ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

করোনা থেকে মুক্তি মিলবে কবে?

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার | প্রকাশিত: ০৯:১৩ এএম, ১৩ জুলাই ২০২০

অবশেষে মুক্তি মিলেছে রেড জোনের একুশ দিনের লগডাউন থেকে। করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকার পরীক্ষামূলকভাবে ঢাকার রাজাবাজারকে লগডাউন করে গতমাসে। স্থানীয় প্রশাসনের তরফ থেকে লগডাউনের সময় সব দোকানপাট ও মসজিদ বন্ধ করা হয়েছিল। সরকারি-বেসরকারি সব অফিস ছুটি ঘোষণা করা হয়। বাসিন্দাদের ঘর থেকে বের না হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। যদি কোনো কিছু দরকার হয় তা প্রশাসনের স্বেচ্ছাসেবকরা ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন। প্রথম দিকে জনসাধারণ ঘর থেকে বের না হতে পারার কারণে মন খারাপ করলেও ধীরে ধীরে তারা অভ্যস্থ হয়ে যায়। করোনা নিয়ন্ত্রণে লগডাউনের বিকল্প নেই তা বুঝতে পেরেই প্রশাসনের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করে। এমন সহযোগিতার ফলও মিলেছে। একুশ দিন লগডাউনে থাকার পর রাজাবাজারের করোনার প্রকোপ কমে এসেছে। রেড জোন থেকে গ্রিন জোনের তালিকায় আসায় সরকার লগডাউন তুলে নিয়েছে।

রাজাবাজারের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ঢাকার অন্য এলাকা ওয়ারীতে লগডাউন চলছে। সরকারের পরিকল্পনা এভাবে করোনা প্রকোপ প্রতিটি এলাকা লগডাউন বাস্তবায়ণ করা যাতে সহজে করোনা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ঢাকার বাইরেও প্রতিটি জেলায় এমনকি গ্রামেও করোনা ছড়িয়ে পড়েছে। ঢাকার বাইরেও অধিক করোনা প্রকোপ বিভিন্ন এলাকাকে রেডজোন ঘোষণা করে লগডাউন করা হচ্ছে। ঢাকার মতোই লগডাউনভুক্ত এলাকায় সরকারের পক্ষ থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। এর ফলও ফলছে। করোনার প্রকোপ দিন দিন কমছে।

করোনার কারণে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ। দিন আনে দিন খেয়ে অভ্যস্থ এই সব মানুষদের সঞ্চয় বলতে কিছু নেই। প্রতিদিনের আয়ের উপরও এদের রুটি রুজি নির্ভর করত। কিন্তু করোনার কারণে প্রায় সব আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। যদিও সরকারের তরফ থেকে নিম্ন আয়ের মানুষদের মাসিক তিন হাজার টাকা হারে সাহায্য প্রদান করা হচ্ছে। কিন্তু ওই সাহায্য যে তাদের জীবনধারণের জন্য যথেষ্ট নয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশেষ করে যারা ঢাকার মতো শহরে বসবাস করেন। তবে আশার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশে করোনা আক্রান্তদের যে পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে তা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার হার খুবই কম। করোনার শুরুতে ঢাকার বস্তিবাসীদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে গণমাধ্যম বেশ সোচ্চার হলেও এখন দেখা যাচ্ছে শহুরে অভিজাত শ্রেণীরা করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেও বস্তিবাসীরা করোনায় আক্রান্ত হয়েছে, মৃত্যুবরণ করেছে এমন ঘটেনি।

শ্রমিক শ্রেণীর মানুষরা আশংকা প্রকাশ করছেন যে, করোনার প্রকোপ প্রলম্বিত হলে তারা করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা না গেলেও না খেয়ে মারা যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যদিও সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, একজন ব্যক্তিও না খেয়ে থাকবে না সেই প্রস্তুতি সরকারের রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি গতি বিগত বছর গুলোয় বেশ ফুরফুরে থাকায় সরকারের এই আশ্বাসে আস্থা রাখা যায়। যদি দুর্নীতি আর সিস্টেম লসের কারণে সাধারণ মানুষের ত্রাণ সাধারণ মানুষের নিকট না পৌঁছায় তখন পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারে। তাছাড়া বাংলাদেশে করোনার কারণে দুর্ভিক্ষ হওয়া কোনো আশঙ্কা নেই।

সরকার উন্নয়ণ প্রকল্পের বরাদ্দ কাটছাঁট করে করোনা মোকবেলায় ব্যয় করছে। মানুষের জীবন রক্ষাই সরকারের নীতিতে সবচেয়ে অগ্রাধিকার পাচ্ছে। এই বছরের কৃষি উৎপাদনও সন্তোষজনক। ফলে দেশে খাদ্য ঘাটতি হওয়ার আশঙ্কা নেই।

সরকার নিম্নবৃত্তদের ত্রাণ সাহায্য নিশ্চিত করলেও বিপাকে পড়েছে মধ্যবৃত্ত। তারা না পারছে কইতে, না পারছে সইতে। যদিও সরকারের তরফ থেকে গোপনে হলেও মধ্যবৃত্তদের ত্রাণ পৌঁছে দেয়ার নিশ্চয়তা প্রদান করা হচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘদিনের সংকোচ ভেঙ্গে মধ্যবৃত্ত সম্প্রদায় সেই সুবিধা কতটুকু গ্রহণ করতে চাইছে তা বলা মুশকিল। প্রতিদিন ঢাকা শহর ছাড়ছে মানুষ। যাদের অধিকাংশ ওই মধ্যবৃত্ত সম্প্রদায়। এ থেকে অনুমান করা যায়, করোনায় শহুরে মধ্যবৃত্ত সম্প্রদায়ের অথনৈতিক অবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। তাই বাধ্য হয়ে তারা ঢাকা ছাড়ছেন। বাইরে ফিটফাট ভিতরে সদরঘাট শহুরে মধ্যবৃত্তের এই শহর ছেড়ে গ্রামে পাড়ি দেয়ায় ঢাকার স্থানীয় অধিবাসীদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙ্গে পড়বে। কারণ ঢাকার স্থানীয় অধিবাসীদের অধিকাংশই বাড়ি ভাড়ার উপর নির্ভরশীল। ঢাকা শহরের অধিকাংশ ভাড়াটিয়াই মধ্যবৃত্ত সম্প্রদায়ভুক্ত। তাই তাদের ঢাকা ছেড়ে চলে যায় গত কয়েক মাস ধরে ঢাকার অলিতে গলিতে টু লেট ঝুলছে। লাটসাহেব খ্যাত বাড়িওয়ালারা ভাড়াটিয়ার অভাবে চোখে সর্ষে ফুল দেখছে।

শহুরে মধ্যবৃত্তের মতো বাংলাদেশের স্থাস্থ্যখাতও যে মাকাল ফল তা করোনা এসে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। স্থাস্থ্যখাতের নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা এখন টক অব দা কান্ট্রি। জাতীয় সংসদ থেকে চায়ের দোকানদার, সবার এক কথা সাস্থ্যখাতের মেরামত দরকার। স্থাস্থ্যের পাশাপাশি শিক্ষাখাতও মেরামত করতে হবে। গত কয়েক বছর গণ্ডায় গণ্ডায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও পরিকল্পিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব প্রকট। বাংলাদেশের স্মার্ট শিক্ষামন্ত্রী দীপুমনির প্রচেষ্টায় বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে পারলেও প্রায় অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই তা করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। অবশ্যই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বেশ কিছু পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছে। সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় শিক্ষাঙ্গন সেজনজট মুক্ত হয়েছে বেশ কয়েক বছর। করোনাকালে সেই সাফল্য ভেস্তে যেতে বসেছে। অনলাইনে শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে আশা করা যায় সেই ক্ষতি অনেকটা পুসিয়ে নেয়া যাবে।

এখন সবার মনে এক প্রশ্ন করোনা থেকে মুক্তি মিলবে কবে? তবে টিকা আবিষ্কারের যে ধীর গতি তাতে করোনার মহামারি কতদিন স্থায়ী হবে তা এখনই বলা মুশকিল। টিকা আবিষ্কার না হওয়ায় পর্যন্ত লগডাউন ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাই একমাত্র প্রতিষেধক। তবে অর্থনীকে সচল করতে, মানুষের জীবিকা বাঁচাতে ধীরে ধীরে সরকারকে হয়ত সব কিছু খুলে দিতে হবে। জীবন না জীবিকা সেই প্রশ্ন অমীমাংসিত বির্তকও একদিন থেমে যাবে। জীবিকা রক্ষার বাস্তব প্রয়োজনে জীবনকে উপেক্ষা করে মানুষ স্বাভাবিক কর্মে ফিরে যেতে বাধ্য হবে। করোনাকে সাথে নিয়ে বাঁচতে শিখে যাবে। তবে করোনা বাংলাদেশের মানুষকে যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার শিক্ষা দিয়েছে তা বেঁচে থাকবে অন্তত কাল। আর সেই সহযোগিতা ও সহমর্মিতার উপর ভর করে করোনাকালের ক্ষতি পুষিয়ে নিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়াবে এমনটি আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: সামরিক ইতিহাস গবেষক ও সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় [email protected]

এইচআর/জেআইএম