করোনাকালের স্বাস্থ্য বাজেট
২০২০-২০২১ অর্থবছরের বাজেটে প্রায় ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার ব্যয় চূড়ান্ত করা হয়েছে। করোনার কারণে এবারের বাজেটে গুরুত্ব পাচ্ছে স্বাস্থ্য ও কৃষি খাত। তবে স্বাস্থ্য খাত যোগাযোগ বা পরিবহন খাতের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে না। এডিপিতে স্বাস্থ্য খাতে ১২ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এ হিসাবে আগামী অর্থবছরের এডিপিতে চলতি বছরের চেয়ে বরাদ্দ বাড়ছে ১ হাজার ৩৮৬ কোটি টাকা। অবশ্য করোনা মহামারির কারণে এবার স্বাস্থ্য খাতেই বেশি বরাদ্দ দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবায়নের সক্ষমতা না থাকায় শেষ পর্যন্ত তা দেয়া হয়নি। তবে স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন ব্যয় মিলিয়ে চলতি অর্থ বছরের চেয়ে ৫ হাজার ৭৭৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা বাড়িয়ে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২৫ হাজার ৭২৩ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। ফলে শীর্ষ বরাদ্দের ক্ষেত্রে ৫ম অবস্থানে উঠে এসেছে স্বাস্থ্য খাত।
এছাড়া স্বাস্থ্য বিভাগের অনুকূলে এই বরাদ্দের বাইরেও করোনাভাইরাসের যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় আরও ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। করোনাকালীন যেকোনো প্রয়োজনে এ বরাদ্দ থেকে ব্যয় করা যাবে। বিশেষ করে আগামী অর্থবছরে করোনা প্রতিরোধে ভ্যাকসিন বের হলে তা কেনার জন্য বড় বরাদ্দের প্রয়োজন হবে। করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নে ৩ ও ১০ বছর মেয়াদি ২টি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক ও বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় ইতোমধ্যে প্রায় ২,৫০০ কোটি টাকার ২ টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। নতুন স্বাস্থ্য বাজেটে গবেষণার জন্য ৩০০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য বাজেটের লক্ষ্য হচ্ছে স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা খাতে উন্নয়নের মাধ্যমে সবার জন্য সুলভ মানসম্মত স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা নিশ্চিত করে একটি সুস্থ, সবল ও কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা। প্রধান যে কার্যাবলির জন্য বাজেট বরাদ্দ করা হয় সেগুলো হচ্ছে- ১) স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সংক্রান্ত যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন ২) স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা প্রদান এবং জনগণের প্রত্যাশিত সেবার পরিধি সম্প্রসারণ ৩) স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সুবিধাসহ জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন এবং বিভিন্ন সংক্রামক ও অসংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধ ও প্রতিকার ৪) মানসম্পন্ন ওষুধ উৎপাদন ও বিতরণ এবং আমদানি ও রফতানিযোগ্য ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ ৫) জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, চিকিৎসাশিক্ষা, নার্সিংশিক্ষা, জাতীয় জনসংখ্যা ও স্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষণা ও প্রশিক্ষণবিষয়ক কার্যাবলি ৬) স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ সংক্রান্ত স্থাপনা, সেবা ইনস্টিটিউট ও কলেজ নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণ ও সম্প্রসারণ ৭) শিশু ও মাতৃ স্বাস্থ্যসেবা, সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি, বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি এবং পুষ্টি উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন ৮) স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সকল স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে সংযোগ স্থাপন সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়াদি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী একটি দেশে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জিডিপির কমপক্ষে ৫ শতাংশ এবং বাজেটের ১৫ শতাংশ হওয়া বাঞ্ছনীয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বর্তমানে মাথাপিছু ব্যয় মালদ্বীপে ২০০০ ডলার, শ্রীলঙ্কায় ৩৬৯ ডলার, ভারতে ২৬৭ ডলার , পাকিস্তানে ১২৯ ডলার এবং সর্বনিম্নে বাংলাদেশে ৮৮ ডলার। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য বাজেট বাস্তবায়নের প্রধান বিবেচনার বিষয়গুলো হচ্ছে- ১) টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এ বাজেট বরাদ্দ অপ্রতুল ২) বাজেট যাই থাকুক এর ব্যয় প্রক্রিয়া খুবই দুর্বল (Poor performance of utilisation) ৩) বাজেট ছাড় প্রক্রিয়া কখনও কখনও বিলম্বিত হওয়ার ফলে অর্থবছরের শেষ সময়ে তড়িঘড়ি করে অর্থ অপচয়ের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের পকেট থেকে চিকিৎসা খাতে খরচ হচ্ছে ৬৭ শতাংশ ফলে প্রতি বছর প্রায় চল্লিশ লাখ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। বিশ্বে গড়ে পকেট থেকে চিকিৎসা খরচের হার ৩২ শতাংশ। প্রতিবছর বর্ধিত বাজেটের একটি বড় অংশ কর্মচারীদের ইনক্রিমেন্টে চলে যায় এবং একটি অংশ স্বাভাবিক মূল্যস্ফীতিকে ভারসাম্য করে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় যুগোপযোগী নীতিমালা বাস্তবায়ন ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের প্রতিবন্ধকতাগুলো- ১) অপর্যাপ্ত বাজেট ২) দুর্নীতি ৩) বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ হ্রাস ৪) আর্থিক জবাবদিহিতার অভাব ৫) সময়োপযোগী উন্নয়ন পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন পদ্ধতির অভাব ৬) দক্ষ মানবসম্পদ স্বল্পতা- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী, প্রতি ১০,০০০ মানুষের জন্য প্রয়োজন ১০ জন চিকিৎসক এবং ৩০ জন নার্স। বর্তমানে বাংলাদেশে এর অবস্থান উল্টো, চিকিৎসক রয়েছে ৫.৫ জন এবং নার্স ২.১ জন। ৭) অপর্যাপ্ত ভৌতিক অবকাঠামো ৮) শহর গ্রাম পর্যায়ে সম্পদ বণ্টনের অসামঞ্জস্যতা ৯) ধনী-দরিদ্রের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় সুষম সুবিধাগ্রহণের সুযোগের অভাব।
৪৯ বছরের বাংলাদেশ নানা অস্থিরতার মধ্যে কেটেছে। লম্বা সময় সামরিক শাসন, হত্যা-ক্যু আর দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। যেকোনো মূল্যায়নেই বিবেচনায় রাখতে হবে দেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অবস্থান। এত প্রতিকূল পরিস্থিতির পরও স্বাস্থ্য খাতের বেশ কিছু অর্জন বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। বাংলাদেশ এখন নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ। বাস্তব সীমাবদ্ধতা রয়েছে অনেক। মাথাপিছু আয় প্রায় ২০০০ ডলার। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের বাস্তবিক সক্ষমতার স্তরের কোনো পরিমাপ নেই। সেখানে সক্ষমতার তুলনায় দেশের মানুষের স্বাস্থ্য চাহিদা আকাশচুম্বী- সে কারণে অসন্তুষ্টিই হচ্ছে বাস্তবতা।
উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, দক্ষিণ কোরিয়ার মাথাপিছু আয় ২৯,০০০ ডলার। উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এগোতে আরও সময় লাগবে- এটাই বাস্তবতা। অর্থসংকুলান সব কিছুর চালিকা শক্তি। সেক্ষেত্রে রাতারাতি বাংলাদেশের পক্ষে লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। বিশ্বে বাংলাদেশের যে অর্জনগুলো সমাদৃত হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ১) শিশু ও মাতৃ মৃত্যুর হার হ্রাস ২) টিকাদান কর্মসূচির ব্যাপক সফলতা ৩) কিছু কিছু সংক্রামক রোগ নির্মূল এবং অনেকগুলো নিয়ন্ত্রণে ৪) পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার সফলতা ৫) জীবনায়ু বৃদ্ধি।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্যবিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেটের গবেষণায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ ও মান সূচকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, ভুটান, নেপাল ও আফগানিস্তানের উপরে এবং শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের নিচে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার চতুর্থ (২০১৭-২০২২) স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা, পুষ্টিবিষয়ক উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে যা বাস্তবায়নাধীন আছে। ১ লাখ ১৫ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকার এই বিশাল বাজেটের প্রকল্পে বিশেষভাবে যে বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে -১) সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপে বাংলাদেশের ৫৯ শতাংশ রোগীর মৃত্যুর কারণ হচ্ছে সংক্রামক রোগ। ২) পুষ্টি ৩) খাদ্য নিরাপত্তা ৪) মানবসম্পদ উন্নয়ন।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রধান যে লক্ষ্যগুলো বিবেচনায় রাখতে হবে -১) পুষ্টিহীনতা ২) সংক্রামক ও অসংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধ ও প্রতিকার ৩) অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ ও ভ্যাকসিনের প্রাপ্যতা ও বিতরণ ৪) শিশু সুরক্ষা ও সুস্থ পরিবেশ ৫) রোগীদের চিকিৎসার জন্য পকেট খরচ হ্রাস করা ৬) সুস্থ জীবনযাপনের জন্য সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করা ৭) শহর গ্রাম, ধনী-গরিব চিকিৎসা সুবিধার বৈষম্য কমিয়ে সমানুপাতিক সুযোগ বৃদ্ধি ও উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ।
দুদক স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির ১১ উৎস চিহ্নিত করে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। দুর্নীতি প্রতিরোধ না করে বাজেট বাড়ালেও স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়ন হবে না। চিকিৎসা ক্ষেত্রের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মান প্রশ্নবিদ্ধ। ব্যাঙের ছাতার মতো মানহীন মেডিকেল কলেজ, নার্স ও টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউশন স্বাস্থ্য দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নে মারাত্মক দুর্বলতা সৃষ্টি করে চলেছে। এছাড়া শিক্ষক স্বল্পতা রয়েছে। বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য এখন অর্থ কোনো সমস্যা নয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেকোনো সমস্যা বা সংকটে বাজেটের বাইরেও প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান দিয়ে চলেছেন। অর্থের যথাযথ ব্যবহারের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে দুর্নীতি ও দুর্বল আর্থিক ব্যবস্থাপনা। দুঃখজনক যে, ভয়াবহ করোনাকালেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির অমানবিক খবর শুনতে হয়।
বাজেটের যথাযথ ব্যবহারের সুপারিশসমূহ
১) জনবান্ধব, চিকিৎসাবান্ধব আধুনিক ব্যবস্থাপনা পুনর্গঠন করতে হবে।
২) কঠোরভাবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
৩) কঠোরভাবে মেডিকেল কলেজ, নার্স ও টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউশনের মান নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
৪) দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন ও সমানুপাতিক হারে প্রয়োজনীয় চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্ট ও কর্মচারী নিয়োগ করতে হবে।
৫) প্রতিটি কর্মসূচির নিবিড় পর্যবেক্ষণ, মনিটরিং এবং ফলোআপের আধুনিক ব্যবস্থাপনা করতে হবে।
৬) আর্থিক ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
৭) স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, অধিদফতর, বিভিন্ন বিভাগের নিবিড় সমন্বয় থাকতে হবে, কাজের সুষ্ঠু বণ্টন ও স্বচ্ছতা থাকতে হবে।
৮) সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে ত্বরিৎ ব্যবস্থা নিতে হবে।
৯) প্রতিটি কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সফলতার ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে বাংলাদেশকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে (লক্ষ্যমাত্রা-৩: স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন নিশ্চিত করা ও সব বয়সের সবার কল্যাণে কাজ করা)। প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ করে তার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বিরাজমান বাজেট ও মানবসম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব। প্রয়োজন দেশপ্রেম, সদিচ্ছা, সততা আর দেশের মানুষের জন্য ভালোবাসা।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও প্যাথলজি বিশেষজ্ঞ।
এইচআর/বিএ/পিআর