লকডাউন এখন জরুরি নয়, বিলাসিতা হবে
চলতি জুনের শুরু থেকে লকডাউন শিথিল করায় লোকজন অফিস যাচ্ছে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বসছেন। সীমিত মাত্রার এই লকডাউনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার মতো পরিস্থিতি এখনও নেই। গণপরিবহনও চালু হয়েছে। সেই সঙ্গে কোভিড-১৯ পরীক্ষায় পাল্লা দিয়ে করোনা রোগী বাড়ছে। পরীক্ষার হারও বেড়েছে, রোগীও বাড়ছে। মৃত্যুও কমছে না। কোনোভাবেই বলা যাবে না যে বাংলাদেশে করোনার বিস্তার থেমেছে। সে কারণে সরকার লকডাউন কেন শিথিল করলো এই বিতর্ক শুরু হয়েছে।
কমপক্ষে আরও ১৫ দিন কঠিন লকডাউনের পরামর্শ দিচ্ছেন অনেকে। কিন্তু এই মুহূর্তে সরকারের লকডাউন তোলা ছাড়া কী করার আছে! লকডাউন আরও ১৫ দিন নয়, একমাস থাকলেও এই মহামারিকে বাংলাদেশ থামাতে পারবে এর কোনো গ্যারান্টি আছে? দুই মাসের লকডাউনে কত লোক পথে নেমেছে, কত লোক চাকরি হারা হয়েছে, কত লোক সামনে অন্ধকার দেখছে- সে হিসাব কি কেউ জানে? আমাদের কোনো পরিসংখ্যান আছে? নামে ডিজিটাল বাংলাদেশ- পরিসংখ্যান খুঁজতে যান, কোনো নাগরিকের বিস্তারিত জানতে চান- পাবেন না।
আমার জানার ইচ্ছে যারা এই পর্যন্ত মারা গেল তাদের আর্থসামাজিক অবস্থান কী? যারা আক্রান্ত হলো- তাদের শুধু বয়স নয়- সামাজিক অবস্থান কী? সামাজিক অবস্থানের কারণে যারা ওয়াসার কলের পানি সরাসরি খাচ্ছে আর যারা ফুটিয়ে খাচ্ছে বা কেনা পানি খাচ্ছে- তাদের রোগ প্রতিরোধ শক্তি কি একই রকম?
লকডাউনে যখন মানুষের নাভিশ্বাস তখন ভাড়া বাড়ছে গণপরিবহনের, সেবা কিন্তু একই আছে। গাদাগাদি বরং বেড়েছে। সরকারি চাকরিজীবীরা দুই ঘণ্টায় কাজ সারতে পারলে বাড়ি যেতে পারবেন বলা হয়েছে, বেতনেরও কোনো অনিশ্চয়তা নেই। বেসরকারি চাকরিজীবীদের অনেকে ঠিকমতো বেতন পাননি। পেলেও অর্ধেক। চাকরি বাঁচবে কিনা সেই চিন্তায় অস্থির। কিন্তু বাসাভাড়া গুনতে হচ্ছে আগের মতোই। সরকার অন্তত এখানে দৃষ্টি দিতে পারত। সন্তানের স্কুল নেই কিন্তু গুনতে হবে ফি- সেটা না হয় মানা যায়। কাঁচাবাজার- সে তো অনেক আগেই নিয়ন্ত্রণহীন। আয়ের সিংহভাগ দিয়ে দিতে হয় বাসাভাড়ায়। সেই বোঝাটা ইচ্ছে করলে সকরকার কমাতে পারত। দেখার যেন কোথাও কেউ নেই।
লালন বলেছিল সময় গেলে সাধন হবে না। সে সময় চলে গেছে। বিমানবন্দরকে অবাধ রেখে সারাদেশে রোগটি ছড়িয়ে যাওয়ার পর চেষ্টাতো কম হলো না। এখন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মরার চেয়ে মানুষ করোনা-ভীতি আর বিনা চিকিৎসায় মরছে বেশি। নন-কোভিড রোগীরা মারা যাচ্ছে আরও বেশি, আরও যন্ত্রণায়। আমাদের নজর দেয়া দরকার সেখানেও। সরকার শুরু থেকে করোনা বিস্তারে যারা দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন তাদের সাজা দেয়নি, এখনও দিচ্ছে না। জানুয়ারিতে সারা বিশ্ব জানলো করোনার কথা- আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রস্তুত আছি বলে ঘুমিয়ে ছিল কেন? মন্ত্রীর কাজ কী, সচিবের কাজ কী, স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রধানের কাজ কী? তারা কি তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন? সরকার প্রধানকে করোনা বিষয়ে সতর্ক করার দায়িত্ব ছিল যাদের তারা কেউই তা করেননি। করলে এই হাল হয় না।
আমার চোখে বাংলাদেশের মতো দেশ কিংবা ঢাকা, চট্টগ্রাম, করাচি, দিল্লি, মুম্বাই, লাগোস, কায়রো, জাকার্তা এবং সাও পাওলোর মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে লকডাউন অসম্ভব ব্যাপার। লকডাউন কর্মসূচি ইতোমধ্যে এসব স্থানে নিষ্ঠুর ও অকাজের হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ঘরে বসে থাকা এবং সামাজিক দূরত্বের আদেশ-নির্দেশ মানা এসব শহরের বাসিন্দাদের কাছে তামাশা। গরিব, উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের করোনা সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটকে আরও মারাত্মক সংকটের দিকে নিয়ে যাবে যদি লকডাউনকেই মহামারি মোকাবিলার একমাত্র ভরসা হিসেবে ধরে বসে থাকে।
মানুষ ক্ষুধার মুখোমুখি হচ্ছে, যদি তারা বাঁচার উপায় না পায়, জীবিকার জন্য কাজ না পায়, তবে করোনাভাইরাসের ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত তারা। এসব উন্নয়নশীল দেশের জন্য এরইমধ্যে পাওয়া কোভিড-অভিজ্ঞতাই তাদের পথ চলার সহায়। কোভিড-১৯ এর আঘাত আসার অনেক আগে থেকেই এই দেশগুলোর চিকিৎসাব্যবস্থা ভয়াবহ নাজুক ছিল। নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে এখন তারা অর্জন করেছে ভাইরাসটি মোকাবিলায় কী কী করতে হবে। সক্ষমতা বাড়িয়েছে হাসপাতালগুলোর। অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে ডাক্তার-রোগী উভয়ে। লকডাউন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ভয়াবহ প্রাণহানির হার কমাবে না, আবার জনসংখ্যাও কমবে না। শুধু বিশ্বের সবচেয়ে দুর্বল অর্থনীতিতে বিশ্ব মন্দার মানসিক চাপের প্রভাব ফেলবে।
করোনাভাইরাস দু-একটি দেশে নিয়ন্ত্রণে আসলেও সমগ্র বিশ্বে ক্রমবর্ধমান। ব্রিটেনের এক পত্রপত্রিকা ব্রাজিলকে বলেছে বিশ্বের কবরস্থান। ল্যাটিন আমেরিকা আক্রমণ ও মৃত্যু ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর চীনে প্রথম শুরু হওয়ার আগে বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রই করোনা সম্পর্কে কিছুই জানত না। তাই কেউ প্রস্তুত ছিল না। বাংলাদেশে ৩ জুন পর্যন্ত মোট আক্রান্ত হলো ৫৫,১৪০ জন, মৃত্যুর সংখ্যা ৭৪৬ জন। মোট ৫০টি পরীক্ষাগারে একদিনে মোট ১২, ৫১০টি নমুনা পরীক্ষা করে আক্রান্ত পাওয়া গেছে ২৬৯৫ জন, মারা গেছে ৩৭ জন। শনাক্তের তুলনায় দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতের হার ১ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
করোনা প্রতিরোধের উপায় হিসেবে সারাবিশ্ব চীনের অনুসৃত নীতি অনুসরণ করেছে। তাতে সারাবিশ্বে অর্থপ্রবাহ, পণ্যপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সবকিছু স্তব্ধ করে বিশ্বের ৭৮০ কোটি মানুষ তো দিনের পর দিন ঘরে বসে থাকতে পারে না। এখন বিশ্বের অনেক দেশ ধীরে ধীরে লকডাউন প্রত্যাহার করা শুরু করেছে। কোনো দেশের জন্যই দীর্ঘ পাঁচ মাসব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখা সহজ ব্যাপার নয়। বড় ধনী দেশ আমেরিকার জন্য যেমন বিব্রতকর, উন্নয়নশীল বাংলাদেশের জন্যও তাই। বাংলাদেশ লকডাউন শিথিল করার সিদ্ধান্ত গার্মেন্টস দিয়ে শুরু করেছিল। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম উৎস গার্মেন্টস। পোশাকশিল্পে তার প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ চীন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া যখন উৎপাদনে গেছে তখন বাংলাদেশের পক্ষে উৎপাদনে না গিয়ে উপায় ছিল না। না হয় বাজার হারাতে হবে।
এখানে একটা কথা উল্লেখ করা দরকার যে বিশ্ব এমন মহামারি পরিস্থিতির আরও শিকার হয়েছিল। প্লেগ, সার্স, মার্স, জিকা, নিপা, স্প্যানিশ ফ্লু, ইবোলা ইত্যাদি ভাইরাস বিভিন্ন সময় পৃথিবীতে এসেছে। প্লেগ চার-পাঁচ বছর স্থায়ী ছিল। সারা বিশ্বের ১৫ কোটি মানুষ মারা গিয়েছিল। বিশ্বের জনসংখ্যা পরিস্থিতির পূর্বাবস্থায় ফেরত আসতে দুই শতাব্দী লেগেছে। এটা পঞ্চদশ শতাব্দীর ভাইরাস। এক সময় নির্জীব হয়ে গিয়েছিল, তখন বিশ্ব পরিত্রাণ পায়। অবশ্য প্লেগ এখনো মহামারি হিসেবে মাঝে মাঝে ফিরে আসে। স্প্যানিশ ফ্লু দীর্ঘ দুই বছর স্থায়ী হয়েছিল আর পাঁচ কোটি মানুষ মেরেছিল। এ যাবৎ সাত কোটি মানুষ মেরেছে এইডস। এখনও তার কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। জন্ম অনেক আগে হলেও গত শতাব্দীর শেষ দুই দশক থেকে এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়।
সুতরাং আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা কী দাঁড়ালো! কোনো কোনো ভাইরাস দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং কোটি কোটি মানুষের প্রাণ সংহারের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের মনে হয় করোনা ঘুরে ফিরে এইরূপই নিচ্ছে। আমাদেরকে লকডাউন করে নয়, করোনার সঙ্গে বসবাস রপ্ত করে বাঁচতে হবে। লকডাউন মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশগুলোর জন্য সাজে, উন্নত দেশগুলোরও সহ্য করার ক্ষমতা রয়েছে কারও কারও। আমাদের জন্য এটা বিলাসিতা হবে।
অবশ্য করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কারের প্রচণ্ড চেষ্টা চলছে। ১৭৫টি গ্রুপ গবেষণা চালাচ্ছে। দশটি গ্রুপ তাদের ভ্যাকসিন মানবদেহে প্রয়োগ শুরু করেছে। সেই দশটির মধ্যে দু-একটিও যদি সফলতা পায় তা সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য আসতে হয়তো এক বছর সময় লাগবে। এতদিন লকডাউন চলতে পারে না। সুতরাং লকডাউন শিথিলের যে সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে তাছাড়া কোনো বিকল্প নেই মানতে হবে। তবে সরকার যেসব বিধি-নিষেধ মেনে চলার কথা বলছেন তা মেনে চলতে হবে। আর সরকারও তা মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। মনে রাখতে হবে সরকার লকডাউন তুলে নেয়ার খুব কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাই এটাকে সফল করতেও লাগবে কষ্টকর প্রচেষ্টা। জাতীয়ভাবে সফল করতে হবে। গা ভাসিয়ে দিয়ে চললে পরিকল্পনা কিন্তু হতাশাজনক হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]
এইচআর/বিএ/জেআইএম