কোথায় যাচ্ছি, গন্তব্যই বা কোথায়?
কোথায় যাবো আমরা? যাওয়ার আদৌ কোনো নিরাপদ জায়গা আছে কি এই সংসারে, তাবৎ বিশ্ব সংসারে? বিশ্বের দুই শতাধিক রাষ্ট্র ও অঞ্চল আজ কোভিড-১৯ আতঙ্কে দিশেহারা! স্বাচ্ছন্দ্যে যাওয়ার জায়গা আসলে কোথাও নেই। তাই এ লেখার শিরোনাম নিয়ে একটা অন্তর্গত খটকা লেগেই আছে। বিশেষত ‘যাচ্ছি’ আর ‘গন্তব্য’ শব্দ দুটির জন্য একটা দ্বন্দ্ব মনের মধ্যে কেমন আকুলি-বিকুলি করেই যাচ্ছে। বলা ভালো ‘শিরোনামটি’ যথাযথ হয়নি। তবু এই শিরোনামের ধ্বজা উড়িয়েই লিখতে মন চাইছে- এর বাইরে যেতে মন সরছে না!
শিরোনামটির অন্তর্গত ভাবনায় যাত্রা বা কোথাও যাওয়ার ইঙ্গিত আছে। বর্ণিত ‘যাচ্ছি’ তথা যাত্রার অর্থ করা যায় ভ্রমণ হিসেবে এবং এটি ইংরেজি ‘জার্নি’র প্রতিশব্দরূপে প্রযুক্ত। তাই শিরোনামের যাথার্থ্য নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারণ এই করোনাকালেও আমাদের মধ্যে এক ধরনের যাত্রা আছে বটে তবে তা একান্তই অন্তর্গত যাত্রা- এই যাত্রায় শারীরিক অবস্থানের স্থানান্তর নেই মোটেই। ঘরের মধ্যে বসে বসে মনে মনে হয়তো বা কোথাও না কোথাও যাচ্ছি। যাচ্ছি, তবে সেই যাওয়ায় শারীরিক কোনো ভ্রমণ নেই- জার্নি নেই। আছে কেবল মানসিকভাবে ভাবনার পর ভাবনা- হয়তো বা তা কেবলই পরিকল্পনা মাত্র।
এই ভাবনায় ঘুরেফিরে একই চিন্তা ‘মাথা খুঁড়ে খায়’ চলমান বন্দি-জীবনের অবসান হোক; মনে মনে চলে যাই সেইসব স্বাভাবিক দিনগুলোর মধ্যে। মনে মনে হেঁটে হেঁটে সেই পথেই যেন চলি নিরন্তর। আবার কখনো কখনো ভাবনায় সেই কাঙ্ক্ষিত দিনটির দিকেই ফিরে ফিরে যাই যাচ্ছি। মনে মনেই বর্তমানের দুঃসময় এড়িয়ে ভবিষ্যতের সুসময়ের ভাবনায় নিজেদের পূর্ণ করি। তাই এও আবার মনে হয় এটিই আসলে এক ধরনের যাওয়া, যাত্রা, ভ্রমণ জার্নি ইত্যাদি ইত্যাদি। আর এ কথা মনে হলে শিরোনাম নিয়ে খটকার অনেকটাই মীমাংসা হয়ে যায়। ‘বাহির বিশ্বে’ কিছু হোক না হোক আমরা কিন্তু ঠাঁয় বসে আছি, অপেক্ষায় আছি। এই অসীম অপেক্ষার মধ্যেও আমরা একটি স্বাভাবিক ও সুদিনের স্বপ্ন বুকে নিয়ে মনের ভেতর নিরন্তর এক দীর্ঘ পথও অতিক্রম করে চলেছি, ভ্রমণ করে চলেছি স্বাভাবিক দিনের প্রত্যাশিত আলোক-ইঙ্গিতে।
এক মনে শুভ এক ভবিতব্যের পানে আমাদের মানসিক ভ্রমণ চলছে, শিরোনামে তাই গন্তব্য কথাটির অবতারণা। আবার এই ভয়ংকর মহামারির মধ্যে একশ্রেণির মানুষের মানসিক অবনতির দিকে তাকিয়েও গন্তব্য শব্দটির অবতারণা। মহামারিকে সামনে রেখে মানবিক হওয়ার পরিবর্তে একশ্রেণির মানুষ অমানবিক পন্থায় ‘আয়-রোজগারে’ যেন মেতে উঠেছেন, অনৈতিক পন্থায় পথ হাঁটছেন। সাধারণ মানুষের বিপদগ্রস্ত ও বিপন্ন অবস্থাকে পুঁজি করে তারা নানাভাবে এই আয় রোজগারের পথকে সুগম (!) করে তুলছেন।
এর মধ্যে চিকিৎসাসেবা এবং চিকিৎসাসামগ্রী কেন্দ্রিক অমানবিকতা বৈশ্বিক মহামারির এই ক্রান্তিকালে মানুষ হিসেবে আমাদের প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়, নীতিনৈতিকতা বোধেরও মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আমরা আসলে কোন দিকে যাচ্ছি? কোথায় যাচ্ছি আমরা? আদৌ কি আমরা কোথাও যাচ্ছি? এই পথ ধরেই কি আমাদের উন্নতি তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছুবে? জানি না কে এ রূপ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন। এ প্রশ্রে উত্তর আমাদের অজানা। তাই আফসোস আর আক্ষেপের সঙ্গে এমন শিরোনামের আড়ালে এখানে কিছু বিক্ষিপ্ত ভাবনার বিস্তার ঘটানোর প্রয়াস মাত্র।
কিন্তু মনের বাইরে, মন থেকে বের হয়ে এই দৈহিক শরীরের একটা ভ্রমণ চাই। কিন্তু বর্তমানের ‘অস্বাভাবিক’ এই জীবনধারণটাই এখন ‘স্বাভাবিক’ বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। অতি জরুরি প্রয়োজনে মাসাধিককাল গৃহবাসী থাকার পর একদিন বাসার বাইরে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে একজন ফেসবুক বন্ধুকে জানানোর পর তিনি নিরুৎসাহের সঙ্গে জানালেন ‘এই দুঃসময়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করাই উত্তম’। তিনি বুঝাতে চেয়েছেন আসলে বর্তমানের স্বাভাবিকতাকেই। মনে পড়ে বিদ্রোহী কবির সেই কবিতার চরণ ‘থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে...’। আহা, কতই না অসহায় আর্তনাদের মতো শোনায়! সেই আর্তনাদকে সঙ্গী করেই আছি বদ্ধ ঘরের ভেতর, মনের বিরুদ্ধে মন!
করোনার তাণ্ডবে আমরা গৃহবন্দি। সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যে ঘরের বাইরে যেতে পারি না। কিন্তু বাইরেও আমাদের অঢেল কাজ। বাইরেও আমাদের দায়িত্বের শেষ নেই। দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে চলছে বন্যার দুর্যোগ। সেখানকার বিপদগ্রস্ত ও বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানো প্রয়োজন। আমাদের সেখানে যাওয়া প্রয়োজন। যাদের বাড়িঘর বন্যার পানিতে কয়েক সপ্তাহ ধরে ডুবে গেছে তাদের জন্য মানবিক সহযোগিতার হাত বাড়ানো প্রয়োজন। কিন্তু আমরা যেতে পারছি না বন্যাদুর্গত অঞ্চলে। তাই দুর্গত মানুষদের জন্যও এক অজানা ভয় কাজ করছে মনের ভেতরে ভেতরে।
স্বাভাবিক অবস্থায়ই আমরা পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী নিয়ে ইতঃপূর্বে বিপন্ন মানুরে পাশে দাঁড়াতে পারিনি, এখন করোনা-আক্রান্তের এই অস্বাভাবিককালে সেইসব বিপন্ন মানুষদের পাশে কতটা সহায়রূপে দাঁড়াতে পারবো তাও এক বিরাট প্রশ্ন! কিন্তু বন্যাকবলিত দুর্গত মানুষের জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণ পাঠানো এবং তার সুসম বিলি-বণ্টনের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে বিকল্প কোনো পন্থা উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে দুর্গত মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন পর্যাপ্ত পরিমাণ ত্রাণসামগ্রী মজুত আছে। সুতরাং সেই মজুতকৃত ত্রাণের পরিকল্পিত বিতরণের মাধ্যমে বন্যাকবলিত অঞ্চলের জনভোগান্তি লাঘব করতে হবে। মনে রাখতে হবে, করোনার অযুহাতে জলমগ্ন বিপন্ন সাধারণের দুর্যোগ লাঘবে বিরত থাকার উপায় নেই। সর্বাগ্রে বিপদগ্রস্ত মানুষদেরকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব নিতে হবে।
করোনার কারণে নন-কোভিড রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা এখন প্রশ্নের সম্মুখীন। কোভিড-১৯ কিংবা নন-কোভিড যেকোনো রোগে শারীরিকভাবে আক্রান্ত মানুষ এদেশে কি সহজে চিকিৎসাসেবা পাবে না? যদি ঘুরিয়ে বলি আমাদের দেশের চিকিৎসাসেবা কি সাধারণ মানুষের সহজ নাগালের মধ্যে আসবে না কোনোদিনই? আগেও আমরা দেখেছি চিকিৎসাসেবার আড়ালে নানা ধরনের দালালচক্রের সক্রিয়তা। এখনো সেই চক্র ক্রিয়াশীল।
একদিকে এই অবস্থা আর অপরদিকে ভেজাল চিকিসা সামগ্রী নিয়ে তো করোনকালে অভিযোগের পাল্লা ভারী হতে হতে ছিঁড়ে যাবার উপক্রম! সরকারি যেকোনো হাসপাতালে গেলেই এদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনার চিত্র উপলব্ধি করা সম্ভব। উপলব্ধি করা সম্ভব চিকিৎসাসেবা নামক অধরা এক সোনার হরিণের কাছে এদেশের সাধারণ মানুষ কতটা অমানবিকতার শিকার। ঢাকাসহ দেশের নামকরা অনেক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করুণ অবস্থা ও অমানবিকতা যুদ্ধকালীন নিম্নমানের আশ্রয়ের কেন্দ্রের চেয়েও তীব্রতর। সেসব হাসপাতালে ভদ্রস্থ কিংবা মানসম্মত চিকিৎসা পাওয়া দুরূহ ব্যাপার!
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা যেখানে স্পষ্ট ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন যে, অসুস্থ হলে চিকিৎসার জন্য তাঁকে যেন বিদেশে পাঠানো না হয়। দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের প্রবেশমুখে প্রধানমন্ত্রীর ছবিসহ এ রূপ একটি স্লোগান শোভা পেতে দেখি। অথচ এই দেশেরই বিভিন্ন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা এমপিগণ সামান্য অসুস্থতার অজুহাত কিংবা নিয়মিত ‘চেক-আপ’-এর জন্য বিদেশে ছুটেন! শুধু মন্ত্রী এমপিই নন সরকারে উচ্চপর্যায়ের আমলারাও সাধারণ স্বাস্থ্য সেবা নিজের দেশ থেকে গ্রহণ না করে পৃথিবীর নামকরা বিভিন্ন হাসপাতালে চলে যান। উচ্চপদস্থ রাষ্ট্রীয় ব্যক্তিবর্গ যখন ভুলেও সরকারি হাসপাতালসমূহে ‘পায়ের ধুলো’ পর্যন্ত দিতে চান না সুতরাং সেক্ষেত্রে হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা যেমন নড়বড়ে হবে তেমনি নড়বড়ে হবে চিকিৎসাব্যবস্থাও এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনার অনেকটা উল্টো চিত্র দেখা যায় এদেশেরই প্রাইভেট হাসপাতালসমূহে।
দেখে অনেক সময় অবাক হতে হয় প্রায় একই শ্রেণির স্বাস্থ্যকর্মী ‘সরকারি’ বলে নিজস্ব চাকরিস্থলকে যতটা হেলাফেলায় নোংরা করে রাখেন আবার ‘প্রাইভেট’ বলে অস্থায়ী কর্মক্ষেত্রটাকে করে রাখেন একেবারেই ঝকঝকে তকতকে! হয়তো ‘উপরি’ পারিশ্রমিকের কারণেই ‘প্রাইভেট’ কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবাসহ হাসপাতাল ব্যবস্থাপনাকেও একটা সুন্দর শৃঙ্খলায় আবদ্ধ করেন। পক্ষান্তরে বাঙালির চিরকালীন সত্য সেই প্রবাদমূর্তির মতো আমাদের সম্মুখে দাঁড়ায় আর শোনায় ‘সরকারি মাল, দরিয়ায় ঢাল’। আবার প্রাইভেট হাসপাতাল নিয়েও আছে ‘অর্থখেকো’ দানবের অভিযোগ! কোথায় যাবে মানুষ!
আমাদের জানামতে অনেক সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন অধ্যক্ষের পাশাপাশি পরিচালক পদে আসীন থাকেন উচ্চপদস্থ কোনো না কোনো সামরিক কর্মকর্তা। তবু বর্তমান প্রজন্মের চোখ দিয়ে তাকানো যায় না সরকারি হাসপাতালের কোনো ওয়ার্ড, অপারেশন থিয়েটার এমনকি জরুরি বিভাগের দিকেও! প্রতিটি সরকারি হাসপাতাল একেকটি যেন দুঃখিনী বাংলা মায়ের জরাজীর্ণ প্রতিরূপ ধারণ করে অসহায় দাঁড়িয়ে আছে, মুখে তার চিরকালীন মালিন্য তবু কোনো প্রতিবাদ নেই, সর্বংসহা!
সার্বিক ব্যবস্থাপনাসহ সরকারি হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবাকে ঢেলে সাজাতে না পারলে বছরের পর বছর মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হতে হবে এদেশের মানুষকে, যাদের ট্যাক্সের পয়সায় সরকারি এসব বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মীদের মাসোহারা জুগিয়ে আসছেন। স্বাধীনতা লাভের পঞ্চাশ বছরের প্রাক্কালে বাংলাদেশে চিকিৎসাসেবার অধঃপতনের এই গন্তব্য নিয়ে, স্বাস্থ্যসেবার নেতিবাচক এই যাত্রা নিয়ে এমন আহাজারি শুনতে হবে তা কে কবে ভেবেছিল!
আমরা কি আমাদের মানবিকবোধ আর মানবিক স্বভাব নিয়ে বিপন্ন ও বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারব না কোনোকালেই? স্বাস্থ্যসেবায় শৃঙ্খলা ও কার্যকর ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হতে পারব না এখনো? কোভিড কিংবা নন-কোভিড বিতর্কে প্রকৃত চিকিৎসাকে আচ্ছন্ন করে রাখব আর কতদিন? আমাদের বিবেকবোধ কি ক্রমশই কেবল অন্ধকারের কাছেই নতি স্বীকার করবে? আলোর অভিমুখে ঘুরে দাঁড়াবে না আমাদের মানবিক চৈতন্য? তাহলে আমরা কোথায় যাবো? গন্তব্যই বা কোথায়?
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/বিএ/জেআইএম