ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

রায়হান আসামি নয়, তার পাশে দাঁড়ান

সম্পাদকীয় ডেস্ক | প্রকাশিত: ০১:৪৫ পিএম, ০৯ জুলাই ২০২০

মাজেদুল নয়ন

রায়হান কবির ২৫ বছর বয়সী একজন বাংলাদেশি তরুণ। মালয়েশিয়ায় লুকিয়ে বেড়াচ্ছেন। তার অপরাধ তিনি কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল জাজিরায় মালয়েশিয়ায় অবস্থিত অভিবাসীদের সমস্যাগুলো স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন।

গত ৩ জুলাই আল জাজিরার ইউটিউব চ্যানেলে ১ও১ ইস্ট ডকুমেন্টারি প্রোগ্রামে প্রকাশিত হয়, ‘লকড আপ ইন মালয়েশিয়াস লকডাউন’ শীর্ষক অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদনটি। ড্রিয়ো এমব্রোস এবং জেনি হ্যান্ডারসনের ওই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, লকডাউনের সময় স্বাস্থ্যসেবা এবং সাহায্যের আড়ালে কীভাবে অবৈধ অভিবাসীদের আটক করা হচ্ছে, হয়রানি করা হচ্ছে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে।

২৫ মিনিট ৫০ সেকেন্ডের ডকুমেন্টারিটি প্রচার হওয়ার পর মালয়েশিয়ায় সরকার এবং জনগণের একটি অংশ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তাদের অভিযোগ সংবাদে ভুল তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে এবং মালয়েশিয়ার সম্মানহানি করা হয়েছে। একই সঙ্গে ওই প্রতিবেদনে মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশি তরুণ রায়হান সাক্ষাৎকার দেয়ায় তাকে খুঁজে বের করার ঘোষণা দেয় দেশটির পুলিশ বিভাগ, বুকিত আমান।

৫ জুলাই সকাল থেকেই মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত কয়েকজন বাংলাদেশি ফোন এবং মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করছিলেন। তাদের পাঠানো লিংকেই দেখতে পাই আল জাজিরার প্রতিবেদনটি। সেখানে যে অভিবাসী শ্রমিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে, সেগুলো সত্যিই মর্মান্তিক।

সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতায় দীর্ঘদিন মালয়েশিয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করেছি। সেখানে বাংলাদেশের মানুষদের নির্মম কষ্ট নিজ চোখে দেখেছি। রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের আত্মসম্মানের স্থান দুর্বল হওয়ায় বিদেশের মাটিতে যে বাংলাদেশিদের সঠিক মর্যাদা নেই সেটি অবহেলা করার খুব বেশি সুযোগ নেই। তবে মালয়েশিয়ার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশি দালালদের সঙ্গে মালয়েশিয়ার পুলিশ-প্রশাসনেরও একটি গভীর সম্পর্ক সবসময়ই দেখা গেছে।

কুয়ালালামপুরের প্রাণকেন্দ্র বুকিত বিনতাংয়ে একদিন চা খেতে খেতে এক বাংলাদেশি শ্রমিকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি অনিবন্ধিত হওয়ায় চার মাস জেল খাটতে হয়েছিল। নিয়মানুযায়ী তাকে দেশে ফেরত পাঠানোর কথা থাকলেও, পুলিশকে ঘুষ দিয়ে বের হয়ে আসেন তিনি এবং আবারও পালিয়ে বেড়াবার জীবন বেছে নেন। কারণ দেশে জমি বিক্রি করে এবং আত্মীয়-স্বজন থেকে টাকা ধার করে মালয়েশিয়ায় এসেছিলেন তিনি। যদিও তার এই খরচের প্রায় পুরো টাকাটাই যায় দালালের পকেটে। তবে অবৈধ শ্রমিক কি চাইলেই থাকতে পারেন? না। বরং সেক্ষেত্রে স্থানীয় পুলিশকে যেমন ঘুষ দিতে হয়, তেমনি একশ্রেণির মালিকরাও কম বেতনে অবৈধ শ্রমিক রাখতে পছন্দ করেন।

২০১০ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় ব্যাঙের ছাতার মতো কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল। যাদের মূল কাজ ছিল আফ্রিকা বা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে যাওয়া অভিবাসীদের সঙ্গে ভিসার ব্যবসা করা। মালয়েশিয়ায় পুলিশ ১০ রিঙ্গিত (বর্তমান মূল্যে ২২০ টাকা প্রায়) পর্যন্ত ঘুষ নেয়ার কথা শুনেছি এবং অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাকিতে ঘুষ খাওয়ার কথাও প্রচলিত রয়েছে। এছাড়াও আটককৃতদের যে ডিটেনশন সেন্টারে রাখা হতো সেটির অনেক অমানবিক অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছিলেন প্রবাসীরা। ডিটেনশন সেন্টারের নামে সেখানে চলে নির্যাতন এবং প্রয়োজনীয় একটি ফোন কলের জন্য নেয়া হয় সর্বনিম্ন একশত রিঙ্গিত বা দুই হাজার ২০০ টাকা প্রায়। এই টাকা দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যক্তির কাছে বন্দীরা কথা বলতে পারেন মাত্র এক মিনিট।

এইসব নির্যাতন সয়ে আসছেন মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত বিভিন্ন দেশের প্রবাসীরা। তবে অবস্থানরত বাংলাদেশি অভিবাসীরা বরাবরই অভিযোগ করে আসছেন, ইন্দোনেশিয়া বা ফিলিপাইনের অভিবাসীদের তুলনায় তাদের হয়রানি এবং নির্যাতন করা হয় বেশি। আল জাজিরার ওই প্রতিবেদনে রায়হান চলে আসা এই নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেছে। তিনি বারবার চেষ্টা করেও গ্রেফতার হওয়া বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে পারেননি, সেটি বলেছেন। এছাড়াও একজন পাকিস্তানি এবং একজন ইন্দোনেশিয়ান অভিবাসীর সাক্ষাৎকার ছিল প্রতিবেদনে। যেখানে তারা বলেছেন, দেশটিতে অভিবাসী শ্রমিকদের কুকুরের মতোই মনে করা হয়!

প্রতিবেদনটি প্রকাশ হওয়ার পরই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে মালয়েশিয়া সরকার এবং দেশটির পুলিশ বিভাগ। পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল তানশ্রী আব্দুল হামিদ বদর বলেছেন, প্রকাশিত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহসহ অনেকগুলো অভিযোগ পাওয়া গেছে। রাষ্ট্রদোহ আইন এবং পেনাল কোডের আওতায় খুব শিগগিরই ওই প্রতিবেদককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হবে। এবং বাংলাদেশি তরুণকে খোঁজ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে আল জাজিরার সম্পাদক, রিপোর্টার, ক্যামেরাম্যান এবং প্রযোজককে নোটিশ দিয়েছে সে দেশের পুলিশ। এছাড়া বাংলাদেশি রায়হান কবিরকে খুঁজতে দেশটির ইমিগ্রেশন বিভাগ তাদের ফেসবুকে যেমন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে, তেমনি গণমাধ্যমগুলোতেও সংবাদ প্রকাশ করেছে। বিভিন্ন নম্বর প্রদান করা হচ্ছে রায়হানের খোঁজ পেলে জানানোর জন্য।

রায়হান কোনো দাগী আসামি নয়, কোনো গ্যাংস্টার প্রধানও নয়। বরং তিনি সত্য প্রকাশ করেছেন। রিপোর্ট নিয়ে কোনো অভিযোগ থাকলে মালয়েশিয়া সরকার এবং পুলিশের কাজ হবে আল জাজিরার কাছে কারণ জানতে চাওয়া এবং প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া। রিপোর্টে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারদাতাকে দাগী আসামির মতো খোঁজ করে বিজ্ঞপ্তি দেয়া নয়।

মালয়েশিয়ান জনগণের একটি অংশ এই বিষয়ে ইউটিউব এবং ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্মে রায়হানকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং ঘৃণা ছড়িয়ে বিভিন্ন কনটেন্ট প্রকাশ করছেন। দেশটির সরকার এবং পুলিশের পাশাপাশি মানুষের এই ধরনের প্রতিক্রিয়ায় রায়হান নিজের জীবন নিয়ে শঙ্কিত। এই অবস্থায় বাংলাদেশের মানুষ এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের প্রতি অনুরোধ থাকবে রায়হানের পাশে দাঁড়ানোর, সহযোগিতা প্রদানের।

এইচআর/বিএ/পিআর