বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা
ঐতিহাসিক ২৩ জুন আজ। বাংলার ইতিহাসে এই দিনে দুটি ঘটনা ঘটেছিল। এর একটি হলো ১৭৫৭ সালে এ দেশীয় কয়েকজন বিশ্বাসঘাতকের কারণে বাংলার স্বাধীনতার সূর্যই কেবল অস্তমিতই হয়ে যায়নি, অসাম্প্রদায়িক বাঙালি মানসে সাম্প্রদায়িতকতার বীজ বুননের প্রচেষ্টাও শুরু হয়ে গিয়েছিল। এর ঠিক ১৯২ বছর পর ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন স্বাধীনতার অস্তমিত সূর্যকে আবারও ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে সাম্প্রদায়িক সামাজিক কাঠামোকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়ে অসাম্প্রদায়িক কাঠামোর পুনর্বিন্যাসের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
যার মূল কারিগর ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি নিজে অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী ছিলেন বলেই আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করতে পেরেছিলেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আমি মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিস্টান বলে কিছু নাই। সকলেই মানুষ।’ এই সত্যকে ধারণ করেই আওয়ামী লীগ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে গেছে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দেশের ঐতিহ্যবাহী এবং বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল। এই রাজনৈতিক দলটির গোড়াপত্তন হয় ২৩ জুন ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। ১৯৫৫ সালে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আদর্শের অধিকতর প্রতিফলন ঘটানোর জন্য এর নাম ‘আওয়ামী লীগ’ করা হয়। ১৯৭০ সাল থেকে এর নির্বাচনী প্রতীক নৌকা।
সৃষ্টিলগ্ন থেকে অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদের যে ঝাণ্ডা উড়িয়ে এসেছে এই দলটি, শত ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময় পেরিয়েও সেই ঝাণ্ডাকে সমুন্নত রাখতে সক্ষম হয়েছে। দলটি অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দেশকে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তির দেশে পরিণত করার চেষ্টাকে কেবল রুখেই দেয়নি, অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সংবিধানকেও সমুন্নত রাখতে সক্ষম হয়েছে।
১৯৭২ সালে সংবিধান যখন রচিত হয়, সেই সংবিধানের যে চারটি মৌলিক স্তম্ভ ছিল, তার একটি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। বঙ্গবন্ধু যেখানেই যেতেন, তিনি এটির অর্থ যে ধর্মহীনতা নয়, তা বারবার উল্লেখ করতেন। তিনি বলতেন, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে যার যার ধর্ম সে সে পালন করবে। ধর্ম থেকে রাষ্ট্র পৃথক থাকবে। তিনি একটি আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছেন চিরকাল।
যে আওয়ামী লীগ শুরু হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের নাম দিয়ে, অচিরেই সে নাম থেকে মুসলিম শব্দটি উঠিয়ে দিয়েছিলেন; যাতে তার চরিত্র ধর্মনিরপেক্ষ হয়। একই কথা ছাত্রলীগের ক্ষেত্রেও। তবে স্বাধীনতার পরপরই যারা বাংলাদেশ চায়নি, যারা বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে, যারা ধর্মের নামে গণহত্যা করেছে, তারা সেই ধর্মকেই আবার ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে। যারা এই চেষ্টা করেছে, তাদের মধ্যে যেমন ছিল ধর্মান্ধ গোষ্ঠী, তেমন ছিল অতি বিপ্লবী বামপন্থীরা।
১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের বার্ষিক অধিবেশনে প্রধান অতিথির ভাষণ দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন- ‘বিপ্লবের (স্বাধীনতা) পর সংবাদপত্র যে স্বাধীনতা পেয়েছে, তা এ দেশে কখনো ছিল না... আপনারা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেন। আমিও বলি। কিন্তু কোনো কোনো খবরের কাগজে এমন কথাও লেখা হয় যে, সাম্প্রদায়িকতা চরমে। অথচ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে চব্বিশটি বছর প্রগতিশীল সাংবাদিকরা সংগ্রাম করেছেন। কোনো কোনো কাগজে লেখা হয়েছে, মুসলমানকে রক্ষা করার জন্য সংঘবদ্ধ হও।’
১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতেই দেশ বিভাগ হয়। কিন্তু তারপরও একটি কথা সত্য যে, সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ কখনোই বাঙালির মূলচেতনা ও ভাবধারাকে আচ্ছন্ন করতে পারেনি, যা পশ্চিম পাকিস্তানিদের মনোপীড়নের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই তারা পূর্ব বাংলার মানুষের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন-শোষনের স্টিমরোলার চালানো শুরু করে। আঘাত হানে বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর। মুসলিম লীগবিরোধী কোনো কথা বললেই ‘শির কুচাল দেঙে’ কথাটা উচ্চারিত হওয়া শুরু হয়। এই কারণে বাঙালির মনে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির অল্প দিন পর হতেই ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে। আর সেই সঙ্গে নবজাত পাকিস্তানের জায়মান অবস্থা থেকেই পাকিস্তান মুসলিম লীগের এক ধরনের ভঙ্গুর সূচনা পরিলক্ষিত হয়।
বঙ্গবন্ধুসহ মুসলিম লীগের কতিপয় প্রগতিশীল তরুণ সদস্য ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অর্থাৎ দেশ বিভাগের মাসখানের পরই ‘গণতান্ত্রিক যুবলীগ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বলেন, ‘আমি বললাম, এর (গণতান্ত্রিক যুবলীগের) কর্মসূচি হবে সাম্প্রদায়িক মিলনের চেষ্টা করা, যাতে কোনো দাঙ্গা-হাঙ্গামা না হয়, হিন্দুরা দেশ ত্যাগ না করে- যাকে ইংরেজিতে বলে ‘কমিউনাল হারমনি’, তার জন্য চেষ্টা করা। অনেকেই এই মত সমর্থন করল...।’
এই গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠনই ছিল পূর্বানুসৃত সাম্প্রদায়িক ধারার রাজনীতির স্থলে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতি প্রবর্তনের পথপ্রদর্শক। সাতচল্লিশের ডিসেম্বরে মুসলিম লীগের করাচি অধিবেশনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী অসাম্প্রদায়িক জাতীয় দলের পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেছিলেন। ১৯৪৯ সালের গোড়ার দিকে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের আন্তঃদলীয় দ্বন্দ্ব চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। একদিকে কট্টর মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি, আরেকদিকে অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী তরুণ গোষ্ঠী। ওই বছরের জুন মাসে অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী তরুণ গোষ্ঠী ঢাকার টিকাটুলীর কেএম দাশ লেনের রোজ গার্ডেন হলরুমে আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে দুই দিনব্যাপী সম্মেলনের আয়োজন করে। সেখানে শামসুল হক কর্তৃক লিখিত মূল দাবি নামক পুস্তিকায় পাকিস্তান রাষ্ট্র্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাদের দাবি ও প্রত্যাশার কথা তুলে ধরা হয়।
ওই সম্মেলনের প্রথম দিনে অর্থাৎ ২৩ জুন তারা পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করে, যা ছিল পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা তথা সকল ধর্মের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি এবং সমাজতন্ত্র তথা শোষণমুক্ত সমাজ ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এই দলটির মূলনীতি।
তিনশ প্রতিনিধি নিয়ে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে মওলানা ভাসানীকে সভাপতি ও শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক করে চল্লিশ সদস্যবিশিষ্ট অর্গানাইজিং কমিটি গঠন করা হয়। তৎকালীন সংগ্রামী যুবনেতা শেখ মুজিব কারাগারে থেকেই মাত্র ঊনত্রিশ বছর বয়সে দলের প্রথম যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। সেদিন এই দলটির প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই বাঙালির ভবিষ্যৎ স্বপ্নের জাল বোনা শুরু হয়েছিল।
ওই বছরের ২৭ জুলাই বঙ্গবন্ধু জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ক্রমান্বয়ে আওয়ামী লীগের অন্যতম সংগঠকে পরিণত হন। সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক অসুস্থ হওয়ার পর তিনি ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে দলকে নিয়ে যেতে থাকেন অনন্য উচ্চতায়। ‘আওয়ামী’ শব্দের অর্থ জনগণ। আওয়ামী লীগ জনগণের লীগ তথা দল হিসেবে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ দেশের মানুষের ভাত ও ভোটের অধিকার, ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকার, ধর্ম পালনের অধিকার এবং শোষণ-বঞ্চনা ও বৈষম্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শুরু করে দেয়।
আপৎকালীন উত্তীর্ণ হলে ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে নিজেদের অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্য জাতির সামনে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে দলটি।
এর পরের বছর শাসনতন্ত্রে পাকিস্তানকে ‘ইসলামিক রিপাবলিক’ ঘোষণা করা হলে এর তীব্র বিরোধিতা করে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান শাসনতান্ত্রিক পরিষদে তার ভাষণে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান শুধু মুসলমানদের জন্য সৃষ্টি হয়নি।’ তার এই ভাষণের মধ্য দিয়ে তার এবং আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্য আবারও প্রমাণিত হয়ে যায়। মহান মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা সেখানেও অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদ ছিল মুখ্য একটি বিষয়।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর এই রাষ্ট্রের ভিত্তি ধর্মভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।’ ওই বছরের ১২ অক্টোবর খসড়া সংবিধান প্রসঙ্গে জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে ৭ কোটি মানুষের ধর্ম-কর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করবও না। ২৫ বছর ধর্মের নামে জুয়াচুরি, শোষণ, বেইমানি, খুন, ব্যভিচার এই বাংলাদেশের মাটিতে চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না।’
বাংলাদেশ সরকার প্রণীত সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে মূলনীতি হিসেবে ধরা হয়, যার মাধ্যেমে বিশ্বে দরবারে বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এ ক্ষেত্রে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ভূমিকা অনন্য অসাধারণ। এই দলের নেতাকর্মীরা অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী বলেই তাদের পক্ষে অসাম্প্রদায়িকতা রাষ্ট্র গঠনের কাজকে এগিয়ে নেয়া সহজ হয়েছে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ববাংলার প্রধান রাজনৈতিক দল এবং বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির একক নেতা হয়ে উঠলেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল তার নামেই এবং বাঙালি আর কখনও এতো ঐক্যবদ্ধ হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের পর ধ্বংসস্তূপ থেকে একটি দেশকে পুনর্গঠন করে এবং মাত্র নয় মাসের মধ্যে একটি সংবিধান উপহার দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও শোষণমুক্ত-উন্নত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ভিত্তিভূমিটাই নির্মাণ করে দিয়েছে।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ৭১ বছর ধরে আওয়ামী লীগ সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনের মাধ্যমে সমাজ-রাজনীতির প্রগতিশীল রূপান্তরে অবদান রেখে চলেছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দেশের অন্যতম পুরোনো, অসাম্প্রদায়িক, সর্ববৃহৎ ও বাঙালির জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই দলের নেতৃত্ব দেন এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের গড়ার কাজ প্রথম শুরু করেন।
আওয়ামী লীগ শুধু দেশের পুরোনো ও সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলই নয়, এটি গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শের মূলধারাও। প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই নানা আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ আমাদের সমাজ-রাজনীতির এ ধারাকে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে এগিয়ে নিচ্ছে।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতি সব সময় সহজ সরল পথে চলেনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশকে পুরোনো পাকিস্তানের ধারায় চালিয়েছে সামরিক শাসকরা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশকে একটি পাকিস্তানপন্থী ভাবধারার দেশে পরিণত করেছিলেন। তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল এবং পাকিস্তানের দোসর যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করেছিলেন। দেশে শুরু হয় ধর্মভিত্তিক রাজনীতি। ইসলামকে করা হয় রাষ্ট্রধর্ম। ধর্মের নামে চলে হানাহানি। দেশে হয় জঙ্গিবাদের উত্থান।
সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত ও পুনর্বাসিত করার পাশাপাশি জিয়া ও তার অনুসারীরা এবং স্বৈরাচার এরশাদ কর্তৃক সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানি স্টাইলের পদক্ষেপ গ্রহণ করার কারণে শোকাহত বাঙালির জাতীয়তাবাদ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথার ওপর একে একে আঘাত করা হয়। বাংলাদেশেও বিগত শাসকশ্রেণি রাষ্ট্রীয়ভাবে সাম্প্রদায়িকতাকে উৎসাহিত করার কারণে ‘ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠভুক্ত’ এক শ্রেণির মানুষ ‘ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের’ উপর নিপীড়ন, নির্যাতন, হামলা, ধর্ষণ, লুটপাট, অপপ্রচার প্রভৃতি অপকর্মে লিপ্ত ছিল। আর এইসব সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় গোঁড়ামিযুক্ত বিষবাষ্পের কারণেই আজ দেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছিল।
সাম্প্রদায়িকতার আগ্রাসী ধারাবাহিকতায় নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পর ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীসহ তাদের উপাসনালয় এবং অন্যান্য স্থাপনায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়। ২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনের আগে ও পরে সমগ্র সারাদেশব্যাপী জামায়াত-বিএনপি জোটের সহিংসতায় বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, লুটপাট শুরু হয়। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে পাকিস্তানপন্থী স্বাধীনতাবিরোধী নিজামী-মোজাহিদদের দোসর সরকারের আমলে সমগ্র বাংলাদেশ ছিল জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতির অভয়ারণ্য। ২০০৪ সালের ১৭ আগস্ট সমগ্র বাংলাদেশের ৫০০ স্থানে একযোগে গ্রেনেড হামলা, রমনা বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে হামলা হয়।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউ আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে প্রকাশ্য জনসভায় দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলা পরিচালিত হয়। দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা কোনো রকমে প্রাণে বেঁচে গেলেও বর্বরোচিত এই হামলায় আইভি রহমানসহ ২৩ জন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী নিহত এবং অসংখ্য আহত হন।
বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য উত্তরাধিকারী দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের গৃহীত অসাম্প্রদায়িক নীতি-আদর্শ ও অবস্থান সংখ্যালঘুদের কাছে গ্রহণযোগ্য- যা এখনো এই দলের প্রতি তাদের সমর্থনের মূল কারণ। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় নিজের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন, সরকার জাতি ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব ধর্মের মানুষের কল্যাণে কাজ করছে। তিনি বলেন, জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল এমন এক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা যেখানে সব ধর্মের মানুষের সমান অধিকার থাকবে। তার নীতি অনুসরণ করেই আমরা সকলের জন্য কাজ করছি। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যেখানে সব ধর্মের মানুষ সমান অধিকার ভোগ করছে এবং আপনারা সবাই সমান অধিকার নিয়েই বসবাস করবেন।
‘সব ধর্মের মানুষকে সরকার সমান চোখে দেখে’ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের উন্নয়ন কর্মসূচি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য, সকলের কল্যাণেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।' বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদাহারণ টেনে তিনি বলেন, এই বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলে সমান অধিকার নিয়ে বসবাস করবে, সমান সুযোগ নিয়ে বসবাস করবে। আমরা সেই নীতিতে বিশ্বাস করি।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও মুসলমানদের উপর হামলার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, দেশে সব ধর্মের মানুষ সমান অধিকার নিয়ে বসবাস করবে।
এরশাদের আমলে ১৯৯০ সালে এবং ১৯৯২ সালে খালেদা জিয়ার আমলে বাবরি মসজিদ ভাঙার গুজবে বাঙলার হিন্দুদের ওপর নেমে এসেছিল এক ভয়ংকর বিভীষিকা। তার আগে জিয়াউর রহমান দেশের স্বাধীনতা বিরোধী জামাতকে ধর্মীয় রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করেছিলেন। ফলে স্বাধীনতা বিরোধীরা আবার দেশের সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের সুযোগ যায়। আর ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত নির্বাচনে জয়ী হলে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন শুরু হয়। খালেদা জিয়ার পুরো ২০০১-০৬ শাসনামলে চলে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংখ্যালঘু নির্যাতন। জামায়াত-শিবির, বিএনপির সন্ত্রাসীরা বাড়িঘর পোড়ানো, নারী-পুরুষ-শিশুদের শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন, নারী নির্যাতন, নিপীড়ন এসবকেই নিয়মিত উৎসবে ব্যাপারে পরিণত করেছিল। আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার নাকের ডগায় এসব ঘটনা ঘটলেও কেউ কোন প্রতিকারে এগিয়ে আসেনি।
শেখ হাসিনার টানা তিনবারের শাসনামলে দেশের সংখ্যালঘুরা এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে সবচেয়ে নিরাপদে আছে। বাঙলার হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলমান-খ্রিস্টান মিলেমিশে একসাথে থাকার যে প্রাচীন প্রচলন ছিল সেই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশই মানুষ দেখছে এখন। অনন্য মেধা, প্রজ্ঞা, সততা, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে এগিয়ে চলছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
লেখক : বার্তা সম্পাদক, স্বদেশ প্রতিদিন; যুগ্ম সম্পাদক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)।
এইচআর/বিএ/এমএস