বই পড়তেই হবে
নভেল করোনাভাইরাসের ধাক্কা লেগেছে বই বাজারে, প্রকাশনা শিল্পে। এর মধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে রাজধানীর কাঁটাবনে অবস্থিত ক্যাফে বুকশপ ‘দীপনপুর’। সাহিত্য ও সংস্কৃতিপ্রেমীদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় এই বুক ক্যাফেটি তিন বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে আর্থিক লোকসানের মধ্যেই ছিল। করোনা যেভাবে সব ব্যবসা-বাণিজ্যে আঘাত করেছে, তাতে এই প্রতিষ্ঠানটি আর পারেনি নিজের অস্তিত্ব জিইয়ে রাখতে।
২০১৭ সালে প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনের ৪৫তম জন্মদিনে যাত্রা শুরু করেছিল দীপনপুর। ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে উগ্রবাদীদের হামলায় নিহত হন প্রকাশক দীপন। দীপনের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী ডা. রাজিয়া রহমান জলি এগিয়ে আসেন স্বামীর স্বপ্ন বাস্তবায়নে। জাগৃতির হাল ধরেন তিনি, পাশাপাশি দীপনের স্মৃতি ও চেতনাকে ধরে রাখতে প্রতিষ্ঠা করেন ভিন্নধর্মী বুকশপ ক্যাফে ‘দীপনপুর’।
বন্ধ ঘোষণার সময় এর উদ্যোক্তারা অত্যন্ত বেদনার সাথে জানালেন, বইয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ খুবই কম। তিন বছর ধরেই লোকসানের মুখে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। আর করোনার তিন মাসে তো পুরোপুরিই লোকসান গুনতে হয়েছে। শুনছি একই পথে হাঁটছে দীপনপুরের পাশেই থাকা কবিতা ক্যাফে।
প্রকাশকরা বলছেন, করোনার হানায় বিধ্বস্ত প্রকাশনা শিল্প। বড়রা কোনোভাবে ঠিক থাকলেও ছোট প্রকাশকদের অস্তিত্ব বিলীনের পথে। প্রকাশকরা, বিশেষ করে ছোট প্রকাশকরা তাদের যন্ত্রণার কথা বলছেন। অনেকের চোখে জল। গত এপ্রিল মাসে প্রধানমন্ত্রী বরাবর এক আবেদন করেছে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি মাজহারুল ইসলাম।
সমিতি তাদের সদস্য ও এর সাথে জড়িত কর্মীদের প্রায় দুই লাখ পরিবারের জন্য স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি তিনটি স্তরে অনুদান ও প্রণোদনার কথা বলেছে। স্বল্পমেয়াদি অনুদান হিসেবে ১০০ কোটি টাকার আর্থিক অনুদান প্রদান, মধ্যমেয়াদি প্রস্তাবনায় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত সরকারি প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ৫০০ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল ঘোষণা এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় ২০২১ সালের একুশে বইমেলায় স্টল ভাড়া কমানো, বঙ্গবন্ধু লাইব্রেরি, পাঠাগার বা লাইব্রেরিতে স্থাপিত বঙ্গবন্ধু কর্নারে বই ক্রয়ের নিমিত্তে আরও ৫০০ কোটি টাকার বই ক্রয়ের একটি প্রস্তাবনা দিয়েছে সমিতি।
প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি এলে বাংলা একাডেমি ও প্রকাশকদের যৌথ উদ্যোগে অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজন হয় মাসব্যাপী। উদ্বোধন করেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। বলা হয় এটি বাঙালির প্রাণের মেলা। অত্যন্ত সীমিত কর্মসংস্থানের এই দেশে একটু সৃজনশীল, একটু আলোকিত তরুণরা চেষ্টা করে এই ব্যবসার সাথে জড়িয়ে নিজের মতো করে বাঁচতে। তাই প্রতিবছর নতুন নতুন লেখক এই বই যেমন মেলায় আসেন, তেমনি আসেন নতুন নতুন প্রকাশকও। ব্যবসাও যে খুব মন্দ তা বলা যাবে না। তবে করোনার আঘাতে এখন বিপর্যস্ত বই প্রকাশনা শিল্প। নোট বই, গাইড বই এই সংকটের আঘাতে তেমনটা না পড়লেও, জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশনা শিল্প পড়েছে অস্তিত্ব সংকটে।
দীপনপুর বন্ধ হয়ে গেল। জাগৃতি প্রকাশনী টিকে থাকার লড়াই করছে। হয়তো আরও অনেক প্রকাশনা শিল্প হারিয়ে যাবে। প্রতিবছর বইমেলা এলে বই আর প্রকাশনা নিয়ে যে উচ্ছ্বাস দেখি, তার সাথে বাস্তবতার মিল পাওয়া যায় না। শাহবাগের বুকে আজিজ মার্কেটের শুরু থেকেই পরিচয় ছিল বই বাজার হিসেবে। সেই মার্কেটে নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল সাহিত্যপ্রেমীদের, সংস্কৃতিসেবীদের। খুব অল্প সময়ই বই বাজার হিসেবে টিকে থাকতে পারল আজিজ মার্কেট। এখন মার্কেটের প্রতিতলায় মিষ্টি আর কাপড়ের দোকান।
করোনাকে সঙ্গে নিয়ে তিন মাসের বেশি সময় পেরিয়ে চতুর্থ মাসে পড়েছি আমরা। কিন্তু ভাইরাসের লাল চোখ আরও রক্তিম হচ্ছে। কবে যাবে সেই আশায় আছে মানুষ। কিন্তু এর মধ্যেই করোনায় আক্রান্ত হয়ে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে ফিরে এসে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ দিয়েছেন এক ভয়ংকর বাণী। বলেছেন, সহসা যাচ্ছে না করোনা, থাকবে আরও দুই থেকে তিন বছর।
এই এক বার্তা নতুন করে মানুষকে অনিশ্চয়তায় ফেলেছে। আর কেউ নয় স্বয়ং স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক, যিনি আছেন চালকের আসনে, তার মুখ থেকে এমন ভয়ের বাণী উচ্চারিত হওয়ার পর মানুষ অর্থ খরচে আরও হিসাবী হয়ে উঠবে। মনে রাখা দরকার মানুষ সবসময় তার প্রয়োজনীয় জিনিসটা আগে কিনবে। সেই প্রয়োজন মিটলে পরে তারা সাহিত্য আর সংস্কৃতির কথা ভাববে, বইয়ের প্রতি আকর্ষণ বাড়াবে। আমরা ভালো করেই জানি সাহিত্য ও সংস্কৃতির বাহক বইকে তথাকথিত অত্যাবশ্যকীয় পণ্য হিসেবে দেখার রেওয়াজ নেই বাঙালির সমাজে।
করোনার অভিঘাতে প্রকাশনা শিল্পের আর্থিক ক্ষতি সামলানো কঠিন। প্রকাশনা শিল্পের এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতেই হবে। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন করোনার সংক্রমণ ঠেকানো। আমাদের মানুষ যে পরিশ্রমী, রোগের বিস্তার ঠেকাতে পারলে তারা প্রণোদনা ছাড়াই জীবনকে সহজেই চঞ্চল করে তুলবে। তখন আবার বই পড়ার উদ্যম আসবে।
অনলাইনে সিনেমা, নাটক দেখার মতো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বই পড়াও বাড়বে। কিন্তু তবুও হাতে বই নিয়ে পড়ার আনন্দ অন্যরকম। বইয়ের ঘ্রাণ, বইয়ের পাতা, বইয়ের অক্ষরমালা আমাদের প্রাণবন্ত রাখে। বই যে পড়তেই হবে আমাদের।
এইচআর/বিএ/এমএস