বঙ্গবন্ধু বিহীন বাংলাদেশ ও আজকের বাস্তবতা
বঙ্গবন্ধু মুজিবকে কোন কথার মালায় গাঁথা বা সঙ্গায়িত করা সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অগণিত কবিতা প্রবন্ধ ও সঙ্গীত রচিত হয়েছে, অঙ্কিত হয়েছে অসংখ্য ছবি প্রতিকৃতি তবুও অসামপ্ত রয়ে গেছে তাঁকে নিয়ে সৃজন সাধনা। বঙ্গ, বাংলা ও বাঙালি'র সমষ্টিগত রূপ বঙ্গবন্ধু। তবুও সমস্ত কিছু ছাপিয়ে, ভৌগোলিক সীমারেখা অতিক্রম করে তিনি হয়েছিলেন বিশ্বনন্দিত নেতা। তাই কিউবার সাবেক প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ত্রো বঙ্গবন্ধুকে পরিমাপের চেষ্টা করে বলেছিলেন, I haven't seen Himalayas, but I have seen Sheikh Mujib.
৭৫'এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে বোঝানোর চেষ্টা করা হয় যে, কেবল একটি মাত্র পরিবারকে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে সরানো হয়েছে। কারণ যারা হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিলেন, তারা সকলেই ছিলেন পরস্পর আত্নীয়। কিন্তু পরবর্তী প্রেক্ষাপট ও বিশেষ করে ৩ নভেম্বর জাতীয় চারনেতাকে হত্যার পর পরিষ্কার হয় যে, স্বাধীন বাংলাদেশের স্তম্ভকেই শুধু হত্যা করা হয়নি ধ্বংস করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা। স্বাধীন বাংলা পরিচালিত হতে থাকে পূর্ব পাকিস্তানের আদলে। 'জয় বাংলা'র বদলে পাকিস্তান জিন্দাবাদের আদলে শ্লোগান হয় 'বাংলাদেশ জিন্দাবাদ', 'বাংলাদেশ বেতার' এর বদলে রেডিও পাকিস্তানের আদলে 'রেডিও বাংলাদেশ', 'বলাকা'র বদলে পাকিস্তান এয়ারলাইন্সের আদলে 'বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স' করা হয়! লক্ষণীয়ভাবে এই পরিবর্তন গুলো সহজেই ইথারে ও আকাশে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার মাধ্যম। এরই ধারাবাহিকতায় ইতিহাস বিকৃতির প্রথম আঘাত বঙ্গবন্ধুর পবিত্র চরিত্রে কালিমা লেপনের অপচেষ্টা। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে ইংরেজ শাসকগণ নবাব সিরাজউদ্দৌলার চরিত্রে কলঙ্কলেপনের জন্য তৎকালীন বিশ্ববিখ্যাত সব সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিকগণদের ব্যবহার করেন কিন্তু দুইশত বছর পরে হলেও আজ আমরা সবাই জানি যে নবাব একজন খাঁটি দেশপ্রেমিকই ছিলেন। তবে বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে দুইশত বছর কেন দুই যুগও লাগেনি জাতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে প্রতিবাদ করেছে তাইতো বঙ্গবন্ধু আজও সত্য, ধ্রুব, শাশ্বত, মহিমান্বিত, উজ্জ্বল। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাষায়, 'হাত দিয়ে বলো সূর্যের আলো রুধিতে পারে কি কেউ?'
আমাদের অনেকের রাজনৈতিক মত বিরোধ থাকতে পারে, আদর্শের পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্ত স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধুর প্রতি সর্বদা সকলের শ্রদ্ধা থাকতে হবে। ভারতে মহত্না গান্ধীকে নাথুরাম গর্ডস গুলি করে হত্য্যা করে এবং তার ফাঁসি হয়। সে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (RSS) এর সদস্য ছিলেন; যারা কিনা বর্তমানে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (BJP) এর মূল মূলচালিকা শক্তি। তবুও নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম কার্যদিবসে মহাত্মা গান্ধীর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কর্ম সূচনা করেন এবং অদ্যাবধি মহাত্মা গান্ধীর প্রকাশ্য বিরুদ্ধাচারণ করেননি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিশ্চিত পরাজয় জেনে দিশেহারা হিটলার বলেছিলেন, 'Eye for an Eye' (চোখের বদলে চোখ) তৎক্ষণাৎ প্রতিউত্তরে মহাত্মা গান্ধী বলেন, Eye for an Eye, makes the whole world blind. (চোখের বদলে চোখ এই নীতি পৃথিবীকে অন্ধ করে দিবে)। ঠিক একইরূপে বঙ্গবন্ধু উদার দৃষ্টি দিয়েছিলেন এবং সদ্য স্বাধীন প্রাপ্ত সকলকে এ নিয়ে কাজ করতে চেয়েছিলেন। ঠিক যেমনটি বলেছিলেন মার্টিন লুথার কিং "Darkness cannot drive out darkness; only light can do that. Hate cannot drive out hate; only love can do that". কিন্তু বিশ্বাস ঘাতকদের কখনও কৃতজ্ঞতা থাকে না। পাকিস্তানি এবং পাকিস্তানপন্থী ব্যক্তিদের চরিত্র এক ও ভয়ংকর! বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে ঠিকই বলেছিলেন, 'You can't expect honey from the teeth of snake, you can only expect poison from it'.
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড ছিল দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের বাস্তব রূপদান। শুধু সামরিক বাহিনীর তরুণ সদস্যরাই নয় জড়িত ছিলেন ভেতর ও বাহিরের অনেক রাজনীতিবিদও। বঙ্গবন্ধুর লাশ যখন পড়ে আছে ৩২ নম্বরের সিঁড়িতে আর তাঁর মন্ত্রিসভার ২১ জন সদস্য যোগ দিয়েছিল খন্দকার খুনি মোশতাকের মন্ত্রিসভায়! ১৫ আগস্টের অভিজ্ঞতা নেলসন মেন্ডেলার এক ভাষণের কথা মনে করিয়ে দেয়, "I'm not worried about my enemies because I know who are they, but I'm really worried about my followers because I don't know how far I will get them behind me".
আমাদের মনে রাখতে হবে যে জিয়াউর রহমান ও খন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় প্রাথমিক তদন্তে আসামী হিসেবে চিহ্নিত ছিলেন। কিন্তু তারা মৃতবিধায় বঙ্গবন্ধু হত্যার আইনগত প্রক্রিয়া হতে বাদ দেয়া হয়। উল্লেখ্য যে, মরণোত্তর বিচারের দৃষ্টান্ত ইংল্যান্ডে রয়েছে! ষোড়শ শতকের গৃহযুদ্ধের সময় ওলিভার ক্রোমওয়েল অবৈধভাবে দখল করে তৎকালীন রাজা প্রথম চার্লস এর শিরোশ্ছেদ করেন। কিন্তু ক্রোমওয়েলের মৃত্যুর পর রাজ পরিবার পুনরায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। মরণোত্তর বিচারের শাস্তিস্বরূপ প্রায় একদশক পর ক্রোমওয়েলের মৃতদেহ কবর থেকে তোলা হয় এবং তার কঙ্কালের শিরশ্ছেদ করে দেহ ডাস্টবিনে ফেলা হয়।
আর বাংলাদেশে শুধু রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করা হয়নি, হত্যা করা হয়েছে বঙ্গমাতাকে, অন্তঃস্বত্বা নারী ও শিশুকে, নিরীহ নিরপরাধ মানুষদের যাদের সাথে রাজনীতির কোন যোগাযোগই ছিল না। ঘাতকরা জানতো বঙ্গবন্ধুর রক্ত কথা বলবেই, তাইতো তারা অবুঝ শিশু রাসেলকেও ছাড়ে নাই। ঠিকই আজ বঙ্গবন্ধুর রক্তই কথা বলছে! প্রতিশোধ নয়, জঘন্য হত্যাকান্ডের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করেছেন এবং ঘাতকদের ফাঁসির রায় কার্যকর করেছেন সেই রক্তের উত্তরাধিকারী বঙ্গবন্ধু তনয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা নয়, এই দেশকে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশের দৃশ্যমান উন্নয়ন ও স্থিতিশীল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে ঘাতকদের বুলেটের প্রতিউত্তর দিয়েছেন। তাই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাস্তব রূপদানে একজনের কোন বিকল্প নাই, তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
লেখক : ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ও আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট।
এইচআর/জেআইএম