আইসিইউতে বাজেট, জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন
ডা. শামীম তালুকদার
বাংলাদেশে করোনা মহামারিকালে পেশ হয়েছে আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট। করোনার কারণে ইতোমধ্যে বিপর্যয়ের মুখে বৈশ্বিক অর্থনীতি। সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে বিশ্বজুড়ে। ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে দেশগুলো। সারাবিশ্বের ন্যায় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও।
করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত পরিস্থিতিতে জাতীয় বাজেট যথাসময়ে পেশ করা যায় কি-না, সেটি নিয়ে যখন শঙ্কা দেখা দিয়েছিল তখন সঠিক সময়েই বাজেট পেশ করা হয়েছে। করোনার কারণে জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা যেখানে স্থবির হয়ে পড়েছিল সেই পরিস্থিতিতে দেশের জাতীয় বাজেট কেমন হতে পারে তা নিয়ে সংশয় ছিল অনেকেরই। বিশেষ করে করোনাকালীন দেশের স্বাস্থ্য খাতের ব্যবস্থাপনায় বাজেটে কী ধরনের পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে সেদিকে বিশেষ নজর ছিল সবার। করোনাভাইরাস সংক্রমণের ফলে রোগীরা চিকিৎসা পাচ্ছে না, করোনার চিকিৎসা বিনামূল্যে হওয়া কথা থাকার পরও বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃক রোগীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা আদায় করছে, করোনা পরীক্ষা করতে গিয়ে বিড়ম্বনা, পর্যাপ্ত পরীক্ষার সুযোগের অভাব, চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের পর্যাপ্ত সুরক্ষাসামগ্রী দিতে না পারার অভিযোগ, করোনার শুরুতে চিকিৎসকদের নকল সুরক্ষাসামগ্রী (এন-৯৫ মাস্ক) প্রদানসহ নানা অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম উঠে আসে কয়েক মাসের ব্যবধানে। তাই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে অনেকেই ধারণা করছিলেন স্বাস্থ্য খাতকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে এবারের বাজেটে এ খাতে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়া হবে। যদিও বাজেটে অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাবনায় তেমনটা দেখা যায়নি।
গত ১১ জুন জাতীয় সংসদে ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন হয়। কোভিড-১৯ এর প্রভাবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে যে জরুরি ও অপ্রত্যাশিত আর্থিক সহায়তার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে তা মেটাতে এবং অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা পুনরুদ্ধারের কৌশল বিবেচনায় নিয়ে মূলত ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তুত করা হয়েছে বলে এই বাজেটকে একটি ভিন্ন ধারার বাজেট বলে ঘোষণা করা হয়। ‘অর্থনৈতিক উত্তরণ ও ভবিষ্যৎ পথ পরিক্রমা’ শীর্ষক শ্লোগান সম্বলিত বাজেটের চূড়ান্ত আকার (ব্যয়) ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা যা জিডিপির ১৯ দশমিক ৯ শতাংশ। নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে জিডিপির আকার ধরা হয়েছে ৩১ লাখ ৭১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ব্যয় ধরা হয়েছে দুই লাখ পাঁচ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। [১]
কোনো একটি ভৌগোলিক অঞ্চলের স্থূল অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন, সামষ্টিক অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি নামেও পরিচিত) একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে ওই অঞ্চলের ভেতরে উৎপাদিত পণ্য ও সেবার মোট বাজারমূল্য-কে বোঝায় যা অঞ্চলটির অর্থনীতির আকার নির্দেশ করে। বিবেচ্য অঞ্চলটি যদি একটি দেশ হয় তবে একে মোট দেশজ উৎপাদন নামেও ডাকা হয়। প্রস্তাবিত বাজেটে জিডিপি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। বাজেট ব্যয়ের জন্য মোট আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তিন লাখ ৮২ হাজার ১৬ কোটি টাকা। নতুন বাজেটে ঘাটতির (অনুদানসহ) পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৮৫ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা যা মোট জিডিপির ৫ দশমিক ৮ শতাংশ এবং অনুদান ছাড়া ঘাটতির পরিমাণ হচ্ছে এক লাখ ৮৯ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা যা জিডিপির ৬ শতাংশ- এটি এই সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আগামী অর্থবছরে সরকারের পরিচালনা ব্যয় ধরা হয়েছে তিন লাখ ৪৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। এর মধ্যে আবর্তক ব্যয় হচ্ছে তিন লাখ ১১ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। এ আবর্তক ব্যয়ের মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধে খরচ হবে ৫৮ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় হবে পাঁচ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকা। এছাড়া সম্পদ সংগ্রহ, ভূমি অধিগ্রহণ, নির্মাণ ও পূর্তকাজ, শেয়ার ও ইক্যুইটিতে বিনিয়োগসহ মূলধনী ব্যয় হবে ৩৬ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা। পাশাপাশি ঋণ ও অগ্রীমবাবদ ব্যয় চার হাজার ২১০ কোটি টাকা।
[১. ‘৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট পাস’, ১১ জুন ২০২০, বাংলা ট্রিবিউন]
আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের ব্যয় মেটাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) কর/রাজস্ব আহরণ করতে হবে তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। পাশাপাশি করবহির্ভূত রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকা এবং করব্যতীত প্রাপ্তির পরিমাণ হচ্ছে ৩৩ হাজার ৩ কোটি টাকা। আয়ের দিক থেকে আগামী অর্থবছরে বৈদেশিক অনুদান পাওয়ার পরিমাণ ধরা হয়েছে চার হাজার ১৩ কোটি টাকা।
এবার আশা যাক নতুন বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে কী পরিবর্তন এসেছে সেই আলোচনায়। বাংলাদেশের জাতীয় প্রবৃদ্ধির বিবেচনায় অন্যান্য খাতের তুলনায় স্বাস্থ্য খাতে বাজেটে বরাবরই কম গুরুত্ব পেয়ে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ (ডব্লিউএইচও) অনুযায়ী, একটি দেশের স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জিডিপির কমপক্ষে ৫ শতাংশ এবং বাজেটের ১৫ শতাংশ হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু ডব্লিউএইচও-এর হিসাব মতে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে সব মিলিয়ে জিডিপির ৩ শতাংশ খরচ করা হয়। যেখানে সরকারের কন্ট্রিবিউশন থাকে মাত্র ১.০২ শতাংশ। আর বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত অর্থ বরাদ্দের ইতিহাসে কখনও-ই বাজেটের ৭ শতাংশও স্পর্শ করেনি। [২]
জাতিসংঘের ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিকের (এসকাপ) ২০১৮ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জিডিপির বিচারে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৫২টি দেশের মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে কম বরাদ্দ দেয়া হয় বাংলাদেশে। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু বরাদ্দ দেয়া হয় মাত্র ১ হাজার ৫৩৭ টাকা। এ কারণে মানুষকে নিজের পকেট থেকে প্রায় ৬৬ শতাংশের মতো অর্থ খরচ করতে হয়। অর্থাৎ স্বাস্থ্যের পেছনে ১০০ টাকা খরচ হলে সরকারি সহায়তা পাওয়া যায় মাত্র ৩৪ টাকা এবং বাকি ৬৬ টাকা রোগী নিজে বহন করে।
সাধারণ মানুষ চিকিৎসার জন্য যে টাকা খরচ করে তার ৭০ শতাংশের বেশি যাচ্ছে ওষুধের পেছনে। এই টাকা খরচ করা অনেক মানুষের জন্য একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জাতীয় স্বাস্থ্যব্যয় প্রতিবেদন মতে, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে রোগীর নিজের ব্যয় সবচেয়ে বেশি। [৩]
কয়েক বছর আগে ব্রিটেনের দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকা স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কৃপণ দেশগুলোর তালিকা প্রকাশ করে। সে তালিকায় সবচেয়ে কম বরাদ্দ দেয়া দেশগুলো হচ্ছে- মোনাকো, পাপুয়া নিউগিনি ও ব্রুনাই। এর পরেই রয়েছে বাংলাদেশের নাম। ডব্লিউএইচও এবং বিশ্বব্যাংকের ২০১৯ সালে প্রকাশিত স্বাস্থ্য খাতে আর্থিক সুরক্ষার ওপর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য সেবায় সবচেয়ে কম অর্থব্যয় করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো। আর এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে কম ব্যয় করে বাংলাদেশ। [৪]
বাংলাদেশে করোনা মহামারির বিপর্যস্ত পরিস্থিতির মধ্যে বাজেট ঘোষণার ফলে শুরু থেকেই এবারের বাজেটে আলোচনার কেন্দ্রে ছিল স্বাস্থ্য খাত। সবার ধারণা ছিল এবার স্বাস্থ্য খাতই সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পেতে যাচ্ছে। কিন্তু বাজেট ঘোষণার পর খুব বেশি হেরফের দেখা যায়নি। ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ প্রস্তাবিত মোট বাজেটের ৫.১ শতাংশ অর্থাৎ ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা এ বছর স্বাস্থ্য খাতে দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। যা আগের অর্থবছর ২০১৯-২০ এর তুলনায় ২৩ শতাংশ বেশি। প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়বে পাঁচ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা।[৫]
জানা গেছে বেশি যে বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে তা নতুন কিছু হাসপাতাল তৈরি করতে ব্যয় করা হবে। সরকার করোনা মোকাবিলায় ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দের প্রস্তাব করলেও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে জিডিপির মাত্র ১ দশমিক ৩ শতাংশ যা একেবারেই যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। অথচ করোনা মহামারির কারণে এবার স্বাস্থ্য খাতেই বেশি বরাদ্দ দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবায়নের সক্ষমতা না থাকায় শেষপর্যন্ত তা দেয়া হয়নি। শুধুমাত্র বরাদ্দ বাড়িয়ে স্বাস্থ্য খাতের নাজুক অবস্থার পরিবর্তন হবে না বরং বরাদ্দ বাস্তবায়নের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও কার্যকর ব্যবহারের দিকে বেশি নজর দেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২২ হাজার ৮৮৩ কোটি টাকা, স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণের জন্য রাখা হয়েছে ছয় হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। বাজেটে সমন্বিত স্বাস্থ্য-বিজ্ঞান গবেষণায় দেয়া হয়েছে ১০০ কোটি টাকা।
করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে ৩ ও ১০ বছর মেয়াদি দুটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। একটি বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় এক হাজার ১২৭ কোটি টাকার। অন্যটি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের দেয়া এক হাজার ৩৬৬ কোটি টাকার। [৬]
[২. ‘Covid-19: A reality check for Bangladesh's healthcare system’, 3 May 2020, United Nations Development Programme (UNDP)
৩. সায়েদুল ইসলাম, ‘করোনা ভাইরাস : স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ ও ব্যয়ের সংকট কী কাটবে?’, ১০ জুন ২০২০ বিবিসি বাংলা, ঢাকা
৪. জি কে সাদিক, ‘প্রসঙ্গ : বাজেটে স্বাস্থ্য খাত‘, ১৫ জুন ২০২০, মানবকণ্ঠ
৫. গৌতম ঘোষ, ‘করোনাকালে রেকর্ড ঘাটতির বাজেট’, ১১ জুন ২০২০, বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর.কম
৬. শাহনাজ পারভীন, ‘জাতীয় বাজেট ২০২০-২১ : করোনাভাইরাস মহামারির পটভূমিতে স্বাস্থ্য খাত কি গুরুত্ব পেল?’, ১১ জুন ২০২০, বিবিসি বাংলা, ঢাকা]
ডব্লিউএইচও’র সুপারিশ অনুযায়ী, একটি দেশের স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জিডিপির কমপক্ষে ৫ শতাংশ এবং বাজেটের ১৫ শতাংশ হওয়া বাঞ্ছনীয়। আমরা যদি ডব্লিউএইচও’র নিয়ম অনুসরণ করতে চাই তাহলে বাজেটে জিডিপির ৫ শতাংশ হিসাবে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দেয়ার দরকার ছিল এক লাখ ৫৮ হাজার ৫৯ কোটি টাকা অথবা বাজেটের ১৫ শতাংশ হিসাবে দরকার ছিল ৮৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা। অথচ ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ প্রস্তাবিত মোট বাজেটের ৫.১ শতাংশ অর্থাৎ ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। সুতরাং ডব্লিউএইচও’র সুপারিশকৃত বাজেটের ১৫ শতাংশ বরাদ্দের সাথে আমাদের স্বাস্থ্য খাতে প্রস্তাবিত বরাদ্দের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে ৫৫ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা। আর যদি জিডিপির ৫ শতাংশ অনুযায়ী হিসাব করি তাহলে গ্যাপ থেকে যাচ্ছে এক লাখ ২৯ হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা। সুতরাং অংকের হিসাবেই বোঝা যাচ্ছে বাজেটে আমাদের স্বাস্থ্য খাতের জন্য বরাদ্দ আর ডব্লিউএইচও’র সুপারিশকৃত বরাদ্দের চেয়ে কত কম।
এবারের বাজেটে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে যে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে সেটি প্রশংসনীয় কিন্তু যথেষ্ট নয়। অতীতের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হলেও সেটির বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় থেকে যায়। এবারের বাজেট ঘোষণার আগে অনেকের প্রস্তাব ছিল স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দেয়ার। যা বাংলাদেশে কখনও-ই হয়নি। তবে বাজেট প্রস্তাবের আগেই সরকারি বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, এবারও তা হচ্ছে না। কারণ স্বাস্থ্য বিষয়ক সরকারি কর্মকর্তাদের অর্থ ব্যবহারের সক্ষমতা নিয়ে আগে থেকেই প্রশ্ন ছিল। গত কয়েক অর্থবছরে দেখা গেছে, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ অব্যবহৃত থেকে যায়। গত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে ২৫ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হলেও পরবর্তীতে তা সংশোধন করে ২৩ হাজার ৬৯২ কোটি টাকা কমিয়ে আনা হয়৷ কিন্তু শেষপর্যন্ত সেই বরাদ্দের পুরোটাও খরচ করতে পারছে না মন্ত্রণালয়। চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ মাত্র ২৬ দশমিক ৭১ শতাংশ বরাদ্দ বাস্তবায়ন করতে পেরেছে। আর স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ বাস্তবায়ন করতে পেরেছে মাত্র ২৪ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এর বিপরীতে প্রকল্প বাস্তবায়নের জাতীয় হার হচ্ছে ৪৫ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। সেজন্য আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে করোনাভাইরাসের অভিঘাত সত্ত্বেও স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে বরাদ্দ বাড়ার বদলে কমেছে।[৭] অথচ এক গবেষণায় দেখা গেছে, বছরে দেশের ৪ শতাংশ মানুষ শুধুমাত্র চিকিৎসার খরচ জোগাতে গিয়ে দারিদ্র্যের কবলে পড়ছে। চিকিৎসার খরচ জোগাতে গিয়ে গরীবদের গরু-ছাগল, জমিজমা ও মধ্যবিত্তদের ঘরবাড়ি বিক্রি করা এবং দেনায় পড়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে। সক্ষমতার অভাবে বাজেটের পুরো অর্থ যেখানে খরচ করা যাচ্ছে না সেখানে অর্থের অভাবে সাধারণ মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে। সরকারি স্বাস্থ্যসেবা নিতে গেলেও রোগীকে খরচের দুই-তৃতীয়াংশ দিতে হয়। বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে কী বরাদ্দ দেয়া হলো এবং তা রোগীর খরচের অংশকে কমাচ্ছে নাকি বাড়াচ্ছে এটি দেখা হচ্ছে না। সুতরাং বোঝাই যায়, আমাদের নীতিনির্ধারক ও নীতিবাস্তবায়নকারীদের বাজেটের অর্থ ব্যবহারের সক্ষমতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে।[৮]
জাতীয় বাজেটে কোনো খাতে অর্থ বরাদ্দে ক্ষেত্রে দুটি বিষয় লক্ষ্য করা হয়। প্রথমত, সেই খাতের টাকা নেয়ার সক্ষমতা কতটা আছে; দ্বিতীয়ত, বরাদ্দের ক্ষেত্রে সরকারের কাঠামো। চাইলেই বরাদ্দ কমানো যায় না আবার অনেক বাড়ানোও যায় না। প্রবৃদ্ধি অনুযায়ী হিসাব করা হয়। গত পাঁচ বছরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বরাদ্দের চেয়ে বড়জোর ১০০০ বা ১২০০ কোটি টাকা বেশি খরচ করতে পেরেছে। [৯] যদিও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দকৃত অর্থ পুরোপুরি খরচ না করতে পারার পেছনে কিছু যুক্তিও রয়েছে এবং এসব যুক্তির মধ্যে প্রধান যুক্তি হচ্ছে, সময়মতো বরাদ্দকৃত অর্থ না পাওয়া। বাজেট দেয়া হয় বছরের জুন মাসে। সেটা ছাড় করতে দু-তিন মাস চলে যায়। যখন টাকাটা পাওয়া যায় তখন সময়মতো টাকা খরচ করার জন্য পর্যাপ্ত সময় থাকে না- খুব তাড়াহুড়ো হয়ে যায়। যার কারণে কাজ যে মানের হওয়া দরকার তেমন কাজ করা যায় না। প্রয়োজন কোথায় এবং কোন ক্ষেত্রে কতটুকু দরকার সেটা যাচাই করে বরাদ্দ হয় না। বাজেট যখন করা হয় পূর্ববর্তী বছরের যে টাকাটা থাকে সেখান থেকে কিছু পার্সেন্ট বাড়িয়ে দেয়া হয়। এছাড়া সরাসরি স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নিয়োগ না করে স্বাস্থ্য খাত পরিচালনা করা হচ্ছে বলে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারে নজর থাকছে না।
বিশ্বের অনেক দেশে স্বাস্থ্যবীমা বাধ্যতামূলক হলেও অর্থনৈতিক সক্ষমতা থাকার পরও বাংলাদেশে এখনও তা বাস্তবায়ন করেনি। দেশে করোনার পরিস্থিতিতে বিভিন্ন পক্ষ থেকে জনগণের জন্য স্বাস্থ্যবীমার এবং হেলথ কার্ডের কথা উঠে এলেও বাজেটে এ ব্যাপারে কোনো কথা বলা হয়নি। অথচ দেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৭২ বছর। জনসংখ্যার ৪০ শতাংশের বয়স ২৫ থেকে ৫৪ বছরের মধ্যে। এই বয়সের মানুষদেরই অর্থ উপার্জনের ক্ষমতা ও সুযোগ বেশি থাকে। ফলে কর্মক্ষম বৃহৎ এই জনগোষ্ঠীকে আর্থিকভাবে দুশ্চিন্তামুক্ত রাখতে দরকার সুপরিকল্পিত আর্থিক নিরাপত্তা। এ কারণেই দরকার সর্বজনীন স্বাস্থ্যবীমা। কিন্তু এই ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপই চোখে পড়েনি এই বাজেটে। এমনকি বাংলাদেশ সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নিউইয়র্কে বাংলাদেশ জাতিসংঘ সাধারণ সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বা ইউনিভার্সেল হেলথ কভারেজ (ইউএইচসি) পক্ষে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং ২০১২ সালে ইউএইচসি প্রস্তাবে স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু বাস্তবে সরকার গত আট বছরে দেশে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা প্রস্তাবের কিছুই বাস্তবায়ন করেনি। সরকারের সদিচ্ছা থাকলেই সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বাস্তবায়ন করা সম্ভব বলে মনে করে স্বাস্থ্যচিন্তাবিদরা। কেননা বাংলাদেশের সমান অর্থনীতির দেশ শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম ও মরক্কোর মতো দেশগুলো এই ইউএইচসি বাস্তবায়ন করেছে। [১০]
[৭. ফাহমিদা খাতুন, ‘স্বাস্থ্য খাতের উন্নতি শুধু বরাদ্দে হবে না’, ১৪ মে ২০২০, প্রথম আলো
৮. ফরিদা আখতার, ‘পরিকল্পনাহীন স্বাস্থ্য বাজেট’, ১৪ জুন ২০২০, বণিক বার্তা
৯. ‘এই বাজেট করোনায় ঝুঁকিতে পড়া মানুষকে বাঁচানোর বাজেট: অর্থমন্ত্রী’, ১২ জুন ২০২০, দৈনিক সমকাল
১০. জি কে সাদিক, ‘প্রসঙ্গ: বাজেটে স্বাস্থ্য খাত’, ১৫ জুন ২০২০, মানবকণ্ঠ]
চিকিৎসা সরঞ্জামাদির অপ্রতুলতা, সেবার নিম্নমান, মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয়, স্বাস্থ্যকর্মী ও জনসংখ্যার অনুপাতসহ স্বাস্থ্য বিষয়ক নানা দিক থেকে বিশ্বের পশ্চাৎপদ দেশগুলোর তালিকায় থেকে বাংলাদেশের কোনো সরকারের আমলেই স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজানোর জন্য তেমন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বরং দশকের পর দশক ধরে এই খাতকে বেসরকারিকরণের দিকে মুনাফা লাভের উৎস হিসেবে কর্পোরেটদের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যে কত ভঙুর অবস্থায় আছে তা আগে টের পাওয়া না গেলেও নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর চোখের সামনে তা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। জনগণের স্বাস্থ্যসেবার জন্য সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে গড়ে উঠেছে জনগণেরই টাকায় এবং তা কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বলে যা কিছু আছে তা একমাত্র পাওয়া যায় সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায়। কিন্তু দীর্ঘ তিন দশকে উন্নয়ন সহযোগীদের অনেক ধার করা পরামর্শ নিয়ে এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সঙ্গে সেবা খাত উন্মুক্ত করার চুক্তি করে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার উপেক্ষা করে সরকারি স্বাস্থ্য খাতকে একেবারে দুর্বল করে ফেলা হয়েছে এবং মুনাফাভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা অনিয়ন্ত্রিত ‘প্রাইভেট সেক্টর’-এর মাধ্যমে একই সঙ্গে ওষুধ ব্যবসা ও হাসপাতাল ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়ে স্বাস্থ্যসেবাকে পণ্যে রূপান্তর করেছে। [১১]
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্যবিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেটের গবেষণায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ ও মান সূচকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, ভুটান, নেপাল ও আফগানিস্তানের ওপরে এবং শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের নিচে রয়েছে। [১২]
[১১. ফরিদা আখতার, ‘পরিকল্পনাহীন স্বাস্থ্য বাজেট’, ১৪ জুন ২০২০, বণিক বার্তা
১২. অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান, ‘করোনাকালের স্বাস্থ্য বাজেট’, ১৪ জুন ২০২০, জাগো নিউজ২৪.কম]
গণমাধ্যম ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, দেশের স্বাস্থ্য খাতে সরকারিপর্যায়ে চিকিৎসকসহ প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন ৭৮ হাজার ৩০০ জন। এর মধ্যে চিকিৎসক পদে রয়েছেন ২৭ হাজার ৪০৯ জন। [১৩] বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) রেজিস্টার্ড এমবিবিএস এবং ডেন্টিস্ট চিকিৎসকের সংখ্যা এক লাখ (এমবিবিএস ডাক্তার ৯১ হাজার ও বিডিএস ৯ হাজার)। যাদের মধ্যে ৭০ হাজার চিকিৎসক সরাসরি সার্ভিস বা প্রাকটিসের সাথে জড়িত। বাকিরা অন্যান্য পেশার সাথে জড়িত বা মারা গেছেন। বিএমডিসির হিসাব অনুযায়ী ৭০ হাজার কর্মরত চিকিৎসকের মধ্যে প্রায় ৩০ হাজার চিকিৎসক সরকারিপর্যায়ে কাজ করছেন। এই ৩০ হাজার সরকারি চিকিৎসকের মধ্যে তিন হাজার চিকিৎসক সরকারের প্রশাসনিকপর্যায়ের কাজের সাথে জড়িত। [১৪]
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় প্রতি ১০ হাজার জনগণের জন্য ২৩ জন ডাক্তার থাকার কথা। অথচ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ প্রকাশিত ‘হেলথ বুলেটিন ২০১৮’ অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রতি ১০ হাজার মানুষের চিকিৎসাসেবার জন্য চিকিৎসক রয়েছেন ৬.৩৩ জন। প্রতি এক হাজার ৫৮১ জন মানুষের চিকিৎসাসেবার জন্য রয়েছেন একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক। প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতায় চিকিৎসকের সংখ্যা ১.২৮ জন। [১৫]
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী, একটি দেশে প্রতি একজন চিকিৎসকের বিপরীতে তিনজন নার্স ও পাঁচজন টেকনোলজিস্ট থাকা আবশ্যক। অর্থাৎ ডাক্তার, নার্স ও টেকনোলজিস্টের অনুপাত হবে ১:৩:৫। বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের গত ৩১ মে ২০২০ তারিখের সর্বশেষ প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী, বাংলাদেশে রেজিস্টার্ড নার্সের সংখ্যা ৭১ হাজার ৩৫৪ জন। এর মধ্যে সরকারি নার্স রয়েছেন ৪০ হাজার। [১৬] নির্দেশনা মতে, একজন চিকিৎসকের সাথে তিনজন নার্স থাকার কথা থাকলেও বাংলাদেশের অধিক সংখ্যক রোগীকে সামাল দিতে গিয়ে একজন নার্সকে তিনজন চিকিৎসকের সাথে কাজ করতে হয়, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনার পুরো বিপরীত। একটি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় প্রতি পাঁচজন রোগীর জন্য একজন তালিকাভুক্ত নার্স থাকার কথা। আর বাংলাদেশে প্রতি ১০০-এর বেশি রোগীর জন্য একজন নার্স থাকেন। প্রতি ১০ হাজার জনগণের জন্য নার্স রয়েছেন ৩.০৬ জন। জনসংখ্যার অনুপাতে বর্তমানে পুরো বাংলাদেশে কমপক্ষে প্রায় আড়াই লাখ নার্স দরকার। [১৭] দেশে চিকিৎসকপ্রতি টেকনোলজিস্টের সংখ্যা নার্সের সংখ্যার চেয়েও অনেক কম। দেশে রোগ নির্ণয়কারী মেডিকেল টেকনোলজিস্টের পোস্ট আছে ৯,২০০টি। এর মধ্যে ২০০৮ সালের পর দীর্ঘ ১২ বছর কোনো নিয়োগ হয়নি। সর্বসাকুল্যে দেশে এখন মেডিকেল টেকনোলজিস্টের সংখ্যা মাত্র ছয় হাজার। প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য মেডিকেল টেকনোলজিস্ট আছেন মাত্র শূন্য দশমিক ৩২ জন। [১৮]
[১৩. Abdur Rahman Jahangir, ‘Coronavirus: Bangladesh cannot afford losing doctors’, 26 APRIL 2020, United News of Bangladesh (UNB)
১৪. ‘৮ হাজার চিকিৎসক-নার্স নিয়োগ হচ্ছে’, ২৩ এপ্রিল ২০২০, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
১৫. ‘HEALTH BULLETIN- 2018’, Management Information System, Directorate General of Health Services, Mohakhali Dhaka 1212, www.dghs.gov.bd
১৬. ‘Total Registered Nurse-Midwife Update’, 31 May 2020, Bangladesh Nursing & Midwifery Council
১৭. মুন্নী আক্তার, ‘করোনাভাইরাস: বাংলাদেশে নার্সদের সুরক্ষা কি অবহেলিত?’, ১২ মে ২০২০, বিবিসি বাংলা, ঢাকা
১৮. সাবির মুস্তাফা, ‘এডিটারস মেইলবক্স: করোনাভাইরাসে মানুষের দুর্ভোগ নিয়ে প্রশ্ন’, ৩ মে ২০২০, বিবিসি নিউজ বাংলা]
যেকোনো টেস্ট বা রোগ নির্ণয় তো ডাক্তার বা নার্স করেন না। রোগ নির্ণয় মূলত মেডিকেল টেকনোলজিস্টরাই করেন। আমাদের দেশে প্রায় ২৫ হাজার মেডিকেল টেকনোলজিস্ট বেকার হয়ে পড়ে রয়েছেন। অথচ দক্ষ টেকনোলজিস্টের অভাবে করোনার পরীক্ষা করা যাচ্ছে না। অসংখ্য টেকনোলজিস্ট করোনার এই সংকটময় মুহূর্তে প্রয়োজন হলেও তাদের নিয়োগের ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। সবশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় ১২০০ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
এদিকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পরে করোনারোগীর নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার কাজে অংশ নেয়ার জন্য বেকার মেডিকেল টেকনোলজিস্টরা স্বাস্থ্য বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে একাধিকবার আবেদন করেছেন। কিন্তু তাদের কাউকে কিছু না জানিয়ে অস্থায়ী ও মাস্টার রোলে ১৮৩ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্টকে দুর্নীতি করে নিয়োগ দেয়ার খবর সম্প্রতি প্রকাশিত হয় গণমাধ্যমে। [১৯]
যদিও করোনার ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতি সামাল দেয়ার লক্ষ্যে দেশের স্বাস্থ্য খাতে নতুন করে দুই হাজার ডাক্তার, পাঁচ হাজার নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী ও টেকনিশিয়ান নিয়োগদানের ব্যাপারে উদ্যোগ শুরু হয়েছে যা একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। নতুন বাজেটে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীসহ যারা কোভিড-১৯ মোকাবিলায় কাজ করছেন তাদের জন্য ৮৫০ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে করোনা সংকট মোকাবিলায় সম্মুখ থেকে যেসব ডাক্তার, নার্স এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী মূল যুদ্ধটা করছে তাদের জন্য মাসিক মহামারিকালীন ভাতা বা ক্রিটিক্যাল অ্যালাউন্স চালুর ব্যাপারে বাজেটে একটি বরাদ্দ রাখা দরকার ছিল বলে মনে করেন গবেষকরা। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও চীন সরকার তাদের স্বাস্থ্যকর্মীদের এমন ভাতা দিচ্ছে। তাদের যুদ্ধের স্বীকৃতিস্বরূপ এটি একটি অতিরিক্ত সম্মানী যা তারা মাসের বেতনের সাথে পাবেন। কারণ কোভিড-১৯ এ আক্রান্তদের চিকিৎসাসেবা দেয়ার কারণে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণের ঝুঁকিতে আছেন এই পেশায় নিয়োজিতরা। তবে সবকিছুর পরও এবার করোনার কারণে বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। করোনা মোকাবিলায় অতিরিক্ত ১০ হাজার কোটি টাকা রাখা হয়েছে। সক্ষমতা বিবেচনা করে প্রয়োজন অনুযায়ী বরাদ্দ দেয়া হবে। স্বয়ং অর্থমন্ত্রী বলেছেন, স্বাস্থ্য খাত যত টাকা নিতে পারবে তত দেয়া হবে। তবে এজন্য তাদের কার্যকর সেবা বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে টাকার অভাব হবে না। তবে সেবা নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্য খাত আগে অবহেলিত ছিল। কিন্তু বর্তমান সরকার তা কাটিয়ে ওঠার উদ্যোগ নিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বর্তমান করোনাঝুঁকির সময়ে সাধারণ মানুষের বড় চাওয়া হলো বাজেটে বরাদ্দ যাই থাক শতভাগ স্বাস্থ্যসেবা যেন নিশ্চিত হয়। সেটা কত বরাদ্দ দিয়ে হবে তার চেয়ে মূল প্রত্যাশা হচ্ছে, দেশের সর্বত্র যেন ভাইরাস পরীক্ষার সুযোগ ব্যাপকভাবে বাড়ানো হয়, জরুরি অবস্থায় চিকিৎসাসেবা যেন ঠিকমতো পাওয়া যায়, চিকিৎসকরা যেন উপযুক্ত সুরক্ষাসামগ্রী নিয়মিত পেতে পারেন, ওষুধ যেন সুলভমূল্যে পাওয়া যায়, করোনাভাইরাসজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি ছাড়াও অন্যান্য রোগের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবায় যেন ঘাটতি না থাকে। কাজেই বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের যে বরাদ্দ তা সুশাসনের সঙ্গে ব্যবহার ও দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহারের দিকে মানুষের নজর বেশি। [২০]
[১৯. ‘মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ অনিয়মে দায়িদের শাস্তি দাবি’, ১২ জুন ২০২০, প্রথম আলো
২০. ড. নাজনীন আহমেদ, ‘চারদিক থেকে কেমন দেখাচ্ছে বাজেটটা’, ১৩ জুন ২০২০, আমাদের সময়]
করোনাকালীন দেশে চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রয়োজনীয় সংখ্যক সুরক্ষাসামগ্রী পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ উঠেছিল। তার একটি বড় উদাহরণ হচ্ছে- সোসাইটি ফর নার্সেস সেফটি অ্যান্ড রাইটসের করা এক জরিপ। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, করোনার চিকিৎসায় জড়িত ৮৬ শতাংশ নার্স পূর্ণব্যক্তিগত নিরাপত্তা সরঞ্জাম পাননি। গত ১৯ এপ্রিল থেকে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত অনলাইনে একটি জরিপ করে তারা এই তথ্য পান। ওই জরিপে অংশ নিয়েছিলেন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের ৭০০-এর বেশি নার্স। [২১]
এছাড়া বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে প্রকাশ পায় যে, করোনাকালীন ফ্রন্টলাইনে থেকে যেসব চিকিৎসক করোনারোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তারা সরকারঘোষিত আর্থিক প্রণোদনার চাইতেও উপযুক্ত মানের সুরক্ষাসামগ্রীর প্রয়োজনীয়তা বেশি বলে উল্লেখ করেছেন। প্রথমদিকে চিকিৎসকদের যেসব মাস্ক ও সুরক্ষাসামগ্রী দেয়া হয়েছিল তার বেশির ভাগই ছিল ত্রুটিপূর্ণ।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সর্বশেষ প্রকাশিত ( ১৮ জুন) তালিকা অনুযায়ী, করোনায় আক্রান্ত চিকিৎসকের সংখ্যা এক হাজার ৪০ জন, আক্রান্ত নার্সের সংখ্যা ৯০১ জন এবং স্বাস্থ্য খাতের সাথে জড়িত করোনায় আক্রান্ত অন্যান্য স্টাফের সংখ্যা এক হাজার ৩৬০ জন। চিকিৎসক, নার্স এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী মিলিয়ে মোট আক্রান্ত হয়েছেন তিন হাজার ৩০১ জন।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে ও উপসর্গ নিয়ে দেশে ৪০ জনের বেশি চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে। এত বেশিসংখ্যক স্বাস্থ্যকর্মী, নার্স ও চিকিৎসকের করোনা আক্রান্ত হওয়া এবং মারা যাওয়ার পেছনে অপর্যাপ্ত ও নিম্নমানের সুরক্ষাসামগ্রী সরবরাহকে দায়ী করা হচ্ছে। দেশে করোনা চিকিৎসার সাথে জড়িত চিকিৎসক ও অন্যান্য কর্মীদের সুরক্ষার জন্য সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে— এমনটাই শোনা যাচ্ছে। যার কারণে এত স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট কর্মী আক্রান্ত হচ্ছেন এবং মারা যাচ্ছেন। দেখা যাচ্ছে ডাক্তারদের জন্য অপরিহার্য উপাদান মাস্ক। N-95 বা KN-95 মাস্ক ছাড়া এ ধরনের ভাইরাস প্রতিরোধ সম্ভব নয়। এমতাবস্থায় সরকার N-95 মাস্কের নামে দেশের তৈরি নিম্নমানের মাস্ক দিয়েছেন ডাক্তারদের। আবার কোথাও কোথাও এখনও ডাক্তাররা তাদের প্রয়োজনমতো পিপিই পাননি। এমনও অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতালগুলোতে শপিং ব্যাগের কাপড়ের তৈরি নিম্নমানের পিপিই সরবরাহ করা হয়েছে। যা দিয়ে ভাইরাস প্রতিরোধ সম্ভব নয়। এছাড়া করোনার জন্য ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে এন-৯৫ মাস্ক যেখানে অপরিহার্য, সেখানে টিস্যু কাপড়ের মাস্ক দেয়া হয়েছে। চোখের সুরক্ষার জন্য যে বিশেষ চশমা (গগলস) দেয়া হয়েছে তা চায়না থেকে আমদানি করা শিশুদের খেলনা গগলস মানের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এসব কর্মকাণ্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। অনেকে আবার নিজ উদ্যোগে পিপিই সংগ্রহ করলেও তা নকল ও নিম্নমানের। সংকটকালীন এই সময়ে অনেকে চীন থেকে এসব নিম্নমানের মাস্ক, হ্যান্ড গ্ল্যাভস, হ্যান্ড স্যানিটাইজার আমদানি করে চড়ামূল্যে অনলাইনে বিক্রির মাধ্যমে ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীসহ জনসাধারণের চাহিদা পূরণ করছে। এসব পিপিই’র মান নিয়ে আছে প্রশ্ন আর সেই সাথে আছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে এক গবেষণা বলছে, হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীরা তাদের নিজেদের দ্বারা পরিবারের সদস্যদের আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে তীব্র মানসিক চাপে রয়েছেন। আর্থিক প্রণোদনার বদলে তারা চান উপযুক্ত পিপিই অর্থাৎ করোনাভাইরাস সংক্রমণ-প্রতিরোধী পোশাক ও অন্যান্য সরঞ্জাম।[২২]
[২১. মুন্নী আক্তার, ‘করোনাভাইরাস: বাংলাদেশে নার্সদের সুরক্ষা কি অবহেলিত?’, ১২ মে ২০২০, বিবিসি বাংলা, ঢাকা
২২. শাকিল আনোয়ার, ‘করোনাভাইরাস: বাড়তি টাকা নয়, বাংলাদেশে ডাক্তাররা সুরক্ষা চান’, ১৮ এপ্রিল ২০২০, বিবিসি বাংলা]
আমাদের মতো নিম্ন আয়ের দেশে যেখানে জনসংখ্যার অনুপাতের প্রেক্ষিতে পর্যাপ্ত চিকিৎসকের অভাব সেখানে সুরক্ষাসামগ্রীর অভাবে একজন চিকিৎসকের মৃত্যু আমাদের জন্য অনেক বড় ব্যর্থতা। যেখানে বিশ্বের অন্য দেশগুলো তাদের চিকিৎসকদের সুরক্ষায় সর্বোচ্চ পর্যায়ের সাবধানতা অবলম্বন করছে সেখানে আমাদের দেশে চিকিৎসকদের জন্য পর্যাপ্ত সুরক্ষাসামগ্রী সরবরাহ করতে না পারাটা লজ্জাজনক।
সুরক্ষাসমাগ্রী নিয়ে অভিযোগ ও অসন্তোষের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে করোনাভাইরাস সংক্রমণ মোকাবিলায় যেসব সুরক্ষাসামগ্রী রয়েছে যেমন- মাস্ক, গ্লাভস, পিপিই, সেগুলোর দাম কমবে বলে জানানো হয়েছে। হাসপাতালে আইসিইউ বা নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র পরিচালনায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির দামও কমবে। বাজেটের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণের জন্য যে অংশ রয়েছে সেখানে কী করা হয়েছে বা কী কী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে সেটিই বেশি উল্লেখ করা হয়েছে। তবে স্বাস্থ্য খাতে সংস্কারের ক্ষেত্রে কী করা হবে এবং কীভাবে করা হবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট করে কিছু নেই বললেই চলে। যদিও চলতি বাজেটে স্বাস্থ্য খাতকে সবচেয়ে অগ্রাধিকার পাওয়া খাত হিসেবে উল্লেখ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল৷ করোনাভাইরাস মোকাবিলার বিষয়টিই স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে আপাতত সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য বাজেটের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা খাতে উন্নয়নের মাধ্যমে সবার জন্য সুলভ ও মানসম্মত স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা নিশ্চিত করে একটি সুস্থ, সবল ও কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা। প্রধান যে কার্যাবলির জন্য বাজেটে বরাদ্দ করা হয় সেগুলো হচ্ছে- স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সংক্রান্ত যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা প্রদান এবং জনগণের প্রত্যাশিত সেবার পরিধি সম্প্রসারণ, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সুবিধাসহ জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন এবং বিভিন্ন সংক্রামক ও অসংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধ ও প্রতিকার, মানসম্পন্ন ওষুধ উৎপাদন ও বিতরণ এবং আমদানি ও রফতানিযোগ্য ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, চিকিৎসাশিক্ষা, নার্সিংশিক্ষা, জাতীয় জনসংখ্যা ও স্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষণা ও প্রশিক্ষণবিষয়ক কার্যাবলি, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সংক্রান্ত স্থাপনা, সেবা ইনস্টিটিউট ও কলেজ নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণ ও সম্প্রসারণ, শিশু ও মাতৃ স্বাস্থ্যসেবা, সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি, বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি এবং পুষ্টি উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সকল স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে সংযোগ স্থাপন সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়াদি। [২৩]
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রস্তাবিত বাজেট কোভিড-১৯ মোকাবিলায় যেমনটি হওয়ার দরকার ছিল তেমনটি হয়নি। বাজেট অন্যান্যবারের মতো গতানুগতিক ধারাতেই প্রণয়ন করা হয়েছে। যেটি বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় যথেষ্ট নয়। বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও সক্ষমতার অভাব নিয়ে আলোচনা করা দরকার ছিল। জরুরি স্বাস্থ্যঝুঁকি হলে তা মোকাবিলায় কীভাবে উদ্যোগ নেয়া হবে সে দিকনির্দেশনা থাকলে ভালো হতো। অর্থাৎ স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে যে বরাদ্দ আছে সেটা কোন পরিস্থিতিতে এবং কীভাবে ব্যবহার হতে পারে তার একটা সুস্পষ্ট কর্মপরিকল্পনা বাজেট বক্তৃতায় থাকা দরকার ছিল। এছাড়া কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন পাওয়া এবং জনগণের কাছে সেটি সহজলভ্য করে তোলার জন্যও বাজেটে আলাদা বরাদ্দ থাকার দরকার ছিল।
বাজেটের বেশকিছু ধারায় তথ্য ও উপাত্তের অসঙ্গতি চোখে পড়ে। এটি নিয়ে সাবধান হওয়া উচিত। যেহেতু ভুল তথ্য-উপাত্তের ফলে ভুল নীতি প্রণয়ন ও প্রয়োগ হতে পারে। এবারের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে প্রস্তাবিত অর্থ কীভাবে খরচ করবে সরকার, এ প্রশ্নের উত্তরে বিবিসি বাংলার এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, হৃদরোগ, কিডনি ও ক্যান্সারের চিকিৎসা ব্যবস্থা বাড়ানোর জন্য বিভাগীয় শহরগুলোতে ১০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল তৈরি করা হবে। এছাড়া বিদ্যমান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে এবং সকল জেলা সদর হাসপাতালে নেফ্রোলজি ইউনিট ও ডায়ালাইসিস কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা এবং স্বাস্থ্য বিষয়ে শিক্ষাব্যবস্থা বাড়ানোর কথাও জানা যায়। যদিও স্বাস্থ্য খাতে রোগ নির্ণয়, চিকিৎসাসেবা, রোগ প্রতিরোধ, অবকাঠামো উন্নয়ন, জনবল বাড়ানো, সুশাসন নিশ্চিত করা— এসব দিক ঢেলে সাজানোর জন্য ব্যাপক মাত্রায় এবং টেকসই সংস্কার বিষয়ে কোনো পথ-নির্দেশনা নেই।
স্বাস্থ্য খাতে যে পরিমাণ অর্থই বরাদ্দ করা হোক না কেন সেই টাকার যথাযথ ব্যবহার দুর্নীতির কারণে নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। বিশেষ করে স্বাস্থ্য খাতে চিকিৎসাসামগ্রী ও উপকরণ ক্রয়ে বেশি দুর্নীতি হচ্ছে। বাংলাদেশে গত কয়েক বছর স্বাস্থ্য খাতে বেশকিছু দুর্নীতির কেলেঙ্কারির বিষয় সামনে এসেছে। গত বছরের শুরুতে দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে একটি প্রতিবেদন দিয়েছিল। এতে বলা হয়েছিল, স্বাস্থ্য খাতে ১১টি উৎস থেকে দুর্নীতি হয় যার মধ্যে রয়েছে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, ওষুধ, চিকিৎসার সরঞ্জাম ও পণ্য কেনাকাটা। বাজেটের সঠিক ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে স্বাস্থ্য খাতের সংস্কারের বিষয়টি। এমনিতেই কোভিড-১৯ সৃষ্ট বর্তমান অর্থনৈতিক মন্দার কারণে আগামী বছরটি বাংলাদেশের তথা সারাবিশ্বের জন্য অত্যন্ত কঠিন সময় হবে। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে প্রায় সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং উৎপাদনশীল প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেছে। মার্চ ২০২০ পর্যন্ত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের মাত্র ৪৩ শতাংশ ব্যয়িত হয়েছে, যা গত বছর একই সময়ের তুলনায় ২ শতাংশ কম। মার্চের পর থেকে পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু (কর্ণফুলী) টানেলসহ হাতেগোনা কয়েকটি প্রকল্প ছাড়া বাকি প্রায় সব ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড স্থগিত রয়েছে। কবে নাগাদ পূর্ণোদ্যমে এ উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজ শুরু করা যাবে, তা এ মুহূর্তে নিশ্চিত করে বলা একরকম অসম্ভব।
ধারণা করা হচ্ছে, এ বছর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। প্রায় পাঁচ সপ্তাহ বন্ধ থাকার পর তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে উৎপাদন শুরু হয়েছে। পারসোনাল প্রোটেকশন ইকুইপমেন্টসহ (পিপিই) স্বাস্থ্যসেবার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম উৎপাদনের নতুন ক্ষেত্র আমাদের জন্য উন্মোচিত হয়েছে। তবে কতদিন কারখানাগুলো চালু রাখা যাবে, তা এখনও অনিশ্চিত। উৎপাদনের অন্য খাতগুলোর প্রায় ৩০ শতাংশ ইতোমধ্যে চালু করা গেছে। এমতাবস্থায় দুর্নীতির কারণে যদি বাজেটের অর্থ ঠিক মতো ব্যবহার করা না যায় সেটি আমাদের জন্য হবে বড় ব্যর্থতা। করোনা মহামারির কারণে মার্চ ২০২০ থেকে মানুষ যে ধরনের স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, খাদ্য নিরাপত্তা ও শিক্ষাঝুঁকির মুখোমুখি হয়েছে, তা থেকে উত্তরণের জন্য এবারের বাজেটে স্বাস্থ্য সুরক্ষা, খাদ্য নিরাপত্তা, জরুরি অবস্থায় শিক্ষা, কর্মসৃজন, ব্যবসায়ী ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হবে, তা সবারই প্রত্যাশা। যদিও দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে এক লাখ তিন হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ দেয়া হলেও শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়েনি।
ইউনেস্কোর মতে, কোভিড ১৯-এর ফলে পারিবারিক অর্থসংকট, শিশুশ্রম, বিদ্যালয়ে অনুপস্থিতি, ঝরে পড়া, স্বাস্থ্য ও অপুষ্টিজনিত প্রতিবন্ধকতা এবং বাল্যবিবাহের কারণে বিশ্বব্যাপী শিক্ষা খাতে বিগত দুই দশকে যে অগ্রগতি হয়েছে তা বড় ধরনের বাধার সম্মুখীন হবে। এ থেকে উত্তরণের জন্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর চাহিদা এবং অধিকারের কথা বিবেচনা করে মানবসম্পদ উন্নয়নের অন্যতম ভিত্তি হিসেবে স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি জনমানুষের পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হয়েছিল। [২৪] যার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার বলছে, স্বাস্থ্য খাতকে এবার সর্বাপেক্ষা অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে এবং করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে এ খাতে অতিরিক্ত বরাদ্দ প্রণোদনা ও ক্ষতিপূরণ ইত্যাদির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে৷ এছাড়া বেশি বরাদ্দ আছে শিক্ষা ও প্রযুক্তি, সুদ পরিশোধ, স্থানীয় সরকার, পরিবহন ও যোগাযোগ, প্রতিরক্ষা ও জনপ্রশাসনে৷
[২৩. অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান, ‘করোনাকালের স্বাস্থ্য বাজেট’, ১৪ জুন ২০২০, জাগো নিউজ২৪.কম
২৪. কে এম এনামুল হক, ‘শিক্ষা বাজেট ২০২০-২০২১ প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’, ১২ জুন ২০২০, বাংলা ট্রিবিউন]
কোভিড-১৯ মোকাবিলার অভিজ্ঞতা আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কিছু দুর্বলতা চিহ্নিত করেছে৷ এর ফলশ্রুতিতে স্বাস্থ্য খাতে আমাদের দীর্ঘদিনের অর্জনসমূহ টেকসই করা এবং ভবিষ্যতে মহামারি বা মরণব্যাধির প্রাদুর্ভাব প্রতিরোধ ও মোকাবিলাসহ সামগ্রিকভাবে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে উন্নত বিশ্বের কাতারে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে কাজ করবে সরকার৷ পাশাপাশি সরকার সংশ্লিষ্ট নেতারা বলছেন, প্রস্তাবিত বাজেট করোনার কবল থেকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের এক ভারসাম্যপূর্ণ বাজেট। প্রস্তাবিত বাজেটটি বিদ্যমান সংকটকে সম্ভাবনায় রূপ দেয়ার এক বাস্তবসম্মত দলিল। এই বাজেট করোনার ঝুঁকিতে পড়া মানুষকে বাঁচানোর বাজেট। আর সরকার সমালোচকরা বলছেন, বিশাল বাজেটের বিশাল বরাদ্দ দেখে মনে হচ্ছে করোনাভাইরাস বাংলাদেশ থেকে বিদায় নিয়েছে। করোনা যেন এখন অতীতের বিষয়। বাজেটে সম্পদ আহরণ এবং সম্পদ ব্যয়ের যে চিত্র প্রকাশিত হয়েছে তাতে মনে হয় করোনায় বিশ্ব অর্থনীতি বিপর্যস্ত হলেও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তার কোনো ছোঁয়া লাগেনি।
এদিকে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ- সিপিডি’র পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, প্রস্তাবিত বাজেট করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলার ক্ষেত্রে বাস্তবসম্মত বাজেট নয়, এটি প্রচলিত বাজেট। এই বাজেটে করোনা পরিস্থিতি উত্তরণে দিকনির্দেশনার ঘাটতি রয়েছে। তবে সবকিছুর ওপর আসে সাধারণ জনগণের সেবার কথা। বাজেটে বরাদ্দ যাই থাকুক না কেন সেটি দিয়ে সাধারণ মানুষের দুয়ারে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানো যাচ্ছে কি-না, বা সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য সেবার মৌলিক চাহিদা পূরণ হচ্ছে কি-না, সেটাই দেখার বিষয়। আর এই বিষয়ের পুরো সাফল্যটাই নির্ভর করে কীভাবে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে তার ওপর। বিশেষ করে করোনা মহামারিকালীন জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য বাজেটের বরাদ্দকৃত অর্থের সঠিক কো-অর্ডিনেশনের ব্যাপারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে এই অর্থ সঠিক উপায়ে কাজে লাগানোর ব্যাপারে কিছু প্রস্তাবনা রাখা যেতে পারে-
প্রস্তাবনা-
১. স্বাস্থ্য খাতে বাজেটের পূর্ণ বাস্তবায়নের প্রধান বাধা হচ্ছে এ খাতের নীতিনির্ধারকদের সক্ষমতার অভাব। এই কারণে যারা মাঠপর্যায়ে কাজ করেন তাদেরকে নীতিনির্ধারক হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। বিশেষ করে স্বাস্থ্য বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।
২. স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নের জন্য যেসব গবেষণা করা প্রয়োজন তার জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে। সে গবেষণাগুলোর ফলাফল কার্যকর কি-না, তা পরীক্ষা করে দেখার জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে বিভিন্ন পাইলট প্রকল্প পরিচালনা করতে হবে। এসব প্রকল্পের সফলতার ওপর ভিত্তি করে বৃহৎ পরিসরে জাতীয় পর্যায়ে গবেষণার ফলাফল প্রয়োগ এবং বাস্তবায়ন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাজেটের স্বাস্থ্য খাতের জন্য যে বরাদ্দ আছে তার পূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
৩. বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থ প্রয়োগ করার জন্য পর্যাপ্ত সময় ও সুযোগ প্রয়োজন। নয়তো যথেষ্ট বরাদ্দ থাকলেও সময়মতো সে অর্থ প্রয়োজনীয় খাতে ব্যবহার করা যাবে না। বাজেটের বরাদ্দকৃত অর্থ সঠিকভাবে কাজে লাগানোর জন্য দুটি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রথমত, বাজেট পাশের আগে পরিপূর্ণ পরিকল্পনা করে রাখতে হবে যে, স্বাস্থ্য খাতের কোন প্রকল্পে কত টাকা প্রয়োজন হবে এবং সেটি কোন উপায়ে ব্যয় করা হবে। বাজেট পাশের আগে থেকেই যদি সঠিক পরিকল্পনা করে রাখা যায় তাহলে পরবর্তীতে বরাদ্দের টাকা ব্যয়ের ব্যাপারে দ্রুত কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব।
দ্বিতীয় পদক্ষেপ হচ্ছে, বাজেট পাশের পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে বরাদ্দকৃত অর্থ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা, যাতে পরবর্তী বাজেট আসার আগেই বর্তমান বাজেটের অর্থ সংশ্লিষ্ট খাতে সঠিকভাবে ব্যয় করা যায়।
৪. বাজেট বাস্তবায়ন না হওয়ার আরও একটি প্রধান কারণ হচ্ছে দুর্নীতি। প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যত দেরি করা যাবে তত দুর্নীতি করার সুযোগ থাকে। শেষ সময়ে বাজেটের টাকা তাড়াহুড়ো করে খরচ করতে গিয়ে বিরাট অংকের অর্থ লোপাট হয়ে যায়। তাই সরকারের উচিত সবার আগে দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। বরাদ্দকৃত অর্থের সম্পূর্ণ হিসাব আদায় করতে হবে। দুর্নীতি ধরা পড়লেই কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
৫. বরাদ্দকৃত সম্পদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন, বেতন ও ভাতার জন্য যায়। তাই বাজেট বরাদ্দ থেকে রোগীদের জন্য প্রকৃত উপকারিতাও অনেক কম থাকে। স্বাস্থ্য বাজেটের অপব্যবহারের প্রচলিত একটি উৎস হলো সরঞ্জামাদি সংগ্রহ বা প্রকিউরমেন্ট এবং অবকাঠামো নির্মাণের জন্য বাজেট। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য খাতের পেশাদারেরা চিকিৎসা সরঞ্জাম কীভাবে সংগ্রহ করা হয়, কারা চুক্তি পায়, সরঞ্জামগুলোর জন্য কী ধরনের বা কীভাবে মূল্য নির্ধারণ করা হয় এবং কত সম্পদ নষ্ট হয়, তা আরও ভালোভাবে জানেন। যেসব চিকিৎসক অনিয়মের বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করেন, তাদের প্রায়ই শাস্তি হিসেবে বদলি করার ব্যবস্থা নেয়া হয়। তাই সম্পদ ব্যবহারের দক্ষতা নিশ্চিত করতে সম্পদের অপচয় হ্রাস করতে হবে এবং বাজেট পরিচালনা এবং ব্যবস্থাপনার উন্নতি সাধন করতে হবে। গত পাঁচ বছরের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সব সংগ্রহ পদ্ধতির ওপর একটি নিরীক্ষা করলে ভালো ধারণা পাওয়া যাবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সরকারি সম্পদের জবাবদিহির সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার জন্য এই মহৎ প্রক্রিয়াটি শুরু করতে পারে। দুর্নীতির এই দুষ্ট চক্রটি ধ্বংস করা না গেলে এবং স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার ক্ষেত্রে জবাবদিহির ব্যবস্থা করা না গেলে স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি তেমনটা আশা করা যায় না।
৬. করোনাকালীন সাধারণ মানুষের জন্য পর্যাপ্ত ওষুধ সুলভ মূল্যে সরবরাহের জন্য সরকারকে প্রয়োজনে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। মানুষ যেন ওষুধের অপর্যাপ্ততায় না ভোগে। কারণ করোনা এমন এক মহামারি যেটি মোকাবিলা করার জন্য বিশ্বের সব দেশ তাদের নাগরিকদের জন্য সর্বোচ্চ পর্যায়ের সেবা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করছে। আমাদের জনগণকে করোনা থেকে বাঁচাতে যা যা উদ্যোগ নেয়া দরকার সব করতে হবে। দরকার হলে অন্য খাতে (যেটির বর্তমানে খুব বেশি আবশ্যকতা নেই) বরাদ্দ কমিয়ে প্রয়োজনীয় খাতগুলোর বরাদ্দের পরিমাণ বাড়াতে হবে।
৭. বাজেটে সাধারণ নাগরিকদের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণে বাধা হয় অথবা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয় এমন কোনো শর্ত রাখা যাবে না। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য জনগণের ক্রয়সীমার আওতাধীন রাখতে হবে। প্রয়োজনে করোনা মহামারিকালীন ত্রাণ কার্যক্রম দীর্ঘায়িত করতে হবে।
৮. করোনা চিকিৎসার সাথে সম্পর্কিত সকল স্বাস্থ্যকর্মীর প্রয়োজনীয় সকল সুরক্ষাসামগ্রী সরকারের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করতে হবে। সেইসঙ্গে যারা প্রয়োজনীয় সুরক্ষাসামগ্রী পাওয়ার পরও চিকিৎসা দিতে অনীহা প্রকাশ করছে তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। সুরক্ষাসামগ্রীর অব্যবস্থাপনা ও অপব্যবহার রোধ করতে হবে।
৯. চিকিৎসক প্রতি নার্স এবং টেকনোলজিস্টের অনুপাতের ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্য নার্স ও টেকনোলজিস্ট পদের সংখ্যা বাড়াতে হবে। দক্ষ নার্স ও টেকনোলজিস্ট গড়ে তোলার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। এসব পদ বাড়ানোর জন্য বাজেটের অব্যবহৃত বরাদ্দ ব্যবহার করতে হবে। দেশের প্রতিটি মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করে বের হওয়া ডাক্তারদের প্র্যাকটিসের জন্য সুযোগ বাড়াতে হবে। যোগ্য চিকিৎসকদের সার্ভিসের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। শুধু শহর অঞ্চলে ডাক্তারদের সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না বরং গ্রাম ও মফস্বল অঞ্চলগুলোতে ডাক্তারদের প্রেরণ করতে হবে। ডাক্তারদের থাকার আবাসস্থলসহ সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
১০. করোনার ভ্যাকসিন বা ওষুধ নিজেদের দেশীয় কোম্পানিগুলো যাতে প্রস্তুত করতে আগ্রহী হয় সেজন্য সরকার তাদের আর্থিক সহয়তা দিতে পারে। এসব ভ্যাকসিন সরকার এসব কোম্পানির সাথে আলোচনার মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে কিনে জনগণকে দিতে পারে। এতে করে ওষুধ কোম্পানি, সরকার এবং জনগণ সবার জন্যই একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হবে। যদিও বাজেটে করোনার জন্য বরাদ্দকৃত ১০ হাজার কোটি টাকা করোনার ভ্যাকসিনসহ আরও অন্য সকল সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য ব্যয় করা হবে বলে বলা হচ্ছে। কিন্তু এই অর্থ দুর্নীতিবিহীন সঠিক উপায়ে ব্যয় করতে হবে। করোনার ওষুধ ছাড়াও অন্যান্য রোগের ওষুধও সাধারণ জনগণের ক্রয়সীমার মধ্যে আনতে হবে। সিন্ডিকেট করে যারা ওষুধের দাম বাড়ানোর সাথে জড়িত তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
১১. সবশেষে বৈদেশিক সাহায্য হিসাবে যে অর্থ আমরা পাব সেগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে খরচ করতে হবে। যে খাতগুলোতে বেশি বরাদ্দ দরকার সেুগলোতে এই অর্থ ব্যবহার করা যেতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্ব সহকারে এটি নিশ্চিত করতে হবে যেন করোনাকালীন মানুষের স্বাস্থ্যসেবার কোনো ত্রুটি না হয়। সকল ওষুধ থেকে শুরু করে করোনা মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে সরকারকে উদার মনোভাব প্রকাশ করতে হবে। আমাদের অনেক সম্ভবনা রয়েছে। এই সম্ভাবনাগুলো আমাদের কাজে লাগাতে হবে। তাহলেই আমরা করোনা মহামারি কাটিয়ে উঠে স্বাস্থ্যসমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারব।
লেখক : প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, এমিনেন্স, বাংলাদেশ; গবেষণা সহকারী আজিজুল হক
আরও পড়ুন >> কোভিড-১৯ দুর্যোগকালীন বাংলাদেশে খাদ্য ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা
এমএআর/এমএস