বাবা যেন এক বিশাল ছায়াদানকারী বটবৃক্ষ
আজ বাবা দিবস। বাবা কিংবা মা দিবসকে ঘিরে কেউ কেউ বাবা-মায়ের প্রতি বিশেষ দিনটিতে যত্নবান হই আমরা। এই দিনে বাবা-মাকে ভালো খাবার আর উপহার-উপঢৌকন দিয়ে, ফেসবুকে ছবি পোস্ট করে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে দিবসটি পালন করে থাকি। বাবা-মাকে সেবা করতে কোনো বিশেষ দিবসের প্রয়োজন হয় না। দিনক্ষণ নির্ধারণ করে কি বাবা-মায়ের সেবা হয়? আসলে বাবা কিংবা মা দিবস পালনের একটা বিশেষ অর্থ আছে। প্রতিবছর জুনের তৃতীয় রোববার বাবা দিবস পালন হচ্ছে দুনিয়াজুড়ে। বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানদের বেশি যত্নবান হতে শেখানোর জন্যই দিবসটি পালন হয়ে আসছে যুগযুগ ধরে।
গত বছরের বাবা দিবসের কথা বলছি। অফিস থেকে বাসায় ফিরে যেতেই আমার দুই সন্তানের একটু বেশি যত্ন আত্তি দেখে অবাক হলাম। কেক, ফুলের তোড়া, আর নতুন জামা হাতে ধরিয়ে দিল ওরা। যদিও তারা সবসময় আমার প্রতি একটু বেশিই যত্নবান। দিবসকে ঘিরে তাদের পিতার প্রতি যত্নের বাড়াবাড়ি দেখে আমার ডাক্তার ছেলেটার প্রতি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম- বাবারা কেবল বাবা দিবসেই যত্নের বাড়াবাড়ি নয়? দিনক্ষণ গুনে বাবা-মায়ের ভালোবাসা হয় না। তাদের বোঝানোর চেষ্টা করলাম বাবা কিংবা মা দিবসে বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানদের কেবল বেশি বেশি শ্রদ্ধাশীল হতে শেখানো হয়। এ দিবসটিতে বাবা-মাকে বেশি যত্ন নিতে হবে আর শ্রদ্ধা করতে হবে এর কোনো অর্থ নেই।
প্রতিটি দিন তাদের জন্য দিবসে; আর একজন সন্তানকে বাবা-মায়ের প্রতি সমান শ্রদ্ধাশীল হতে হবে সবসময়। বাবা-মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা কেবল দিবস ঘিরে বাক্সবন্দি হয়ে থাকলেই চলবে না। হালে অনেক বখে যাওয়া সন্তানই বাবা-মাকে অবহেলার দৃষ্টিতে দেখেন। যে বাবা-মা রাতদিন খেয়ে না খেয়ে ঘুম হারাম করে সন্তানদের লালন পালন করলেন সে বাবা-মায়ের প্রতি অনেক সন্তানের অবহেলাই এখন হরহামেশা চোখে পড়ে। বখে যাওয়া নয় অনেক উচ্চশিক্ষিত সন্তানরাও বাবা-মায়ের প্রতি অবজ্ঞা করে চলেছেন অবলীলায়। আর জন্যই আজ এই মানবিক দেশটাতেও বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠেছে।
বাবা দিবস আর আমার বাবাকে নিয়ে লিখবা না তা কি হয়? আমার বাবার আলহাজ মীর তাজউদ্দিন আহম্মেদ। যিনি দেশ স্বাধীন করতে যুদ্ধে অংশ নিয়ে ছিলেন। দেশকে আজও প্রচণ্ড রকমে ভালোবাসেন। আমার দৃষ্টিতে আমার বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ ও আদর্শ ব্যক্তি। তিনি যেন এক বিরাট ছায়াদানকারী বটবৃক্ষ। শুধু তার সন্তানদের জন্য নয়, সকলের জন্য। একটা মানুষ কত বেশি নীতিবান, নিঃস্বার্থ, ধৈর্যশীল এবং উদার হতে পারে তা আমার বাবাকে দেখলেই বোঝা যায়। সেই ছোটকাল থেকেই যে বাবাকে দেখে আসছি আজ এই বয়সেও তিনি তেমনি আছেন, নীতি ও কর্তব্যে অটল। যেখানে আমরা কামনা করি আমার সন্তান থাকুক দুধে-ভাতে, সেখানে আমার বাবা কামনা করেন তার সন্তান থাকেন যেন ন্যায়-নীতিতে।
তিনি অবসরপ্রাপ্ত সরকারি পদস্থ কর্মকর্তা। তার কাছে কর্মই জীবন। তাই ৮১ বছর বয়সেও তার বসে থাকার ফুসরত নেই। এ বয়সেও কেন এত কাজ করেন এমন প্রশ্ন বাবাকে করলে বাবা বলেন, “কাজ না করে খেলে খাবার হালাল হয় না”। বাবা তাঁর ছাদ বাগানটাতে দিনের অনেকটা সময় পার করেন। বাবাকে কখনও অন্যায়ের সাথে আপস করতে দেখিনি। পারিবারিক বা সামাজিক যেকোনো আদালতে তার বিচার ছিল নিরপেক্ষ। সত্যের ব্যাপারে কাউকেই পরোয়া করেন না। কখনও স্নেহের প্রচণ্ড শীতল হাওয়া তার ন্যায় বিচারের শিক্ষাকে নেভানো বা অন্যদিকে প্রবাহিত করতে পারেনি।
তার দৃষ্টি সবার ওপর মানুষ সত্য। তাকে দেখেছি তার অফিসের কেরানি-পিয়নকেও সম্মান দেখাতে। তিনি নিজের এবং তার সন্তানের স্বার্থ অপেক্ষা অন্যের স্বার্থকে বড় করে দেখতেন। নিজের ক্ষতি ও ত্যাগ স্বীকার করেও অন্যের মঙ্গলের জন্য কাজ করেছেন। আমার বাবাকে এখনও অন্যায় করতে দেখিনি। মিথ্যা বলতে শুনিনি। আমাদের তিনি সে শিক্ষাই দিয়েছেন। এমন একজন নিঃস্বার্থ, নির্লোভ এবং ন্যায়বিচারক বাবার সন্তান হয়ে আমরা গর্ববোধ করি। আমার বাবার স্নেহের ছায়ায় আমরা সিক্ত। তিনি ছাড়া আমাদের জীবন অন্ধকার। আমরা এ আলো হারাতে চাই না। তিনি যেন থাকেন আমাদের মাঝে আজীবন।
আমার বাবার স্নেহ আমাদের কাছে স্বর্গের মতো সুখকর। একটা শিশু যখন পৃথিবীতে আসে তখন তাকে একে একে কত কিছুই না চেনাতে হয়। মাথার ওপরের নীল আকাশ, ঐ যে দূরের গাছ, গাছের ওপর চড়ুই এমনি কত কী। কিন্তু তাকে কখনও শেখাতে হয় না, এটা তোমার মা আর ওটা বাবা। বরং প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই শিশু চিনে নেয় তার পরম নির্ভরতার এই জায়গাগুলো। কিন্তু পরিণত জীবনে পৌঁছে সন্তানের কাছে অনেক সময় বাবার শ্রমে ঘামে চিনে নেয়া পৃথিবীটাতে বড় হয়ে ওঠে নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছায়। কিন্তু সন্তানের জীবনে সাফল্যের পরিমাণ যত অগণিতই হোক না কেন, বাবার কাছ থেকে, বাবার ভালোবাসার ছায়া থেকে কিন্তু সে কখনও দূরে সরে যেতে পারে না।
আবারও বাবা প্রসঙ্গে ফিরে এলাম। সন্তান যত বড়ই হোক, তার অভিমান আর অবহেলার গুণীতক যতই বিশাল হোক বাবার স্নেহের দরজাটা সবসময়ই খোলা থাকে তার সন্তানের জন্য। আর তাই বাবাকে যারা বেছে নিতে পারেন বন্ধু হিসেবে তারা জীবনের প্রতিটি পরতেই পান সংগ্রামের ভিন্ন এক রসদ। যে বয়সে স্কুল-কলেজে নতুন নতুন বন্ধুর সাথে বেশ জমে উঠছে সে সময়টাতে ভুলে যাওয়া চলবে না পুরোনো বন্ধুকে। বরং নিজের জীবনের এই খোলস ছাড়াবার মুহূর্তে যদি বাবাকেও সাথী হিসেবে নেয়া যায় তাহলে বরং চেনা বন্ধুত্বগুলোও নতুন রঙে রঙ্গিন হয়ে ওঠে।
অফিসের ব্যস্ততা আর ঝামেলার মাত্রাটা যতই সীমা ছাড়িয়ে যাক না কেন বাড়িতে ফিরে বাবার সাথে কয়েক মুহূর্তের জন্য হলেও বসতে হবে গল্পের ঝুঁড়ি নিয়ে। তাহলেই দেখবেন কোথায় যেন দিব্যি মিলিয়ে যাবে আপনার চিন্তা-দুশ্চিন্তা। মনে রাখবেন আপনার-আমার, আমাদের বাবা কিন্তু আমাদের কাছে বড় কোনো উপহার চান না। বরং ব্যস্ততার মাঝে বের করে নেয়া একটু সময় বাবাকে দিয়েই দেখুন না কেন। এমন কোনো বাবা নেই যিনি সন্তানের এই সান্নিধ্যটুকু উপভোগ করেন না। আর বাবা যদি হন নিঃসঙ্গ তবে তো সন্তানের পাশে এক মুহূর্ত বসে থাকাটা তার কাছে হয়ে দাঁড়ায় তাজমহল দেখবার চাইতেও বড় এক প্রাপ্তি।
শৈশবে বাবার কাঁধে চড়েনি এমন সন্তান খুঁজে পাওয়া ভার। বাবা নামের সাথে যুক্ত আছে পরম নির্ভরতার এক গল্প। এ দিকে মা শব্দটির সাথে মধুরতা লেগে থাকলেও বাবা শব্দটির মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় পরম নির্ভরতা। বাবা যেন প্রত্যেকটি সন্তানের ওপর প্রশান্তির একটা ছায়া ফেলে রাখেন সবসময়। খ্যাতিমান বাবার কোনো পুত্র যদি যোগ্য উত্তরসূরী হন তবে সবাই যেমন বলে বাপের বেটা, তেমনি কোনো বাবার কন্যা যখন তার মুখ উজ্জ্বল করে তখন বাবা মায়ের সঙ্গে গর্ব করে বলেন, দেখতে হবে না মেয়েটি কার। আমাদের সমাজে একটি সংসারের কর্তৃত্ব সাধারণত বাবার হাতেই থাকে।
আমাদের সমাজে আর যাপিত জীবনে বাবার ভূমিকাটাকে হয়তো কখনই অত বড় করে দেখার সুযোগ হয় না আমাদের। আর তাই বাবার ক্লান্তি, শ্রম আর ভালোবাসাটাকে যেন কখনও কখনও বাবার দায়িত্ব বলেই উপেক্ষা করতে চাই আমরা। কিন্তু জীবনসংগ্রামে ক্লান্ত হয়ে পড়া আমাদের বাবা যে সময়টায় সামান্য একটু নির্ভরতা খোঁজেন আমাদের মাঝে তখন তাকে উপেক্ষা করা কি সন্তানের সাজে? যে বাবা সন্তানের মঙ্গল কামনা ছাড়া অন্য কিছু কখনও প্রত্যাশা করেন না সেই বাবাকে নিজের ব্যক্তিজীবনে বাড়তি কৈফিয়তের স্থান হিসেবে ভাবাটাও কি যৌক্তিক হয়? হয়তো হয় না। তবু একা একা ছুটে চলা এই সময়ের মাঝে এই অমার্জনীয় ভুলকেই যেন আমরা অনায়াসে স্থান করে দেই আমাদের মাঝে।
আমরা সত্যিই অকৃতজ্ঞ এবং হতভ্যাগ্য সন্তান। ভুলে যাই বাবার অপত্য স্নেহের মাঝে বেড়ে ওঠা আমাদের শৈশব আর কৈশোরের দিনগুলোকেও। ব্যস্ত শহরে ঠাঁস মানুষের ভিড়ে আমাদের সব আবেগ অনুভূতিই ইদানীং বড় বেশি যান্ত্রিক। কিন্তু তাই বলে বাবাকেও কি মনে করতে হবে বিশেষ একটা দিবসের কথা ভেবে? জানি কোনো সন্তানই এতে একমত হবে না। তবু ব্যস্ততা আর অনবধানতা যখন বাবার সাথে তৈরি করে অদৃশ্য এক দূরত্ব তখন বিশেষ করে ভাবতে হয় অনেক কিছুই।
এখন পুরো বিশ্বজুড়েই জুন মাসের তৃতীয় রোববার পালিত হয়ে আসছে বাবা দিবস। হয়তো অনেকেই ভাবছেন, এ দিন খুব চমৎকার একটা উপহার দিয়ে বাবাকে চমকে দেবেন। হ্যাঁ সামর্থ্যের সীমা অনুযায়ী এমন একটা কিছু আপনি দিতেই পারেন। কিন্তু এতসব উপহারের চাইতেও যে বিষয়টি সবচেয়ে জরুরি সেটা হলো বাবার জন্য সবসময় একান্ত করে কিছু সময় বের করে নেয়া। তার সাথে মেতে ওঠা অনর্গল কোনো কথোপকথনে। কাজের চাপ কিংবা ব্যস্ততা যতই থাকুক না কেন প্রতিদিন কিছুটা হলেও সময় বরাদ্দ রাখুন মা এবং বাবার জন্য।
বাবাকে বুঝতে শিখুন, তার শাসনকে ভুল না বুঝে জীবন চলার নির্দেশনা হিসেবে বিবেচনা করুন। কাছে না থাকলেও প্রতিদিন একটি বারের জন্য হলেও ফোন দিন। তার খোঁজখবর নিন। বাবাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করুন। প্রিয় মুহূর্ত আর প্রিয় স্থানগুলোতে চেষ্টা করুন বাবাকেও সঙ্গে রাখবার। কেবল বাবা দিবসকে ঘিরেই যেন বাবার প্রতি কর্তব্যবোধ জাগ্রত না হয়; এ প্রত্যাশা সকল সন্তানের প্রতি।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/বিএ/পিআর