ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

চীন-ভারত যুদ্ধে জড়াবে না, তর্জন-গর্জনই সার

আনিস আলমগীর | প্রকাশিত: ০৯:০৩ এএম, ০৯ জুলাই ২০২০

২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে ১৮ বার মিলিত হয়েছেন, চীন সফর করেছেন পাঁচবার। এত দেখা সাক্ষাৎ আর দোলনায় চড়া ছাড়া সব ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মিলিয়েও হয়নি। তারপরও তার সঙ্গে চীনের সম্পর্ক উন্নত হলো না। শুধু তাই নয়, ভারতের চারপাশে যত প্রতিবেশী কারও সঙ্গে উন্নত সম্পর্ক করতে ব্যর্থ ভারত। লাদাখের ঘটনায় কেউ তার পাশে দাঁড়ায়নি এমনকি রাশিয়ার মধ্যস্থতার আশা করা গেলেও রাশিয়াও কোনো গরজ দেখায়নি।

৩ জুলাই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি লাদাখ সফরে গিয়েছিলেন। সঙ্গে তার কয়েকজন জেনারেলও ছিলেন। নরেন্দ্র মোদির তৎপরতা দেখে লেলিনের বিখ্যাত স্লোগানটির কথা মনে পড়ে গেল- ‘সমস্ত কিছু রণাঙ্গনের জন্য, সমস্ত কিছু বিজয়ের জন্য।’ যুদ্ধাংদেহী মোদি পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের ভান করে গত সাধারণ নির্বাচনেও সহজ বিজয় অর্জন করেছেন। চীনের সঙ্গেও যুদ্ধের ভান করছেন মোদি।

নরেন্দ্র মোদি কিশোর বয়স থেকে কট্টর হিন্দু মৌলবাদী গোষ্ঠী আরএসএসের ক্যাডার। বিজেপির প্রথম প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীও নাগপুরের লোক ছিলেন কিন্তু তার মুখ এবং মুখোশ নির্ণয় করা কঠিন ছিল। নরেন্দ্র মোদির কোনো ভান-ভনিতা নেই। তিনি কট্টর হিন্দুত্ববাদী লোক। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় দাঙ্গা লাগিয়ে দুই হাজার মুসলমানকে নির্বিচারে হত্যা করে তিনি তার প্রমাণ রেখেছেন। কাশ্মিরের মুসলমানদের মানবাধিকার বঞ্চিত করেছেন। নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের মাধ্যমে এখন সারাদেশের মুসলমানদের হুমকির মধ্যে ফেলে রেখেছেন।

এখন চীন-ভারত সীমান্ত বিরোধে যুদ্ধের ভান ধরে হলেও নরেন্দ্র মোদি বিজয়প্রত্যাশী এবং দৃঢ় অবস্থানে থেকে চীনকে মোকাবিলা করতে কোনো শিথিলতা দেখাবেন না। গত বছর ভুটান-চীনের বিরোধপূর্ণ দোকলাম সীমান্ত তিনি চীনের মুখোমুখি হয়ে এক ইঞ্চি পিছু হটতে রাজি ছিলেন না। দোকলামে কেউ পিছু হটার ঘটনা ঘটেনি, সামনেও অগ্রসর হয়নি। উভয়পক্ষ এমনিতেই নীরব হয়ে গিয়েছিল।

লাদাখের অবস্থা কিন্তু দোকলামের মতো নয়। উভয়পক্ষ পরিপূর্ণ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। চীন নাকি ২০ হাজার সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়েছে তার সীমান্তে। ভারত দুই ডিভিশন সৈন্য নিয়েছে যার মধ্যে মাউন্টেন ডিভিশনও নাকি রয়েছে। আর আকাশযুদ্ধের পরিপূর্ণ প্রস্তুতিও রয়েছে উভয়পক্ষের। ৩ জুলাই নরেন্দ্র মোদির লাদাখ সফর চীনকে যুদ্ধের প্রতি মনোযোগী করে তুলেছে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, নরেন্দ্র মোদির লাদাখ সফর যুদ্ধের উস্কানি।

ভারত ৩৬টি রাফায়েল যুদ্ধবিমান কিনেছে ফ্রান্স থেকে। তার একটা অংশ সরবরাহের জন্য ফ্রান্সকে অনুরোধ করেছে। ফ্রান্স আশ্বস্ত করেছে জুলাই মাসের শেষের দিকে ছয়টি বিমান সরবরাহ করবে। ভারতের বিমান বাহিনীতে আধুনিক বিমানের অভাব বলে ফ্রান্স থেকে রাফাল বিমান কিনেছিল।

চীন আর ভারত আয়তন ও লোকসংখ্যা প্রায় সমান। ১৯৫৫ সালে ইন্দোনেশিয়ার বান্দুং সম্মেলনে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই স্বীকার করেছিলেন ভারত শিল্প-বাণিজ্যে চীনের চেয়ে অগ্রগামী কিন্তু সেই অগ্রগতি ভারত রক্ষা করতে পারেনি। মাও সে তুং এর পর দেং জিয়াওপিং যখন চীনের ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করেন তখন তিনি চীনকে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। ১৯৮০ সাল থেকে চীনে আমেরিকা, জাপান এমনকি তাইওয়ান পর্যন্ত এসে শিল্প স্থাপন করে। সেই ধারা অব্যাহত রেখে চীন এখন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় শিল্প উন্নত দেশ।

এমনকি সমরাস্ত্র উৎপাদনেও তারা বিশেষ স্থানের অধিকারী। সমরাস্ত্র বিক্রিতেও তারা শীর্ষ স্থান অধিকার করে আছে। বাংলাদেশ তাদের সমরাস্ত্রের অন্যতম ক্রেতা। ভারত তাদের প্রয়োজনে এখনো বাইর থেকে সমরাস্ত্র কিনে থাকে।

আমেরিকার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি চীন। দেশটির গুপ্তচরবৃত্তি ও চৌর্যবৃত্তি নিকট ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য দীর্ঘমেয়াদে বড় হুমকি হয়ে উঠবে- এমনটাই মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার (এফবিআই) পরিচালক ক্রিস্টোফার রে। গত মঙ্গলবার ৭ জুলাই ওয়াশিংটনে এক অনুষ্ঠানে দেয়া ভাষণে এমন মন্তব্য করেন তিনি।

চীনের অর্থনীতি এখন বিশ্বের মজবুত অর্থনীতি। আমেরিকার সমপর্যায়ে তাদের অর্থনীতি এসে উপস্থিত। আমেরিকার প্রতিরোধের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য বিশ্বব্যাংকের বিকল্প ব্রিকস ব্যাংক স্থাপন করেছে। এছাড়াও এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি) প্রতিষ্ঠা করেছে, যেখানে বাংলাদেশসহ ৫৭ দেশ বিশ্বব্যাংকের বিকল্প হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এই ব্যাংকের সদস্য। এখন চীনারা তাদের কারেন্সি দিয়ে বিশ্ববাজারে লেনদেন করে থাকে। অবশ্য পাশাপাশি ডলারও রয়েছে। চীনের কাছ থেকেও আমেরিকা দুই ট্রিলিয়ন ঋণ নিয়েছে।

যাহোক ভারত-চীন ৬ জুলাইয়ের বৈঠকে লাদাখ থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগেও এমন সিদ্ধান্ত জেনারেল পর্যায়ের বৈঠকে গৃহীত হয়েছিল কিন্তু উভয়পক্ষ সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করেনি। দেখা যাক ৬ জুলাই এর সিদ্ধান্ত কার্যকর হয় কিনা।

এখন আমেরিকা প্রশান্ত মহাসাগরে নৌমহড়ার আয়োজন করেছে। ৬ জুলাই টেলিভিশনে দেখলাম খুব জোরদার নৌ-মহড়া হচ্ছে। সম্ভবত ভারত সীমান্তে চীনের যুদ্ধ তৎপরতা এবং চীন সাগরের দখল নিয়ে চীনের দাবির বিপরীতে আমেরিকা তার অবস্থান জানানোর জন্যই এই মহড়ার আয়োজন করেছে। চীন সাগরের ওপর চীনের অধিকার ভিয়েতনাম, কোরিয়া, তাইওয়ান, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও মালয়েশিয়া মানে না। আর এই দেশগুলো আমেরিকান ব্লকের দেশ। ওবামা যখন প্রেসিডেন্ট তখনই আমেরিকা তার ৬০ শতাংশ নৌশক্তি আটলান্টিক থেকে প্রশান্ত মহাসাগরে নিয়ে এসেছে। নিয়ে আসার সময় আমেরিকা বলেছিল, তারা তাদের মিত্রদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

চীন আর ভারত যুদ্ধ প্রস্তুতিতে নিজেদের যতই ব্যস্ত রাখুক না কেন কোনোভাবেই বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি যুদ্ধের অনুকূলে না। করোনার দ্বিতীয় ওয়েভ নিয়ে বৈজ্ঞানিকরা চিন্তিত এবং তারা অনুমান করছেন দ্বিতীয় পর্যায়ে করোনা আরও ভয়াবহ রূপ নেবে। ভারত সংক্রমণে এখন তৃতীয় স্থানে রয়েছে। আবার তা দ্রুত ছড়াচ্ছে। অনেকে বলছে ভারতের অবস্থা স্পেন, ইতালির মতো হতে পারে। যদি তাই হয় তবে ভারত করোনা সামাল দিতেই ফতুর হয়ে যাবে। চীনেও পুনরায় সংক্রমণ শুরু হয়েছে, আবার প্লেগ রোগও দেখা দিয়েছে। প্লেগ ভয়াবহ রোগ।

সুতরাং প্রকৃতির সতর্কবাণী উপেক্ষা করে এখন কোনো রাষ্ট্র যুদ্ধে জড়িত হবে না। আর আগামী ৩ নভেম্বর ২০২০ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। আমেরিকা চাইবে না তাদের নির্বাচনের আগে চীন-ভারত যুদ্ধ হোক। আর করোনার কারণে সারাবিশ্ব ভয়াবহ মন্দার সম্মুখীন হচ্ছে। মন্দাকবলিত বিশ্বের অবস্থা সামাল দিতে গোটা বিশ্বের যান ওষ্ঠাগত হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।

[email protected]

এইচআর/বিএ/পিআর