বন্ধ কি চোখ কান?
মৃত্যু বড় নির্মম নিষ্ঠুর, আত্মীয়-পরিজনের মর্মবিদারী কান্না আকুতি মিনতি কিছুই তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না। এই ধরাধামে বসবাসের সময় ফুরিয়ে গেলে প্রাণবায়ু কেড়ে নিতে হাজির হয় যমদূত। তখন মনে হয়, এই জীবন ফুরালো নাকি। এই জীবন ফুরানোর খেলায় কারও নিস্তার নেই, যেতে হবে সবাইকে। তাই মনে হয় জীবন সুন্দর। এই সুন্দর জীবন আরও মাহাত্ম্যময় হয়ে ওঠে মৃত্যুর পরও মানুষের মাঝে বেঁচে থাকতে পারলে। তাই হয়তো কবি রবি ঠাকুর লিখেছেন, ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই। তোমাদেরি মাঝখানে লভি যেন ঠাঁই, তোমরা তুলিবে বলে সকাল বিকাল, নব নব সঙ্গীতের কুসুম ফুটাই’।
করোনার মতো প্রাণঘাতী ভাইরাস এই অতিমারির সময় বুঝিয়ে দিয়েছে মৃত্যু কত ঠুনকো। কতটা চোখের পলকে ঘটে। কতটা অসহায় আমরা। যার ক্ষমতায় একসময় পৃথিবী কাঁপত, তার চোখের কোণে বোবাকান্না ছাড়া আর কিছুই নেই। হাসপাতালের বিছানা ছাড়া তার সঙ্গী বলতে কেউ নেই। প্রিয়জনও কাছে ঘেঁষে না। দূর থেকে নিয়মরক্ষার বিদায় জানানো মাত্র। অথচ এদের কথা ভেবে ভেবেই দিবারাত্রি পার করেছেন মৃত্যুপথযাত্রী। আবার এদের জন্যই, এদের আগামী জীবন সুখের কলরবে বলেই না মানুষের সঙ্গে সৃষ্টি করেছেন শত্রুতা। ওই যে, বললাম রবি ঠাকুর নব সঙ্গীতের কুসুম ফোটানোর কথা বলেছেন, সেটা কি সবাই পারেন? কেউবা কুসুম ফোটাতে গিয়ে কলি হয়ে ঝরে পড়েন, কেউবা পূর্ণ ফুল হিসেবে ফুটে শেষ সময়ে ঝরে পড়ে পচে দুর্গন্ধ ছড়ায়। মানুষ সুবাসের কথা ভুলে যায়, মনে রাখে দুর্গন্ধের কথা।
এই করোনাকাল কেড়ে নিয়েছে কত শত সম্মুখযোদ্ধাকে। বাঘা বাঘা রাজনীতিবিদ হারিয়েছি, পুলিশের সাধারণ কর্মচারী থেকে শুরু করে উচ্চপর্যায়ের অনেকের মৃত্যু হয়েছে। সেনাবাহিনীর সাবেক ও বর্তমান অনেকে মারা গেছেন, চিকিৎসক, সাংবাদিকসহ অনেকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন। আবার কেউ কেউ প্রাণপণ লড়াই করে মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে এসেছেন। এমন অনেক মানুষ মারা গেছেন, যাদের দেশের মানুষ এক নামে চিনতেন, জানতেন। সমাজ ও রাষ্ট্রে তাদের অবদান অনেক। এদের মধ্যে অনেকে আবার যে করোনায় মারা গেছেন তা নয়, কেউ কেউ বার্ধক্যজনিত আবার কেউবা অন্য রোগেও মারা গিয়েছেন।
গত ১৩ জুন রাজধানীর শ্যামলীতে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। আর একইদিন রাতে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর মারা যান টেকনোক্র্যান্ট কোটায় ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মো. আবদুল্লাহ। মারা যান সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান নওগাঁ-৬ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ইসরাফিল আলম।
১৫ জুন ভোরে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা বদরউদ্দিন আহমেদ কামরান। বিএনপির কয়েকজন নেতা কুমিল্লার আব্দুল আউয়াল, সিলেটের দবির মিয়া, নরসিংদীর নুরুল ইসলামও মারা গেছেন করোনায়। মারা যান, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী কামাল লোহানী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এমাজ উদ্দিন আহমেদ।
দেশের অনেক নামকরা চিকিৎসক মারা গেছেন করোনায়। ব্যবসায়ীদের মধ্যে ট্রান্সকম গ্রুপের লতিফুর রহমান, যমুনা গ্রুপের নুরুল ইসলাম বাবুল, মোনেম গ্রুপের এম আব্দুল মোনেমসহ অনেকে। আগেই বলেছি সবাই করোনায় মারা গেছেন এমন নয়। কিন্তু এরা সবাই রাষ্ট্রের সম্পদ। ব্যক্তিজীবনে দেশের জন্য যে কিছু করেননি তেমন নয়। কিন্তু একটা বিষয় নিয়ে এই লেখাটার অবতারণা।
এই যে মানুষগুলোর মৃত্যুতে সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া। যেটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হোক বা অনলাইনে সংবাদ প্রকাশের পর মন্তব্য ঘরে হোক। যদিও কোনো মৃত্যুতে উল্লাস বা বিকৃত কিছু লেখা কাম্য নয়, কিন্তু এর মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের মনোভাব প্রকাশ পায়। কারও বা প্রশংসা কারও জন্য ঘৃণা ও ক্ষোভ। মানুষ কতটা ক্ষুব্ধ হলে এ ধরনের কথা লিখতে পারে। কতটা জ্বালা থাকলে এটা লেখা সম্ভব তা ক্ষমতাবানদের বুঝতে হবে। তাদের বুঝতে হবে ক্ষমতা কারও চিরদিন থাকে না। কিন্তু ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় সাধারণ মানুষের মঙ্গলে ভালো কিছু করে যাওয়ার মধ্যেই রয়েছে মানবজীবনের সার্থকতা।
আজও যারা নমস্য ব্যক্তি রয়েছেন তাদের অতীত পর্যালোচনা করলে জানা যায়, এরা অন্যের তরে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। আমাদের দেশে যেহেতু বাকস্বাধীনতা শুধু বইপত্রে সীমাবদ্ধ সে কারণে কে কোথায় কী লিখল, বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে কোনো মন্তব্য গেলেই তাতে হাজতে পুরার একটা প্রবণতা লক্ষ করা যায়। আর এতে প্রধান হাতিয়ার, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। যার কারণে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিমের মৃত্যু নিয়ে অবমাননাকর পোস্ট দেয়ায় গ্রেফতার হন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক সিরাজুম মনিরা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কাজী জাহিদুর রহমান।
এছাড়া প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের মন্ত্রী, এমপি বা ক্ষমতাসীন অনেকের বিরুদ্ধে লিখে পোস্ট দিয়ে কতজন যে হামলা, মামলা বা গ্রেফতারের শিকার হয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। সবচেয়ে বড় কথা ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে লিখেও অনেক সাংবাদিককে জেলে যেতে হয়েছে। লিখতে বসেই মনে পড়ল জীবনানন্দ দাশের ‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ, যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা; যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই, প্রীতি নেই, করুণার আলোড়ন নেই, পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া...’।
মানুষের এত এত ক্ষোভ তা কি মামলা, হামলা বা আইন দিয়ে থামানো যায়, সাধারণ মানুষকে কি চুপ করিয়ে রাখা যায়? তারা কোথাও না কোথাও কথা বলবেই। বরং সবচেয়ে ভালো হতো, সমালোচনাগুলোকে ভালোভাবে নিয়ে দুর্নীতি, অন্যায়ের প্রতিকার করা। কিন্তু এখন চারদিকে দেখি ক্ষমতার লড়াই। সরকার প্রধান একদিকে বলেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স, অন্যদিকে ক্ষমতাসীনদের আশ্রয় প্রশ্রয়ে বাড়ছে দুর্নীতিবাজরা। সাংবাদিকরা যে এদের বিরুদ্ধে নানা সময়ে লেখেনি তা নয়। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের চোখ বন্ধ, কানে শোনেন বলেও মনে হয় না। তারা তখনই বোঝেন যখন সাহেদ, আরিফ বা পারভীনের মতো কেউ ধরা পড়ে। তখন প্রচার করা হয়, ওরা আমাদের লোক নয়- বিএনপির লোক, অমুক ভবনের লোক। তাহলে এই ১২টি বছর এরা যে আপনাদের সঙ্গে কাটিয়েছেন, সেটাও নিশ্চয়ই দলের ভেতর থেকে ইন্ধন ছিল বলে! অথচ ক্ষমতাসীনরা ভুলতে বসেছে নিজেদের একটা চমৎকার অতীতকে।
যারা দুঃসময়ে দলকে টেনে তুলেছেন তারাই আজ অস্পৃর্শ্য। তৃণমূল থেকে শুরু করে উচ্চপর্যায়ে এমন নেতার অভাব নেই। কিন্তু ওবায়দুল কাদেরের ভাষায় এখন হাইব্রিডদের জয়জয়কার। এখন ঘাটে ঘাটে পাপিয়া, পাপুল, জি কে শামীম, মিঠু, সাহেদ, সম্রাট, আরিফ, সাবরিনা, ফরিদপুরের রুবেল-বরকতের জয় সবদিকে। কতজনকেই বা গ্রেফতার করা যায়। ঠগ বাছতে গা উজাড় হওয়ার দশা।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি নূর মোহাম্মদ তাই আক্ষেপ করে বলেন, ‘ফরিদপুরে আওয়ামী লীগ নেই। প্রকৃত আওয়ামী লীগারদের দাবড়িয়ে বের করে দেয়া হয়েছে’। এই অবস্থা এখন দেশের সবখানে। প্রকৃত আওয়ামী লীগাররা অভিমান করে বা দুই নম্বরীদের কাছে দাপটে টিকতে না পেরে বসে আছেন কোণঠাসা হয়ে।
এ প্রসঙ্গে সাংবাদিক গাজী নাসির উদ্দিনের একটা ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে উদ্বৃতি দেয়া যেতে পারে, ‘আওয়ামী লীগ টানা এক যুগ ক্ষমতায় আছে। এই বারো বছরে একজন মুক্তিযোদ্ধা স্কলার তৈরি হয়নি। একজন বঙ্গবন্ধু স্কলার তৈরি হয়নি। একজন তাজউদ্দীন স্কলার তৈরি হয়নি। একজন আওয়ামী লীগ স্কলারও তৈরি হয়নি। কিন্তু ক্ষমতার ক্রিম খেয়ে শত শত দালাল তৈরি হয়েছে।’
ক্ষমতাসীনদের বুঝতে হবে জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। এটা শুধু কেতাবি বাক্য নয়। যতই ভালো কাজ করেন, খারাপের আড়ালে চলে যাবে ভালো উদাহরণগুলো। আওয়ামী লীগের শাসনামলে দেশের যে অর্জন সব হারিয়ে যাচ্ছে দুর্নীতির কাছে। সন্ত্রাসীদের কাছে রাজনীতির চেরাগ যাওয়ার কারণে। এখনো সময় আছে চোখ কান খোলা রাখার।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লেখা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সদ্য কোভিড জয়ী মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর চিঠির কয়েকটি লাইন বলে লেখাটি শেষ করব। তিনি নিজেকে বোকা এবং প্রধানমন্ত্রীকে নিঃসঙ্গ উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘দেশের উন্নয়নের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি কঠিন পরিশ্রম করেছেন, কিন্তু লক্ষ্য থেকে ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছেন, সঙ্গে বাড়ছে আপনার একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতা। দেশের এই কঠিন সময়ে আপনার নিজ দলের পুরোনো সহকর্মী এবং অন্য সকল রাজনীতিবিদকে সঙ্গে নিয়ে আপনাকে অগ্রসর হতে হবে। সুস্থ থাকুন, গোয়েন্দাদের থেকে সাবধানে থাকুন। রাজনৈতিক কর্মীদের কাছে টেনে নিন ।’
আমার মনে হয় অল্পকথায় ক্ষমতাসীনদের জন্য এর চেয়ে ভালো পরামর্শ আর হতে পারে না।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।
এইচআর/জেআইএম