চীন ছাড়তে ইচ্ছুকদের বিনিয়োগ কি বাংলাদেশে আসবে?
এম কে তৌফিক
কোভিড-১৯ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনেক বিনিয়োগকারীই ‘বিশ্বের কারখানা’ হিসেবে পরিচিত চীন ছাড়তে চাচ্ছে। অনেক দেশ চীন-নির্ভরতা কমিয়ে আনার লক্ষ্যে তাদের দেশীয় কোম্পানিগুলোর বিদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করছে। চীন ছাড়তে ইচ্ছুক বা চীনের প্রতি ক্ষুব্ধ দেশগুলোর সাথে অনেক দেশ যোগাযোগ করতে শুরু করেছে বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য। বাংলাদেশ কি পারবে এ পরিস্থিতির সুযোগ নিতে?
বিশ্বব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত সহজে ব্যবসাসূচক (২০২০) অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান ১৯০টি দেশের মধ্যে ১৬৮তম। প্রথমেই বলে রাখা উচিত যে, শুধুমাত্র সহজে ব্যবসা সূচকের ওপর ভিত্তি করে বিদেশি বিনিয়োগ আসে না। তবে একটি দেশের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার বেশ ভালো নির্দেশক এই সূচক।
বর্তমানে, দক্ষিণ এশিয়ার ৮টি দেশের মধ্যে এ সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান, শুধু আফগানিস্তানকে পেছনে ফেলে, ৭ম। নিম্ন মধ্যআয়ের ৪৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪২তম। ভারত (৪র্থ), ভিয়েতনাম (৭ম), ইন্দোনেশিয়া (৮ম), ফিলিপাইন (১৫তম) এবং পাকিস্তান (১৭তম) - এরা সবাই বাংলাদেশের অনেক উপরে অবস্থান করছে। অর্থাৎ, ভৌগোলিক অবস্থান বা আর্থিক সামর্থ্য, যে আয়না দিয়েই দেখা হোক না কেন, আমরা সুবিধাজনক অবস্থায় নেই।
বিনিয়োগকারীদের চীন ছাড়ার কারণ যতটা না অর্থনৈতিক তার চেয়ে বেশি ভূ-রাজনৈতিক। বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য স্থানীয় বাজারের আকৃতি ও সক্ষমতা, বৃহৎ বাজারের নৈকট্য, প্রয়োজনীয় উৎপাদনের উপাদানের সহজলভ্যতা এবং বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, নিরাপত্তা বড় ভূমিকা পালন করবে। উন্নত, বিনিয়োগকারী দেশগুলো চাইছে একদেশের ওপর নির্ভর না করে উৎপাদনস্থলের ভৌগোলিক-বৈচিত্র্য আনতে যা তাদের জাতীয় নিরাপত্তাকে সুদৃঢ় করবে।
তাছাড়া অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে চীনের উত্থানকে হুমকি মনে করেছে যেসব দেশ, সেগুলোতে চীনবিরোধী মনোভাব চাঙা ও জোরালো হয়েছে কোভিড-১৯ এর কারণে। কোভিড-১৯ জাতিরাষ্ট্রের ধারণাকে সামনে নিয়ে এসেছে এবং সব দেশেরই ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় তার প্রভাব থাকবে। নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং যুক্ত্রাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য যুদ্ধও নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে।
নিচের সারণিতে চীন, বাংলদেশ এবং চীন থেকে বিনিয়োগ সরে যেসব দেশে যাবার কথা শোনা যাচ্ছে বেশি, তাদের একটি তুলনামূলক চিত্র প্রদান করা হয়েছে। সারণির ৮টি দেশের মধ্য বাংলাদেশের অবস্থান সর্বনিম্ন। সারণিতে ৭ম দেশ ইন্দোনেশিয়া এবং ৮ম দেশ বাংলাদেশের মধ্যে জায়গা নিয়ে আছে ১০/২০টি নয়, ৯৫টি দেশ! সহজে ব্যবসাসূচকের ১০টি সহসূচক আছে। তার মধ্য সবকটিতে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে সম্ভাব্য বিনিয়োগ হারানো চীন এবং প্রতিদ্বন্দ্বী থাইল্যান্ড, তাইওয়ান ও মেক্সিকোর চেয়ে। ৯টি সহসূচকে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে ভারত, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার চেয়ে।
|
চীন |
বাংলাদেশ |
ভারত |
ভিয়েতনাম |
ইন্দোনেশিয়া |
থাইল্যান্ড |
তাইওয়ান |
মেক্সিকো |
ব্যবসা চালুকরণ |
৯৪.১ |
৮২.৪ |
৮১.৬ |
৮৫.১ |
৮১.২ |
৯২.৪ |
৯৪.৪ |
৮৬.১ |
নির্মাণ সংক্রান্ত অনুমোদন |
৭৭.৩ |
৬১ |
৭৮.৭ |
৭৯.৩ |
৬৬.৮ |
৭৭.৩ |
৮৭.১ |
৬৮.৮ |
বিদ্যুৎপ্রাপ্তি |
৯৫.৪ |
৩৪.৯ |
৮৯.৪ |
৮৮.২ |
৮৭.৩ |
৯৮.৭ |
৯৬.৩ |
৭১.১ |
সম্পত্তি নিবন্ধন |
৮১ |
২৯ |
৪৭.৬ |
৭১.১ |
৬০ |
৬৯.৫ |
৮৩.৯ |
৬০.২ |
ঋণ সুবিধা |
৬০ |
৪৫ |
৮০ |
৮০ |
৭০ |
৭০ |
৫০ |
৯০ |
সংখ্যালঘু বিনিয়োগকারীর সুরক্ষা |
৭২ |
৬০ |
৮০ |
৫৪ |
৭০ |
৮৬ |
৭৬ |
৬২ |
কর প্রদান |
৭০.১ |
৫৬.১ |
৬৭.৬ |
৬৯ |
৭৫.৮ |
৭৭.৭ |
৮৪.৩ |
৬৫.৮ |
সীমান্ত দিয়ে বাণিজ্য |
৮৬.৫ |
৩১.৮ |
৮২.৫ |
৭০.৮ |
৬৭.৫ |
৮৪.৬ |
৮৪.৯ |
৮২.১ |
চুক্তি কার্যকরীকরণ |
৮০.৯ |
২২.২ |
৪১.২ |
৬২.১ |
৪৯.৫ |
৬৭.৯ |
৭৫.১ |
৬৭ |
দেউলেপনার মীমাংসা |
৬২.১ |
২৮.১ |
৬২ |
৩৮ |
৬৮.১ |
৭৬.৮ |
৭৭.১ |
৭০.৩ |
সহজে ব্যবসাসূচক স্কোর |
৭৭.৯ |
৪৫ |
৭১ |
৬৯.৮ |
৬৯.৬ |
৮০.১ |
৮০.৯ |
৭২.৪ |
সহজে ব্যবসাসূচক অবস্থান |
৩১ |
১৬৮ |
৬৩ |
৭০ |
৭৩ |
২১ |
১৫ |
৬০ |
সারণি: সহজে ব্যবসাসূচক ও অন্তর্ভুক্ত সহসূচকসমূহের স্কোর অনুযায়ী বাংলাদেশ ও নির্বাচিত ৭ দেশের তুলনা। উৎস: সহজে ব্যবসাসূচক (বিশ্বব্যাংক, ২০২০)।
সহসূচকগুলোর প্রতিটিতে আলাদাভাবে এই ৮টি দেশের মধ্যে সবেচেয়ে সফল দেশের সাথে বাংলাদেশের তুলনা করলে দেখা যায়- ব্যবসা চালুকরণে তাইওয়ানে ৩টি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ১০ দিন লাগে। বাংলাদেশে ৯টি প্রক্রিয়া বিদ্যমান এবং তাতে সময় লাগে ১৯.৫ দিন। নির্মাণ সংক্রান্ত অনুমোদনে তাইওয়ানে ১০টি প্রক্রিয়ায় ৮২ দিন লাগে। বাংলাদেশের ১৫.৭৮ টি প্রক্রিয়া সময় নেয় ২৭৩.৫২ দিন। বিদ্যুৎপ্রাপ্তিতে থাইল্যান্ডে ২টি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়, সময় লাগে ৩০ দিন।
পক্ষান্তরে, বাংলাদেশে ৮.৫৬টি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়, সময় লাগে ১২৪.৪৬ দিন। সম্পত্তি নিবন্ধনে বাংলাদেশে ৮টি প্রক্রিয়ায় ২৭০.৮২ দিন লাগে। তাইওয়ানে আছে ৩টি প্রক্রিয়া এবং তারা সময় নেয় ৪ দিন। করের ক্ষেত্রে তাইওয়ানে বছরে ১১টি পেমেন্ট করতে হয় আর তাতে সময় লাগে ২২১ ঘণ্টা। বাংলাদেশে ৩৩টি পেমেন্টে বছরে সময় যায় ৪৩৫ ঘণ্টা। চীনে রফতানি এবং আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় দালিলিক সম্মত্তি পেতে যথাক্রমে ৮.৬২৫ ও ১২.৮ ঘণ্টা লাগে, বাংলাদেশে লাগে যথাক্রমে ১৪৭ ও ১৪৪ ঘণ্টা। চুক্তি কার্যকরীকরণে চীন সময় নেয় ৪৯৬.২৫ দিন আর আমরা নিই ১৪৪২ দিন।
দেউলিয়াপনার মীমাংসা করতে থাইল্যান্ড ১.৯ বছর সময় নেয়, আমরা নিই ৪ বছর। এখানে কেবল প্রক্রিয়ার সংখ্যা এবং তা সম্পন্ন করতে কত সময় লাগে, তার তুলনা করা হয়েছে বিধায় ঋণ সুবিধা এবং বিনিয়োগকারীর সুরক্ষা- এই দুটি সহসূচকের তুলনা করা সম্ভব হ্য়নি। তুলনাকৃত ৮টি সহসূচকের মধ্যে ৭টিতে গত ৫ বছরে বাংলাদেশ কোনো উন্নতি করতে পারেনি। যাহোক, প্রতিটি সহসূচকে সেরা স্কোর অর্জনকারী দেশের নীতি যদি বাংলাদেশ অনুসরণ করে, তাহলে বাংলাদেশের সহজে ব্যবসাসূচক স্কোর হবে ৮৬.৮৯ এবং অবস্থান হবে বিশ্বে ১ম!
ঈদের আগে শেষ কার্যদিবসে বাণিজ্যমন্ত্রী আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে বিনিয়োগ আকর্ষণের সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। তিনি ঈদের পর উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্স গঠনের কথা বলেন। রাষ্ট্রীয় অতীব গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরি কাজ ছুটির জন্য আটকে থাকা উচিত নয়। সবসময় মনে রাখতে হবে, এই মুহূর্তে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বীরা কী করছে আর আমরা কী করছি।
প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘মেইক ইন ইন্ডিয়া’ স্লোগান কার্যকর করার উদ্যোগ নিয়েছেন। অবকাঠামো, দেশি সরবরাহ শৃঙ্খল, অর্থায়ন, দক্ষতা উন্নয়ন, শুল্ক ব্যবস্থা ইত্যাদিতে দুর্বলতা আছে বিধায় নানা রকমের প্রণোদনার উল্লেখ করে ভারত বিনিয়োগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে। এপ্রিলে ভারত ১০০০ আমেরিকান কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করে চীন থেকে ভারতে কারখানা সরানোর অনুরোধ জানায় এবং নানা ধরনের প্রণোদনার ব্যাপারে অবহিত করে।
যুক্তরাষ্ট্রের ২৭টি কারখানা চীন থেকে ইন্দোনেশিয়ায় আসছে। ইন্দোনেশিয়া ইতোমধ্যে দ্রুততার সাথে সেন্ট্রাল জাভায় ৪ হাজার হেক্টর জমি তৈরি করছে। উচ্চ উৎপাদনশীলতাসম্পন্ন লোকবল, উত্তম অবকাঠামো, বৃহদায়তনের ভূমি, যথেষ্ট প্রণোদনা, সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এবং কোম্পানিগুলোর প্রধানদের সাথে আলোচনা করা- ইত্যাদি বিষয়গুলো ইন্দোনেশিয়াকে সফল করছে।
বর্তমান অবস্থায় দ্রুত নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে নতুন বিদেশি বিনিয়োগ সহায়ক নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। সরাসরি সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের কাছে বিনিয়োগ-ধরন অনুযায়ী তৈরি পৃথক ও নির্দিষ্ট নীতিমালা বা পদক্ষেপ পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। বাণিজ্য, পররাষ্ট্র ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহ, বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন, বাংলাদেশে বিদেশি রাষ্ট্রদূত, বিদেশে বাংলাদেশি দূতাবাস– সবাইকে কৌশলগতভাবে কাজে লাগাতে হবে। অর্থনৈতিক কূটনীতির জন্য এর চেয়ে ভালো সময় আর আসেনি।
বিনিয়োগ আকর্ষণে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার বা দক্ষতা উন্নয়নে অনীহা-ই আমাদের প্রধান অন্তরায়। গত কয়েক দশকে এই প্রথমবারের মতো বিশ্বের প্রধান বিনিয়োগকারী দেশগুলো সচেতনভাবে বিনিয়োগস্থলের বৈচিত্র্যকরণ করছে। এ সুযোগটা হাতছাড়া করলে আমরা দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হবো কারণ বিনিয়োগ বিনিয়োগ আনে। ট্রেন এবার স্টেশনে না থামাতে পারলে, অদূর ভবিষ্যতেও থামবে না।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, অর্থনীতি বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/বিএ/জেআইএম