যুগধর্ম ও প্রাণধর্ম সঙ্গী করেই ৭১ পেরিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আজ বয়সের হিসাবে একাত্তর পেরিয়ে চলল। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ুও এখন একাত্তরের বেশি। তবু একাত্তর বছর বয়স মানেই প্রবীণত্বের স্মারক। আবার এও ঠিক যে, বয়সটা আসলে কিছু গাণিতিক সংখ্যা মাত্র। মানুষের প্রাণধর্মটাই আসল। সে হিসেবে আমরা নিজেদের যেমন সর্বদা তরুণ ভেবে আনন্দ পাই তেমনি সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগও প্রাণধর্মের প্রেরণায় তরুণ- তরুণই নয় বরং এই একাত্তর বছর বয়সে নানা অভিজ্ঞতার আলোয় দলটি হয়ে উঠেছে নির্দিষ্ট লক্ষ্যপূরণে উদ্যমী, তেজোদীপ্ত, দূরদৃষ্টি সম্পন্ন, স্বপ্নবাদী এবং কর্মঠ।
আমরা যে প্রাণধর্মের কথা বলছি সেটা আসলে সময়োপযোগিতা। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে যুগধর্মকেই প্রাণধর্মরূপে মেনে নিয়েছে। আর এই সহজ মেনে নেয়ার মধ্য দিয়েই একাত্তর পেরিয়েও আজ তার মধ্যে তারুণ্যের দীপ্তি, কর্মের চাঞ্চল্য, স্বপ্নের অভিলাষ। চ্যালেঞ্জ গ্রহণে উৎসুক এবং বাস্তবায়নে সক্ষম।
আওয়ামী লীগ যুগধর্মকেই প্রাণধর্ম মানে বলেই সাম্প্রতিককালে ‘ডিজিটাল’ শব্দটিকে কেবল ‘তথ্যপ্রাযুক্তিক পরিভাষা’র বদলে গ্রহণ করেছে ‘দার্শনিক অভিপ্রায়’ হিসেবেও। তাই নব্যকালের প্রাযুক্তিক চেতনানির্ভর তরুণদের নিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অভিযাত্রা হয়ে উঠেছে অদম্য। কোনো যুগকে ভালোরূপে উপলব্ধি করা, যুগের ভেতরকার মানসিকতাকে মর্মের দ্বারা উপলব্ধি করা সকল সংগঠনের পক্ষে সহজ নয়।
এই যুগধর্ম ও প্রাণধর্মের আকাঙ্ক্ষা উপলব্ধি না করার কারণেই উপমহাদেশের অনেক রাজনৈতিক সংগঠন বিলুপ্ত হয়ে গেছে কিংবা কোনো কোনোটি এখনো নাম-সর্বস্বরূপে ইতিহাসের অংশ হয়ে টিকে আছে মাত্র! যার পক্ষে যুগধর্ম আয়ত্ত সম্ভব তার দ্বারাই নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব। বিগত একাত্তর বছরের ইতিহাসের আলোকে আওয়ামী লীগের অভীষ্ট সম্পর্কে নিসন্দিগ্ধ হতে চাই- হতে পারিও।
আজ ২৩ জুন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একাত্তরতম জন্মদিন। জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাই বাংলাদেশের গৌরবময় ইতিহাস ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনন্য দ্যোতনায় ভাস্বর হয়ে উঠুক সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীর অন্তরে।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। তার প্রায় দুইশ বছর পর ঠিক সেই দিনটিতে অর্থাৎ ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন গড়ে ওঠে একটি রাজনৈতিক দল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। উদ্দেশ্য পলাশীর প্রান্তরে হারানো স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেমের নেতৃত্বাধীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একটি অংশের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ওই দিন ঢাকার টিকাটুলির কেএম দাস লেনে অবস্থিত রোজ গার্ডেন প্যালেসে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রতিষ্ঠাকালে দলটির সভাপতি ছিলেন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শামসুল হক। পরবর্তীকালে ১৯৫৫ সালে মাওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা চর্চা এবং প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগঠনের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে দলের নতুন নাম করা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’। আমরা যে যুগধর্ম ও প্রাণধর্মের কথা শুরুতে বলেছিলাম তা যে আওয়ামী লীগের ইতিহাস ও ঐতিহ্যেরই অংশ প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত তার ধারাবাহিক চর্চা অব্যাহত আছে দেখে মানুষ আশ্বস্ত হয়। সাধারণ মানুষের এই আস্থা ও ভরসার ওপরেই আওয়ামী লীগের অতীতে দীর্ঘ ইতিহাস- ভবিষ্যতে এগিয়ে যাওয়া। আওয়ামী এগিয়ে যাচ্ছে- এদেশের মানুষের স্বপ্ন, উন্নতি ও মুক্তির অভিলাষকে সঙ্গী করে।
আওয়ামী লীগ গঠনের পশ্চাতে মুসলিম লীগের দায়িত্বহীনতা ও জবাবদিহিতার অভাব দায়ী ছিল। দায়ী ছিল মুসলিম লীগের একনায়কোচিত মনোভাবও। ১৯৪৯ সালে টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে মুসলিম লীগের পরাজয়ও আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠায় প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের ঘটনায় জেলখানায়। নতুন দল গঠনে তিনিও তাঁর মতামত জানিয়ে বলে দিয়েছিলেন, ‘আর মুসলিম লীগের পিছনে ঘুরে লাভ নাই, এ প্রতিষ্ঠান এখন গণবিচ্ছিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এরা আমাদের মুসলিম লীগে নিতে চাইলেও যাওয়া উচিৎ হবে না। কারণ এরা কোটারি করে ফেলেছে। একে আর জনগণের প্রতিষ্ঠান বল চলে না। এদের কোনো কর্মপন্থাও নাই।’ [অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ১২০]
এছাড়াও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্র রাজনীতির পরিবর্তে মূলধারার রাজনীতিতে যুক্ত হতে চান মর্মে বার্তা পাঠালে নবগঠিত ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগে’ তাঁকে যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক পদ দেয়া হয় এবং তাঁর নামের পাশে ‘নিরাপত্তা বন্দি’ শব্দটি লেখা থাকে। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লেখেন, ‘আমি মনে করেছিলাম, পাকিস্তান হয়ে গেছে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দরকার নাই। একটা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হবে, যার একটা সুষ্ঠু ম্যানিফেস্টো থাকবে। ভাবলাম, সময় এখনও আসে নাই, তাই যারা বাইরে আছেন তারা চিন্তভাবনা করেই করেছেন।’ [অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ১২১]
তাঁর এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট উপলব্ধি করা যায় তিনি সম্মেলনস্থলে উপস্থিত থাকলে সংগঠনের অসাম্প্রদায়িক নামকরণের বিষয়টি উত্থাপন করতেন। যাই হোক, আমরা ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় ১৯৫৫ সালে এসে শেখ মুজিবুর রহমানের সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিজয় লক্ষ করি। এ বছরের ২১ থেকে ২৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠান থেকে আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত অথাৎ যুগধর্ম ও প্রাণধর্মের সাঙ্গীকরণ ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিতে বড় ধরনের অগ্রগতি।
‘রূপমহল’ সিনেমা হলে সম্মেলনের সমাপ্তি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এখানে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে কমিটি গঠিত হয়। এরপর বাংলাদেশ ও আওয়ামী লীগের ইতিহাস এক ও অভিন্ন স্রোতধারায় মিশে যায়। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৬৬, ১৯৭০ এবং ১৯৭২ সালের কমিটিতে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন।
সমগ্র রাজনৈতিক জীবনের সাধনায় অসাম্প্রদায়িক চেতনানির্ভর এবং সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে একটি অগ্রগামী রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগকে বঙ্গবন্ধুই নিয়ে গিয়েছেন একেবারে খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষের কাছে, নিয়ে গেছেন কৃষক, শ্রমিক, কুলি, মজুর ছাত্র, জনতার কাছে। তাদের মনের ভেতর তাদেরই ভাগ্যের মুক্তির স্বপ্নবীজ বপন করেছেন। তাদের চোখে আঙুল দিয়ে, বুকে বল দিয়ে, মাথায় চেতনার স্ফূরণ ঘটিয়ে জাগিয়ে তুলেছেন। মেহনতি মানুষের এই জাগরণ থেকেই বাঙালির সৌভাগ্যের সূর্য উদিত হয়। আত্মমর্যাদা সম্পন্ন একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে বাঙালি তার আত্মপরিচয় পুনর্ব্যক্ত করে তোলে অপার গৌরবে। বাঙালির এই জাগরণের পশ্চাতে আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরব অস্তিত্বই ইতিহাস অনুভব করে।
সহস্রবর্ষের আরেক শ্রেষ্ঠ বাঙালি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘অভ্যুদয়’ কবিতায় জাতির মুক্তির পরিত্রাণকর্তাকে আবাহন করেছিলেন এইভাবে :
‘কোন্ অলক্ষিত পথে আসিতেছে অর্ঘ্যভার!/
আকাশে ধ্বনিছে বারংবার/
‘মুখ তোলো, আবরণ খোলো/
হে বিজয়ী, হে নির্ভীক, হে মহাপথিক/
তোমার চরণক্ষেপ পথে পথে দিকে দিকে/
মুক্তির সংকেতচিহ্ন যাক লিখে লিখে।’
আমাদের মনে হয় কবির উপলব্ধ সেই ‘মহাপথিক’ পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের মধ্যে উজ্জ্বলরূপে প্রকাশিত হয়ে উঠেছিল।
আওয়ামী লীগের অগ্রযাত্রা ও উজ্জ্বল সাফল্য ম্লান করার চেষ্টাও কম দেখিনি। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর মতো আওয়ামী লীগকেও বাংলার ইতিহাস থেকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলবার সশস্ত্র প্রচেষ্টা দেখেছি। কিন্তু এই সংগঠনটির মধ্যে বাঙালি তার প্রাণধর্ম অনুভব করে বলে জাতীয় যুগচেতনা ও যুগধর্মকে সঙ্গী করে আওয়ামী লীগের নৌকায় নির্ভয়-নির্দ্ধিধায় উঠে পড়ে। তাই ষড়যন্ত্রকারীদের মুখে ছাই দিয়ে ব্যাপক মানুষকে সঙ্গী করে আওয়ামী লীগ এগিয়ে চলেছে, তার এই এগিয়ে চলার পশ্চাতেই ইতিহাসকে গুনতে হয়েছে ৭১ বছর!
বর্তমানে আওয়ামী লীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনাই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দীর্ঘতম সময়ের সভাপতি। তিনি ১৯৮১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত ৩৯ বছর যাবৎ দলটির নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। চারবারের মধ্যে বর্তমানে টানা তৃতীয় মেয়াদের প্রধানমন্ত্রী তিনি। তাঁর লক্ষ্য ২০৪০ সালে বাংলাদেশকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করা। আওয়ামী লীগের শততমবর্ষ অর্থাৎ ২০৪৯ সালের আগেই- ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার ঘোষণা দিয়েছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। আমরা বিগত ১২ বছরে দেশের নানা ক্ষেত্রে বিচিত্র উন্নয়নের সম্ভাবনা দেখছি- শুধু সম্ভাবনাই নয়- কোনো কোনো স্তরে আমাদের সাফল্য প্রায় চূড়ান্তেও উন্নীত হয়ে গেছে।
এসব সম্ভব হয়েছে জননেত্রীর স্বপ্ন ও কর্মযজ্ঞের দূরদৃষ্টি সম্পন্ন পদক্ষেপের কল্যাণে। আবারও রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ- আমাদের মনে হয় যেন শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করেই তিনি ‘আকাশপ্রদীপ’ কবিতার শুরু করেছিলেন এইভাবে : ‘অন্ধকারের সিন্ধুতীরের একলাটি ওই মেয়ে/ আলোর নৌকা ভাসিয়ে দিল আকাশপানে চেয়ে।’
বলাবাহুল্য, জননেত্রী শেখ হাসিনার উন্নতরাষ্ট্রের স্বপ্ন-অভিলাষ সমকালীন মানসচেতনাকে ঘিরেই আবর্তিত। শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের অন্তর্গত প্রেরণায় যুগধর্ম ও প্রাণধর্ম সক্রিয় ও সজীব আছে বলেই দলটি আজ ঐতিহ্যবাহী সংগঠনে পরিণত। এর অতীত যেমন দীর্ঘ ভবিষ্যৎও তেমনি সুদূর প্রসারিত। জয় হোক আওয়ামী লীগের। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/বিএ/জেআইএম