলান না হওয়াতে যে যেখানে পেরেছে সেখানেই শুয়ে, বসে, দাঁড়িয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করেছে। প্রচণ্ড ভিড় আর অনিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতির কারণে ভেতরে অবস্থান করা সম্ভব হয়নি। এভাবেই সারারাত হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে আহতদের রক্তে আর আর্তচিৎকারের মাঝে নিজের চোখের জলে বুক ভেসে কখন যে ভোর হয়েছে খেয়ালই করিনি।
এরই মাঝে একজন আহত নারী, যার পা থেকে কোমর পর্যন্ত ব্যান্ডেজ আর দু’পা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়ছিল, তিনি আমার সাথে থাকা নেতার হাত ধরে জিজ্ঞেস করেন, ‘ভাই নেত্রী বেঁচে আছেন তো?’ এরকম ভয়াবহ আশঙ্কাজনক অবস্থার মধ্যে নিজের কথা চিন্তা না করে নেত্রীকে নিয়ে তার দুশ্চিন্তা দেখে আমার চোখ বেয়ে ঝরঝর করে পানি পড়লো। নিজের বাঁচা-মরা নিয়ে এতটুকুও উদ্বেগ ছিল না তার। এরকম ২২টি নিবেদিত প্রাণ ঝরে গিয়েছিল সেদিন।
আমরা সবাই জানি আমাদের মমতাময়ী নেত্রী ভালোবাসেন এই দেশের প্রতিটি মানুষকে, তিনি জীবন দিতে পারেন এদেশের প্রতিটি মানুষের জন্য। কিন্তু সেদিন এটা জেনেছিলাম যে, এ দেশের মানুষ নেত্রীকে কতোটা ভালোবাসে! কতোটা ভালোবাসলে মানুষ তার জন্য এভাবে অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দিতে পারে! শেষ নিঃশ্বাসেও মানুষ কীভাবে নেত্রীকে স্মরণ করে এবং তার শুভকামনা করতে পারে, তা এই ভয়াল স্মৃতির মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে আছে।
পরদিন ২২শে আগস্ট সন্ধ্যায় আইনজীবী প্রতিনিধি দলের সাথে আমিও জননেত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য সুধাসদনে যাই। সবার চোখে মুখে কী রকম এক অজানা অস্থিরতা, উত্তেজনা ও ক্ষোভ বিরাজ করছিল। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে যখন প্রাণপ্রিয় নেত্রীর মুখখানি দেখলাম, তখন বিদ্যুৎ ঝলকানির মতো দেহে প্রাণ ফিরে পেলাম। দেখলাম নেত্রী আমাদের মাঝে আছেন, মৃত্যুভয় তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। আহত শরীরেও দৃঢ়চিত্তে কথা বলে চলেছেন, দিকনির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন! যা মুহূর্তেই সঞ্চারিত হলো আমাদের মনে ও প্রাণে। আমরা প্রতিজ্ঞা করি ঘুরে দাঁড়াবার, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই প্রতিরোধ গড়ে তুলবার।
লেখক : ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
এইচএ/এমএস