কোভিড-১৯ দুর্যোগকালীন বাংলাদেশে খাদ্য ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা
সারাবিশ্বে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে সৃষ্ট দীর্ঘ লকডাউনের ফলে ভেঙ্গে পড়েছে বৈশ্বিক অর্থনীতি। সারাবিশ্ব যেন হঠাৎ করে থেমে গেছে। অসংখ্য মানুষ অর্থনৈতিক মন্দার কারণে চাকরি হারিয়েছেন। দেশে দেশে দীর্ঘ লকডাউনে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, কলকারখানা, পরিবহন, সুপার মার্কেট, রেস্তোরাঁ, জনগসামগম সব বন্ধ। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তথ্য মতে, করোনার কারণে সারাবিশ্বে প্রায় ১৬০ কোটি মানুষ বেকার হবে। ( ১) জাতিসংঘ এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি- ডব্লিউএফপি বলেছে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিশ্বজুড়ে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪০ থেকে ৬০ কোটি বাড়তে পারে এবং এই ভাইরাসের প্রভাবে বিশ্বে বড় আকারের দুর্ভিক্ষ হতে পারে। এতে প্রায় তিন কোটি মানুষ অনাহারে প্রাণ হারাতে পারে। এর পেছনে কৃষি উৎপাদন হ্রাস এবং অনেক দেশ খাদ্যশস্য রফতানি বন্ধ করে দেয়াকে কারণ হিসেবে দেখা হয়েছে। (২ ) পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ১৬ কোটি ৫০ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে তিন কোটি ৩০ লাখ লোক দরিদ্র এবং এর ভেতরে এক কোটি ৭০ লাখ লোক অতিদরিদ্র। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময়কালীন এই বিপুল সংখ্যক লোকের খাদ্যের জোগান দিতে সরকার কতটুকু সামর্থ্য এ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। যদিও সরকার বলছে, চিন্তার কোনো কারণ নেই কেননা দেশে এখনও পর্যাপ্ত খাদ্যের মজুত আছে।
[১. আমীন আল রশীদ, ‘করোনার পর কারা কেমন থাকবেন’, ১৫ মে ২০২০, বাংলা ট্রিবিউন; ২. সাইয়েদা আক্তার, ‘করোনাভাইরাস : বাংলাদেশে সম্ভাব্য খাদ্য বিপর্যয় এড়াতে সরকারের প্রস্তুতি কতটা?’, ২৩ এপ্রিল ২০২০, বিবিসি বাংলা]
বাংলাদেশে বর্তমান খাদ্য উৎপাদন ও মজুত
বাংলাদেশে এখন চলছে বোরো ধানের মৌসুম। কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, ইতোমধ্যে সারাদেশে হাওর অঞ্চলগুলোতে ধান কাটা প্রায় শেষের দিকে। এ বছর খাদ্যশস্যসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদনে সরকারের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন কৃষিমন্ত্রী। এ বছর আমাদের কৃষিপণ্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা দুই কোটি চার লাখ টন। এরপর আসবে আউশ ধান, যেখানে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা ৩০ লাখ টন। এর বাইরে অন্য দানাশস্য, সবজি ও ফলের উৎপাদনও এখন পর্যন্ত ভালো।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় কৃষি উৎপাদন বিশেষ করে ধান কাটা, নতুন মৌসুমে ফসল রোপণ এবং ফসল বাজারজাতকরণ নিয়ে সরকার আগাম প্রস্তুতি নিয়েছে। এর আগে হাওর অঞ্চলে কৃষিশ্রমিকের অভাবে ধান কাটা নিয়ে এক ধরনের জটিলতা দেখা দেয়। হাওর এলাকায় ধান কাটার জন্য অন্য জেলা থেকে কৃষি শ্রমিকদের যাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছিল। সরকার অন্য জেলা থেকে শ্রমিক আসার ব্যবস্থা করলে সে সংকটের সুরাহা হয়। এছাড়া চারশোর মতো ধান কাটার মেশিন, চার-পাঁচশো রিপার (মাড়াই করার যন্ত্র) দেয়া হয়েছে। সবমিলে ধান কাটার পরিস্থিতি সন্তোষজনক। তবে ভালো উৎপাদন সম্ভাবনার পরও করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট লকডাউনের মধ্যে ধান বাজারজাত করা একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করা হচ্ছে।
করোনাভাইরাসের পরবর্তী সময়ে খাদ্য চাহিদা সামাল দেয়ার জন্য সরকার এবার বোরো মৌসুমে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে গতবারের চেয়ে বেশি খাদ্যশস্য কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সরকার এবার ২১ লাখ টন খাদ্যশস্য কিনবে। যেখানে গত বছর ১৬ লাখ টন কেনা হয়েছিল। ২৬ এপ্রিল থেকে এই কার্যক্রম শুরু হয়েছে, চলবে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত।
কিন্তু এখন করোনাভাইরাসে আক্রান্তের হার বাড়ার ফলে একটা বিশেষ প্রেক্ষাপটে অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ায় সরকার ত্রাণ বিতরণ শুরু করেছে। সেজন্য সরকারি মজুত কিছুটা কমে গেলেও বোরো ফসল ওঠার পর তা পূরণ হয়ে যাবে। এ মৌসুমে আট লাখ টন ধান, সাড়ে ১১ লাখ টন চাল এবং ৭৫ হাজার টন গম কিনবে সরকার।(৩)
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে আউশ ও আমন উৎপাদিত হয়েছে যাথাক্রমে ৩০ এবং ১৫৫ লাখ টন। চলতি বছর বোরো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২০৪ দশমিক ৩ লাখ টন। সবমিলিয়ে ৩৮৯ দশমিক ৩ লাখ টন। এই এক বছরে ভাতের জন্য দেশে দরকার প্রায় ২৫০ লাখ টন চালের। আরও বাকি থাকে ১৩৯ দশমিক ৩ লাখ টন চাল। উৎপাদনের ২৬ শতাংশ হিসেবে গোখাদ্য, পোল্ট্রি শিল্পকারখানা, অপচয় ইত্যাদি খাতে ব্যবহৃত হবে আরও ১০১ দশমিক ২ লাখ টন। বাকি ৩৮ দশমিক ১ লাখ টন চাল মজুত থাকবে বলে আশা করছে সরকার। হিসাবটা কাটায় কাটায় না হলেও গত কয়েক বছর ধরেই গড়ে ৩৫ লাখ টন করে চাল উদ্বৃত্ত থাকছে। এই মুহূর্তে দেশে ৬০-৭০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত আছে। যার সঙ্গে বোরো থেকে যোগ হতে যাচ্ছে আরও প্রায় ৩৮ লাখ টন। দেশের বর্তমান মজুত চাল দিয়ে আগামী ৭-৮ মাস নিশ্চিত থাকা যাবে। সামনে আসছে আউশ, তারপর আবার আমন। (৪) একইভাবে দেশে এ বছর গম উৎপাদিত হবে ১৩ লাখ টন এবং ভুট্টা ৪৪ লাখ টন। (৫)
[৩. সাইয়েদা আক্তার, ‘করোনাভাইরাস : বাংলাদেশে সম্ভাব্য খাদ্য বিপর্যয় এড়াতে সরকারের প্রস্তুতি কতটা?’, ২৩ এপ্রিল ২০২০, বিবিসি বাংলা, ঢাকা; ৪. ড. মনসুর আলম খান, ‘এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে’, সম্পাদকীয় ডেস্ক, জাগোনিউজ, ০৬ মে ২০২০; ৫. মানিক মুনতাসির, ‘খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা নেই’, ১৪ এপ্রিল ২০২০, বাংলাদেশ প্রতিদিন]
রুশ ফেডারেশনের সঙ্গে ইতোমধ্যেই দুই লাখ টন গম কেনার সমঝোতা হয়েছে এবং জুলাই মাসের মধ্যে সে গম এসে পৌঁছাবে দেশে। এর আগে রাশিয়া গম রফতানি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছিল। রাশিয়ার ঘোষণার আগেই জি-টু-জি অর্থাৎ দুই দেশের সরকারের মধ্যে সমঝোতা হয়েছিল ফলে গম যথাসময়ে আসবে। ফলে খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে অযথা আতঙ্কিত কিংবা শঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সরকার-সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো।
তবে সরকার খাদ্যের মজুত নিয়ে সন্তুষ্ট হলেও বিশ্লেষকরা বলছেন, কোনো দেশের খাদ্য পরিস্থিতি কেবলমাত্র উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। এর সঙ্গে কৃষকের ন্যায্যমূল্য পাওয়া এবং বাজার ব্যবস্থাপনার দক্ষতাও আবশ্যক বিষয়। এখন যেহেতু বিশ্বব্যাপী একটি বিশেষ পরিস্থিতি, সে কারণে বাজার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সরকারকে দক্ষতা দেখাতে হবে। এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি বিবেচনায় খাদ্য উৎপাদন এবং মজুতে হয়তো সমস্যা নেই কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে উদ্ভূত বিশ্ব পরিস্থিতিতে বাজার ব্যবস্থাপনাটাই বড় চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। পরিস্থিতি মোকাবিলার সাফল্য নির্ভর করবে বাজার ব্যবস্থাপনা ক্রুটিমুক্ত থাকার ওপর। এক্ষেত্রে কৃষিপণ্যের মূল্য ও মজুত নিয়ে কারসাজি, অন্যায়ভাবে বাজারকে প্রভাবিত করা, কৃত্রিম সংকট তৈরি– এ ধরনের কোনো অব্যবস্থাপনা যাতে না ঘটে সে ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক হতে হবে।
বাংলাদেশে বর্তমানে খাদ্যমূল্য
চালের মূল্য : গণমাধ্যমের তথ্য থেকে জানা যায়, এবার বোরো মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মিলগেট থেকে চাল প্রস্তুত করে বাজারে ছাড়ায় মোকামে গত ১৫ মে পর্যন্ত প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) চালে কমেছে সর্বোচ্চ ৬০০ টাকা। এতে রাজধানীতে পাইকারি ও খুচরা বাজারে চালের দাম কেজিতে ৪ থেকে সর্বোচ্চ ৭ টাকা কমেছে। রাজধানীর সর্ব বৃহৎ চালের পাইকারি আড়ত বাদামতলী ও কারওয়ান বাজারের পাইকারি চাল ব্যবসায়ীদের তথ্য মতে, প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছে ৪৫ টাকায়। যা ১০ দিন আগে বিক্রি হয়েছে ৫২ টাকায়। প্রতি কেজি নাজিরশাইল বিক্রি হয়েছে ৫০ টাকায়। যা ১০ দিন আগে বিক্রি হয়েছে ৫৪ টাকায়। অন্যদিকে রাজধানীর নয়াবাজার, মালিবাগ বাজারের খুচরা চালের বাজার থেকে জানা গেছে, প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছে ৫৩-৫৪ টাকায়। যা ১৩ দিন আগে বিক্রি হয়েছে ৬০ টাকায়। প্রতি কেজি নাজিরশাইল বিক্রি হয়েছে ৫৬-৫৮ টাকায়। যা ১৩ দিন আগে বিক্রি হয়েছে ৬০-৬২ টাকায়। এছাড়া বিআর-২৮ চাল প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ৪১-৪২ টাকায়। যা ১৩ দিন আগে বিক্রি হয় ৪৮ টাকায়।
মোটা চালের মধ্যে স্বর্ণা প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ৩৮ টাকায়, যা ১৩ দিন আগে বিক্রি হয় ৪৫ টাকায়। চাল ব্যবসায়ীদের তথ্য মতে, পাইকারি বাজারে সব ধরনের চালের দাম গত ১৫ দিন ধরে কমছে। কারণ চাহিদার থেকে সরবরাহ বেড়েছে। সে ক্ষেত্রে কম দামে এনে তারা কম দামেই বিক্রি করছেন। (৬)
ডালের মূল্য : বাজারে ডালের দামে মিশ্র প্রবণতা রয়েছে। মসুর ডালের দাম বাড়লেও গত এক মাসে কমেছে ছোলা ও মুগ ডালের দাম। বড় দানার মসুর ডালের দাম ১৬ দশমিক ১৩ শতাংশ এবং মাঝারি দানা ২৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ বেড়েছে। তবে অপরিবর্তিত রয়েছে ছোট দানার মসুর ডালের দাম। অপরদিকে মুগ ডালের ১৮ দশমিক ৫২ শতাংশ এবং ছোলার ৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ দাম কমেছে। (৭)
মসলার মূল্য : গত ১৩ মে বাংলাদেশ পাইকারি গরম মসলা ব্যবসায়ী সমিতি গরম মসলার দাম ১০ থেকে ২৫ ভাগ কমানোর ঘোষণা দেয়। ঘোষণার পর থেকে খুচরা বাজারে জিরা (ভারত) প্রতি কেজি ৩০০ থেকে ৩৪০ টাকা, দারুচিনি (চীন) কেজি ৩১০ থেকে ৩৩০ টাকা, দারুচিনি (ভিয়েতনাম) কেজি ৩৫০ থেকে ৩৭০ টাকা, লবঙ্গ কেজি ৬৮০ থেকে ৭২০ টাকা, এলাচি কেজি ২ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকা, গোলমরিচ (সাদা) ৫৫০ থেকে ৫৮০ টাকা এবং গোলমরিচ (কালো) ৩৬০ থেকে ৩৮০ টাকা দরে কেনাবেচা করার কথা ছিল। (৮) অথচ গণমাধ্যমের তথ্য থেকে জানা যায়, ঘোষণার প্রায় এক সপ্তাহ পরও সব ধরনের মসলাই আগের দামে বিক্রি হয়। জিরার কেজি ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকা, দারুচিনি ৪০০ থেকে ৪৮০ টাকা, লবঙ্গ ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা, এলাচি ৩৬০০ থেকে ৪২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়।
পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউন করা হলে বন্দরে মাল আটকে যায়। এতে মসলার দাম কিছুটা বাড়ে। তবে এখন মাল আসা স্বাভাবিক হয়েছে। যে কারণে জিরা বাদে সব ধরনের মসলার দাম কমেছে।(৯) ঈদকে সামনে রেখে বাড়ছে পেঁয়াজের দাম। রোববার (১৭ মে) বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, ব্যবসায়ীরা দেশি পেঁয়াজের কেজি বিক্রি করছেন ৪৫ থেকে ৫০ টাকা, যা দুদিন আগে ছিল ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। আর রোজা শুরু হওয়ার আগে ছিল ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। তবে রোজার মধ্যে হুট করে দাম বেড়ে পেঁয়াজের কেজি ৬৫ টাকা পর্যন্ত ওঠে।(১০)
[৬. ইয়াসিন রহমান, “চালের দাম বস্তায় ৬শ’ টাকা কমেছে”, ১৫ মে ২০২০, যুগান্তর; ৭. ‘এক মাসে বেড়েছে ১৫ নিত্যপণ্যের দাম, কমেছে ১০টি’, ১৬ মে ২০২০, জাগোনিউজ ২৪.কম; ৮. ‘গরম মসলার দর ১০-২৫ শতাংশ কমানোর ঘোষণা’, ১৩ মে ২০২০, প্রথম আলো; ৯. সাঈদ শিপন, ‘মসলার দাম কমেনি, উল্টো বেড়েছে’, ১৮ মে ২০২০, জাগোনিউজ ২৪.কম; ১০. ‘ঈদকেন্দ্রিক বাড়ছে পেঁয়াজের ঝাঁজ’, ১৭ মে ২০২০, জাগোনিউজ ২৪.কম]
ভোজ্যতেলের মূল্য : ভোজ্যতেলের দামের বিষয়ে সরকারি বিক্রয়কারী সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) জানিয়েছে, এক লিটারের বোতলের সয়াবিন তেলের দাম মাসের ব্যবধানে বাড়লেও লুজ সয়াবিন তেল এবং সব ধরনের পাম অয়েলের দাম কমেছে। সয়াবিন তেলের এক লিটারের বোতলের দাম বেড়েছে ২ দশমিক ৩৮ শতাংশ। বিপরীতে লুজ সয়াবিন তেলের দাম কমেছে ৪ দশমিক ২৬ শতাংশ। লুজ পাম অয়েলের ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ এবং সুপার পাম অয়েলের ৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ দাম কমেছে।(১১)
মুরগি ও ডিমের মূল্য : করোনাভাইরাসের শুরুতে ব্রয়লার মুরগির চাহিদা ব্যাপক কমে যায়। এতে ফার্ম-মালিকরা লোকসানে কম দামে মুরগি বিক্রি করেন। এরপর রোজার শুরুতে চাহিদা বাড়ায় ব্রয়লারের দাম কিছুটা বাড়ে। রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে গত ১৬ মে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্রয়লার মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৬০ থেকে ১৭০ টাকায়। রোজার শুরুতে মূল্য ছিল কেজিপ্রতি ১২০ থেকে ১৩০ টাকা এবং করোনার শুরুর দিকে ১১০ থেকে ১১৫ টাকায় বিক্রি হয় ব্রয়লার মুরগি। কিন্তু ঈদকে সামনে রেখে হঠাৎ করেই এর মূল্য কেজিতে প্রায় ৩০-৪০ টাকা বেড়েছে।(১২) অপরদিকে, লাল ডিম বিক্রি হচ্ছে প্রতি পিস ৭ টাকা আর সাদা ডিম বিক্রি হচ্ছে প্রতি পিস ৬ টাকা করে।(১৩)
আটার মূল্য : গত এক মাসে বেড়েছে আটা ও ময়দার দাম। প্যাকেট আটার দাম বেড়েছে ২ দশমিক ৬৭ শতাংশ। তবে খোলা আটার দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। আর প্যাকেট ময়দার দাম ২ দশমিক ১৫ শতাংশ এবং খোলা ময়দার দাম ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেড়েছে।(১৪)
মাছ-মাংসের মূল্য : গত এক মাসে বাজারে বেড়েছে দেশি মুরগি ও গরুর মাংসের দাম। সেই সঙ্গে বেড়েছে ইলিশ মাছের দাম। এর মধ্যে গরুর মাংসের দাম বেড়েছে ২ দশমিক ৬১ শতাংশ। আর দেশি মুরগির ২৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এছাড়া ইলিশ মাছের দাম বেড়েছে ২৯ দশমিক ৪১ শতাংশ। তবে খাসির মাংস ও রুই মাছের দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।
[১১. ‘এক মাসে বেড়েছে ১৫ নিত্যপণ্যের দাম, কমেছে ১০টির’, ১৬ মে ২০২০, জাগোনিউজ ২৪.কম; ১২. সাঈদ শিপন, “‘ইচ্ছামাফিক’ হাঁকে চড়া ব্রয়লার”, ১৬ মে ২০২০, জাগোনিউজ ২৪.কম; ১৩. ‘সোমবারের (১৮ মে) পোল্ট্রির ডিম, মুরগি ও বাচ্চার পাইকারি দাম’, ১৮ মে ২০২০, এগ্রিকেয়ার ২৪.কম; ১৪. ‘এক মাসে বেড়েছে ১৫ নিত্যপণ্যের দাম, কমেছে ১০টির’, ১৬ মে ২০২০, জাগোনিউজ ২৪.কম]
দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের মূল্য : গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, বাজারে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের চাহিদা ৩৫ শতাংশ কমেছে। দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর প্রথম আঘাতটি আসে দুগ্ধশিল্পে। সারাদেশে দোকানপাট, রেস্তোরাঁ, সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটে। ফলে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের চাহিদা অর্ধেকে নেমে আসে। চাষিপর্যায়ে দুধ ফেলে দেয়ার ঘটনাও ঘটে। পবিত্র রমজান মাস শুরু হওয়ার পর চাহিদা কিছুটা বেড়েছে। এর বাইরে মিষ্টির দোকান, ছানার দোকান ইত্যাদি কিছু কিছু খুলেছে। ফলে এখন দুধ ফেলে দিতে হচ্ছে না। এছাড়া প্রাণিসম্পদ অধিদফতর দুধ বিক্রির উদ্যোগ নেয়, যা খামারিদের সহায়তা করে। দেশে মোট উৎপাদিত দুধের মাত্র ৭ শতাংশ ব্র্যাক, মিল্ক ভিটা, প্রাণের মতো বড় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রক্রিয়াজাত করে। চাহিদার বড় অংশই পূরণ হয় আমদানি করা গুঁড়া দুধ দিয়ে। দেশে আমাদের চেয়ে বিদেশি গুঁড়া দুধের বাজার তিনগুণ বড়। দেশের খামারিদের তরল দুধ দিয়ে এক কেজি গুঁড়া দুধ তৈরির খরচ পড়ে ৪২০ টাকার মতো। আর যদি কেউ নিউজিল্যান্ড থেকে ভালো মানের গুঁড়া দুধ আমদানি করে তার খরচ পড়ে ৩৩০ টাকার মতো। ফলে বাজারে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত গুঁড়া দুধ প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। সব মিলিয়ে দুগ্ধশিল্পে লাভ নেই। এ কারণে কিন্তু দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে নতুন বিনিয়োগ আসছে না।(১৫)
সবজির মূল্য : করোনাভাইরাসের ফলে সৃষ্ট লকডাউন পরিস্থিতিতে বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়েন পচনশীল খাদ্যপণ্যের উৎপাদক ও ব্যবসায়ীরা। কারণ সরকারি নির্দেশনায় পচনশীল খাদ্যপণ্য পরিবহন এই নিষেধাজ্ঞার বাইরে রাখা হলেও তাদেরকে পদে পদে বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। বিভিন্ন জায়গার চাষিরা অর্ধেক দামেও তাদের সবজি বিক্রি করতে পারছেন না। এছাড়া গণপরিবহন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জেলা শহর থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা সবজি কেনার জন্য আসতে পারছেন না।
কৃষক ক্ষেত থেকে সবজি তুলছেন না। কারণ শ্রমিকের মজুরি ও হাটে নিতে যে খরচ তা সবজি বেঁচে উঠছে না। সবমিলিয়ে বড়ো ক্ষতিতে পড়েছেন সবজি চাষিরা। দেশের হাটবাজারগুলোতে পানির দরে সব ধরনের সবজি বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি করলা ৪ থেকে ৫ টাকা, শসা ১০ টাকা, পটোল ২০ টাকা, লাউ ১০ টাকা, ঢেঁড়শ ১৫ টাকা, মিষ্টি কুমড়া ৮ টাকা, কাঁচা মরিচ ৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। তারপরও ক্রেতা নেই। এদিকে ক্রেতা না পাওয়ায় অনেকের ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে সবজি। কৃষকদের কেউ কেউ উৎপাদিত সবজি গরু-ছাগলের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করছেন।(১৬)
[১৫. মোহাম্মদ আনিসুর রহমান, ‘দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের চাহিদা ৩৫ শতাংশ কমে গেছে’, ১৯ মে ২০২০, প্রথম আলো; ১৬. মুন্না রায়হান, ‘করোনার প্রভাব : ক্ষতিতে সবজি চাষিরা’, ০৩ মে ২০২০, দৈনিক ইত্তেফাক]
বর্তমান কর্মসংস্থান ও কৃষিজীবীদের অবস্থা
বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় একটি এনজিওর জরিপে উঠে এসেছে যে, দেশে ইতোমধ্যেই করোনাভাইরাসের প্রভাবে মানুষের আয়-রোজগারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসে জরিপে অংশ নেয়া মানুষের গড় আয় ছিল ১৪,৫৯৯ টাকা। করোনা প্রাদুর্ভাব শুরুর পর জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৯৩ শতাংশের আয় কমে গেছে। পরের মাসে অর্থাৎ মার্চে তাদের গড় আয় দাঁড়িয়েছে ৩,৭৪২ টাকা। এদের মধ্যে চট্টগ্রাম, রংপুর ও সিলেট বিভাগের মানুষের আয় কমেছে সবচেয়ে বেশি। সরকারি ছুটি এবং অবরোধের কারণে অনেকেই কাজ হারিয়েছেন অথবা তাদের কাজ কমে গেছে। ৮ শতাংশ মানুষের কাজ আছে কিন্তু তারা বেতন পাচ্ছেন না। শহর ও গ্রাম এলাকার মোট ২ হাজার ৬৭৫জন মানুষ এই জরিপে অংশ নেয়।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের পক্ষ থেকে বিবিসি বাংলাকে জানানো হয়, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের হিসাব অনুযায়ী তাদের সংগঠনের রেজিস্টার্ড ৫০ লাখ শ্রমিক রয়েছে। এর বাইরে রয়েছে আরও ২০ লাখ শ্রমিক। যাদের জীবন প্রতিদিনের রোজগারের ওপর চলে। লকডাউনের ফলে তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। গত ২৬ মার্চ থেকে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় তারা নিদারুণ আর্থিক কষ্টে পড়েছেন।
করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের প্রভাবে নিয়মিত চাকরিজীবী বা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। দিনযাপন রীতিমতো কষ্টকর হয়ে পড়েছে পরিবহনশ্রমিক, গার্মেন্টসকর্মী, বিভিন্ন ধরনের ক্ষুদ্র ব্যবসার সাথে জড়িতদের। এমনকি বিভিন্ন গণমাধ্যমের কর্মীদেরও তাদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বেতন দেয়া হয়নি অথবা চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হয়েছে। এই দুর্যোগ পরিস্থিতিতে তারা দিনযাপন করতে হিমশিম খাচ্ছেন। সহায়তার প্রয়োজন থাকলেও লোকলজ্জার কারণে তারা সাহায্য চাইতে পারছেন না অথবা একাধিকবার সহায়তা চেয়েও পাননি। অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের আয় করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকেই চাকরি হারিয়ে অসহায় অবস্থায় আছেন। তাদের পক্ষে বাসাভাড়া দেয়া, সংসারের জন্য বাজার করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
এদিকে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত হচ্ছে কৃষি। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতেও দেশের খাদ্যের চাহিদা মেটাতে কৃষি খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু এ খাতের সাথে জড়িত কৃষকরা লোকসান গুনছেন। কারণ সরকার ধানের যে সংগ্রহমূল্য ঠিক করে দিয়েছে তার অর্ধেক মূল্যে ধান বিক্রি হচ্ছে। ফলে ধানের উৎপাদন খরচও তুলতে পারছেন না কৃষকরা। এ অবস্থায় ব্যাংক ঋণ, সংসার খরচ— সবকিছু মিলিয়ে কৃষকরা অসহায় অবস্থায় পড়েছেন। দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাতের সাথে জড়িত এসব কৃষক যদি ন্যায্যমূল্য না পান তারা ভবিষ্যতে নিজেদের পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হবেন। ফলে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটপূর্ণ সময়ে বাংলাদেশ সংকটাপন্ন অবস্থার সম্মুখীন হতে পারে। কৃষকদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বিশেষ তহবিল গঠন করেছে সরকার। এ তহবিল থেকে কৃষকদের মাত্র ৫ শতাংশ সুদে অর্থ প্রদানের কথা জানানো হয়েছে। এ তহবিলের অর্থ গ্রামাঞ্চলের পোল্ট্রি ও দুগ্ধ খাতসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা হবে। পাশাপাশি মশলা জাতীয় পণ্যের জন্য ৪ শতাংশ হারে ঋণ বিতরণ অব্যাহত থাকবে।
সরকার ইতোমধ্যে ফসল সংগ্রহ প্রক্রিয়ার জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়কে ১০০ কোটি টাকার বরাদ্দ দিয়েছে। সরকার এ খাতে আরও ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেবে। কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রাখতে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মাঝে বীজ ও চারা বিতরণের জন্য সরকার আরও ১৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেবে। ফসল সংগ্রহ এবং সরবরাহের কাজে নিয়োজিতদের চলাচল ও কাজের সুবিধার্থে ইতোমধ্যে প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কৃষকরা যাতে তাদের পণ্য বিক্রি করতে পারেন সেজন্য প্রতিটি অঞ্চলে একটি উন্মুক্ত জায়গায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেই সাপ্তাহিক হাট (অস্থায়ী বাজার) বসানোর ব্যবস্থা করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, মাত্র ৪ শতাংশ সুদে কৃষকদের ঋণ বিতরণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বিশেষ ঋণ প্রণোদনা দেবে আশা করছি। কৃষি খাতে যে ক্ষতি হবে তা আমরা দ্রুত কাটিয়ে উঠতে পারব।(১৭)
সরকারের খাদ্য সহযোগিতা ও পদক্ষেপসমূহ
গত ২ মে পিআইডির এক বিবৃতিতে বলা হয়, করোনা দুর্যোগ মোকাবিলায় এখন পর্যন্ত ৪ কোটি দুস্থ ও অসহায় মানুষকে ত্রাণ দেয়া হয়েছে। ১ মে পর্যন্ত এক লাখ ২৪ হাজার টন চাল ত্রাণ হিসেবে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে এবং বিতরণ করা হয়েছে ৯২ হাজার ৩৪১ টন। বিতরণকৃত চালের উপকারভোগী পরিবার সংখ্যা ৯৩ লাখ ৩৮ হাজার এবং উপকারভোগী লোক সংখ্যা তিন কোটি ৯৫ লাখ। দেশের ৬৪ জেলায় এখন পর্যন্ত নগদ প্রায় ৬৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে নগদ সাহায্য হিসেবে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৫২ কোটি ১৭ লাখ টাকা এবং বিতরণ করা হয়েছে ৪১ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। এতে উপকারভোগী পরিবারের সংখ্যা ৫১ লাখ ৭৭ হাজার এবং উপকারভোগী লোক সংখ্যা প্রায় দুই কোটি ৪২ লাখ। শিশুখাদ্য সহায়তা হিসেবে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা এবং এখন পর্যন্ত বিতরণ করা হয়েছে ৮ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এতে উপকারভোগী পরিবার সংখ্যা দুই লাখ ৬৩ হাজার এবং লোক সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ ২৬ হাজার।(১৮)
[১৭. মুন্না রায়হান, ‘করোনার প্রভাব : ক্ষতিতে সবজি চাষীরা‘, ০৩ মে ২০২০, দৈনিক ইত্তেফাক; ১৮. ‘৪ কোটি মানুষকে ত্রাণ দিয়েছে সরকার’, ০২ মে, সময় নিউজ]
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সূত্র মতে, মাঠপর্যায়ের তথ্য, পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য, জনসংখ্যা, দারিদ্র্যের হার, সম্পদের প্রাপ্যতা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে মে মাসে সব জেলায় মোট ৫০ লাখ পরিবারকে ত্রাণ দেয়া হবে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশন, জামালপুর, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা জেলার প্রতিটিতে এক লাখ করে পরিবার এই সুবিধা পাবেন। এছাড়া কুড়িগ্রাম, সিলেট, বরিশাল ও ময়মনসিংহ জেলার প্রতিটিতে ৯০ হাজার পরিবার এই সহায়তা পাবেন। গাজীপুর, রাজশাহী ও রংপুর জেলা এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকার প্রতিটিতে ৮০ হাজার পরিবার এই সুবিধা পাবেন। তালিকায় ৭৫ হাজার করে পরিবার আছে ফরিদপুর, নেত্রকোনা, টাঙ্গাইল, কক্সবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, নওগাঁ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, বাগেরহাট, যশোর, কুষ্টিয়া, পটুয়াখালী, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলায়। নোয়াখালী, কিশোরগঞ্জ ও দিনাজপুর জেলার একেকটিতে ৭৭ হাজার পরিবার এই সহায়তায় পাবেন। বাকি এলাকাগুলোতে ৪০ হাজার থেকে শুরু করে ৭২ হাজার পর্যন্ত পরিবার রয়েছে।(১৯)
ভবিষ্যতে খাদ্যনির্ভর ব্যবসা ও জীবিকা
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তথ্য মতে, করোনার কারণে সারাবিশ্বে প্রায় ১৬০ কোটি মানুষ বেকার হবে।(২০) বিকল্প আয়ের উৎস ছাড়া এই মানুষদের টিকে থাকার কোনো উপায় থাকবে না। এর মাঝে অনেক মানুষ তাদের পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হবেন বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখীন হয়ে। বেকার হয়ে অনেক প্রবাসী নিজ নিজ দেশে ফিরে যেতে বাধ্য হবেন। নিউ ইয়র্ক টাইমসের হিসাব মতে, এই বছরের শেষে বিশ্বব্যাপী ২৯৮ মিলিয়ন লোক খাদ্য সংকটে পড়বেন।(২১) খাদ্যের চাহিদা মেটাতে অসংখ্য বেকার মানুষের খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করার জন্য খাদ্যনির্ভর পেশার সাথে জড়িত হবেন। যেহেতু মানুষের প্রধান খাদ্যচাহিদা পূরণ করে কৃষি খাত, সেহেতু মানুষ কৃষিনির্ভর উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির দিকে মনোনিবেশ করবে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য করবে। পোল্ট্রি, বাণিজ্যিক মাছচাষ, গবাদি পশুপালন, দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনসহ সিজনাল শাকসবজি চাষের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবে। করোনা যেমন বিশ্বব্যাপী মানুষের জন্য আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে তেমনি ভাইরাসটি আবার মানুষকে তার পুরোনো কৃষিভিত্তিক পেশায় ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। কারণ করোনা মহামারি-পরবর্তী সময়ে অনেক পেশা নষ্ট হয়ে যাবে। মানুষ নিজেদের খাদ্য নিজেরাই উৎপাদনের ওপর জোর দেবে। এটি আমাদের বাংলাদেশে একটি ভালো সুযোগ তৈরি করতে পারে।
[১৯. মোশতাক আহমেদ, ‘মে মাসে ৫০ লাখ পরিবার ২০ কেজি করে ত্রাণ পাবে’, ০২ মে ২০২০, প্রথম আলো; ২০. আমীন আল রশীদ, ‘করোনার পর কারা কেমন থাকবেন’, ১৫ মে ২০২০, বাংলা ট্রিবিউন;২১. Abdi Latif Dahir, ‘Instead of Coronavirus, the Hunger Will Kill Us.’ A Global Food Crisis Looms,” 22 April 2020, New York Times]
অসংখ্য শিক্ষিত যুব সমাজ চাকরি পাওয়ার আশায় ছুটে না বেড়িয়ে এই কৃষিভিত্তিক খাদ্য উৎপাদন পেশার সাথে জড়িত হবে। যেহেতু বিশ্বব্যাপী খাদ্যের একটি ক্রাইসিস তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তাই দেশগুলো নিজেদের চাহিদা মেটাতে রফতানি বন্ধ করে দিতে পারে। যেমন- সম্প্রতি রাশিয়া গম রফতানি বন্ধ ঘোষণা করেছে। চাল রফতানিতে বিশ্বে তৃতীয় ভিয়েতনাম আর গম রফতানিতে নবম হচ্ছে কাজাখস্তান। অভ্যন্তরীণ চাহিদা নিয়ে উদ্বেগের কারণে এই দুই দেশই রফতানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় চাল রফতানিকারক ভারত ইতোমধ্যে কয়েকটি রফতানি আদেশ স্থগিত করেছে।
এই পরিস্থিতিতে যেসকল দেশ খাদ্য আমদানির ওপর নির্ভরশীল তারা নিজেদের খাদ্য নিজেরাই উৎপাদনের প্রতি বেশি নজর দেবে। ফলে কৃষিপেশার সাথে জড়িত পেশাজীবিদের কদর বাড়বে এবং প্রান্তিক কৃষকরা লাভের মুখ দেখতে পারবে। যেসকল দেশ কৃষিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারবে তারা অন্যদের থেকে এগিয়ে থাকবে। বাংলাদেশে কৃষিশ্রমিকের স্বল্পতা, মজুরি বৃদ্ধি, আহরিত ফসলের সময়ভিত্তিক যথাযথ দাম না পাওয়া, কৃষিপণ্যের সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের যথাযথ সুবিধা না থাকায় এদেশে কৃষি একটি অলাভজনক পেশায় পরিণত হয়েছে। যদিও আমাদের খাদ্যের জোগান আসে কৃষি খাত থেকেই। কিন্তু করোনা-পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটের মুখে কৃষি একটি গুরুত্বপূর্ণ খাতে পরিণত হবে। তাই কৃষিভিত্তিক উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সরকারের বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। সার-বীজসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণ সঠিক সময়ে কৃষকদের কাছে পৌঁছাতে হবে।
বাংলাদেশের আবহাওয়া কৃষির জন্য অত্যন্ত উপযোগী। বাংলাদেশের প্রধান ফসল হচ্ছে বোরো ধান। এ বছরও বোরো ধানের ব্যাপক ফলন হয়েছে। সরকারের গুদামে যথেষ্ট খাদ্যশস্য মজুত আছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। সরকারের সঠিক পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে এই সাফল্যকে করোনা-পরবর্তী সময়েও ধরে রাখা সম্ভব। কৃষিপেশার সাথে যেসকল তরুণ উদ্যোক্তা সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য এগিয়ে এসেছেন তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ ও ঋণের ব্যবস্থা সরকারের পক্ষ থেকে করতে হবে। প্রান্তিক কৃষকদের ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। সকল কৃষি উপকরণের যথাযথ মূল্য নির্ধারণ করতে হবে যাতে নিম্ন শ্রেণির কৃষক থেকে শুরু করে যারা এই পেশার সাথে নতুনভাবে জড়িত হবেন তারাও যেন সহজেই এই কৃষি সরঞ্জামগুলো সংগ্রহ করতে পারেন।
বাংলাদেশকে তার নিজের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বাইরে কৃষিপণ্য রফতানির দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। এতে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। এছাড়া রফতানি আয় দিয়ে আমরা খাদ্যনির্ভর আরও পেশার সৃষ্টি করতে পারব এবং আমাদের কৃষির উন্নতিতে আরও বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারব।
শহরের খাদ্যমূল্য আরও বৃদ্ধি পেতে পারে
করোনাভাইরাস একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এই ভাইরাসে শুধু যে অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছে, অসংখ্য মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে তা-ই নয়, সাথে সাথে ভেঙ্গে পড়েছে বিশ্ব সরবরাহ ব্যবস্থা। সারাবিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখীন। দীর্ঘ লকডাউনে জনজীবন বিপর্যস্ত, যার ছোয়া বাংলাদেশেও লেগেছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, পৃথিবীজুড়ে মোট দরিদ্রের অর্ধেকই বাস করে পাঁচটি দেশে। এ পাঁচ দেশের মধ্যে দক্ষিণ এশয়িার দেশ রয়েছে দুটি। এর মধ্যে ভারতের অবস্থান র্শীর্ষে। পঞ্চম বাংলাদেশ। দুটি দেশেই কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। আশঙ্কা রয়েছে, বাংলাদেশ ও ভারতের মতো দক্ষিণ এশিয়ার দারিদ্র্যপীড়িত দেশগুলোতে করোনা মোকাবিলার পথে বড় ধরনের বাধা হয়ে উঠতে পারে দারদ্র্যি।
বাংলাদেশের বিভিন্ন পেশাজীবীর লোক রাজধানীমুখী। ওয়ার্ল্ডওমিটারের মতে, বাংলাদেশের ৩৯.৪% জনগণ শহরে বসবাস করে। এসব জনগণের মধ্যে কর্পোরেট লিডার থেকে শুরু করে ব্যাংকার, শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ রিকশাচালক, দিনমজুর, গণপরিবহন শ্রমিক, নির্মাণশ্রমিক ও বিভিন্ন পেশার মানুষ শহরে বসবাস করেন। কাজের খোঁজে প্রতি বছর আরও অসংখ্য লোক শহরগুলোতে ভিড় জমাচ্ছেন। কোনো না কোনো পেশা খুঁজে নিয়ে এই মানুষগুলো পরিবার-পরিজন নিয়ে শহরের বুকে আশ্রয় নিয়েছেন। এত অসংখ্য লোকের খাদ্যের জোগান দেয়াটা সহজ কথা নয়। এর মধ্যে আবার করোনাভাইরাসের ভয়াল আক্রমণ।
বাংলাদেশে প্রথম করোনা সংক্রমিত হওয়ার পর বাজারে অস্থিরতা বাড়তে থাকে। সবধরনের কাঁচাবাজার ও দোকানগুলোতে পণ্যের দাম বৃদ্ধির একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। করোনার কারণে খাদ্য সংকট দেখা দেবে এই ভয়ে বিত্তবান মানুষরা খাদ্য কিনে মজুত করে রাখতে শুরু করেন। এই সুযোগে ব্যবসায়ী ও মজুতদাররা খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য স্টক করে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে পণ্যের দাম বাড়াতে থাকেন। প্রতি কেজি চালে ১২-১৫ টাকা মূল্য বৃদ্ধি পায়। এরপরও উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা এই চাল বস্তা বস্তা কিনে স্টক করে রাখেন খাদ্য সংকটের ভয়ে। এই সুযোগে ব্যবসায়ীরাও দাম বাড়িয়ে দেন ইচ্ছামতো। করোনার ফলে কাঁচাবাজারের সবজি, ভোজ্যতেলসহ সব ধরনের খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়ে। এর মধ্যে সুযোগ নেন আড়তদাররা। কৃষকদের কাছ থেকে অত্যন্ত কম মূল্যে সবজি কিনে শহরে এনে এগুলো করোনার দোহাই দিয়ে অনেক বেশি দামে তারা বিক্রি করেন। গ্রামে কৃষক ক্ষেত থেকে সবজি তুলছেন না। কারণ শ্রমিকের মজুরি ও হাটে নিতে যে খরচ তা সবজি বেচে উঠছে না। দেশের হাট-বাজারগুলোতে পানির দরে সবধরনের সবজি বিক্রি হয়। প্রতি কেজি করলা ৪ থেকে ৫ টাকা, শসা ১০ টাকা, পটোল ২০ টাকা, লাউ ১০ টাকা, ঢেঁড়শ ১৫ টাকা, মিষ্টি কুমড়া ৮ টাকা, কাঁচা মরিচ ৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। অথচ এই সবজি যখন শহরে আসে তখন এর দাম হয় দ্বিগুণ-তিনগুণ। শহরের বাজারে লাউশাক প্রতি আঁটি ৩৫ থেকে ৪০ টাকা, পুঁইশাক ৩০ টাকা, পাটশাক ২০ টাকা, কচুশাক ২০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা যায়। ধনিয়া পাতা বিক্রি হয় ১৫০ থেকে ২০০ টাকায়। প্রতি হালি লেবু ৮০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে। বেগুন ৬০ থেকে ৭০ টাকা। শসা ৫০ টাকা কেজি। দাম বেড়েছে লাউ ও জালি কুমড়ার। ১৫ থেকে ২৫ টাকায় বিক্রি হওয়া প্রতিটি লাউ বর্তমানে দ্বিগুণ মূল্যে বিক্রি হচ্ছে।
করোনা প্রতিরোধে ঘোষিত লকডাউনের কারণে সরবরাহকারীদের পণ্য পরিবহন করতে অধিক খরচ গুনতে হচ্ছে। এই টাকা তারা পণ্যের দাম বাড়িয়ে আদায় করছেন। যার কারণে বাজারে ক্রেতাদের কাছ থেকেও বেশি টাকা আদায় করা হচ্ছে। অনেক জায়গায় সরবরাহ নেই বলে যা খুশি দাম রাখা হচ্ছে। নিয়মনীতির ধার ধারছেন না কেউ। আবার অনেক ব্যবসায়ী সাময়িক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে দাম বাড়াচ্ছেন। যারা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ঋণ নিয়ে বিভিন্ন ব্যবসা করেন তাদের মাথায় লোন পরিশোধের একটা চিন্তা থাকে। ফলে তারা তাদের উৎপাদিত পণ্য থেকে ক্ষতিটা পুষিয়ে নিতে চান। ফলে সবকিছু বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে যে, করোনার ফলে শহরের বাজারগুলোতে বড় ধরনের ঊর্ধ্বমুখী প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
খাদ্যমূল্য শহরের গরিব মানুষগুলোর নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে
উন্নয়নশীল দেশগুলোর খাদ্য সরবরাহব্যবস্থায় করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রভাব নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ (ইফপ্রি) একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে তারা বলছে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার ফলে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে খাদ্যসংকট দেখা দেবে। এসব দেশে খাদ্য মজুত যত ভালোই থাকুক না কেন, গরিব মানুষের কাছে যদি পর্যাপ্ত খাদ্য পৌঁছানো না যায়, তাহলে কোনো লাভ নেই। কেননা, উন্নয়নশীল দেশগুলোর ৮০ শতাংশ মানুষ বাজার থেকে খাবার কিনে খায়। তার মানে বাজারে যদি স্বল্পমূল্যে খাবারের সরবরাহ নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে এসব দেশের দরিদ্র মানুষ খাদ্য নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় পড়বে।
ইফপ্রির ওই বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর ৩৫ থেকে ৫০ শতাংশ খাদ্য এখন করপোরেট শিল্পগোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ও খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার ফলে সাধারণ মানুষের কাছে খাদ্য সহজে পৌঁছবে না। করোনা সংকট কেটে যাওয়ার পরও খাদ্য নিয়ে সংকট থেকে যাবে। ফলে এসব উন্নয়নশীল দেশের খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়ে সঠিকভাবে এগোতে হবে। নয়তো দেশগুলোর বিপুল জনগোষ্ঠী খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়বে।
জাতিসংঘের খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) আরেকটু আগ বাড়িয়ে বলেছে, করোনার কারণে বিশ্বে খাদ্যসংকট দেখা দেবে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম থেকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন বলেছে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ফলে বাংলাদেশে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।(২২)
[২২. ইফতেখার মাহমুদ, ‘খাদ্য মজুত ভালো, চিন্তা সরবরাহ আর কেনার ক্ষমতা নিয়ে’, ০৯ এপ্রিল ২০২০, প্রথম আলো]
করোনার কারণে বাংলাদেশে লকডাউন চলছে। এই লকডাউনের পক্ষে-বিপক্ষে আছে ভিন্ন ভিন্ন মত। যাদের জমানো টাকা আছে, বাসায় খাদ্যের পর্যাপ্ত মজুত আছে তারা লকডাউনের পক্ষে। তারা স্বাস্থ্যঝুঁকি নিতে রাজি নন। আর যেসকল নিম্ন-মধ্যবিত্ত বা গরিব শ্রেণির লোক রয়েছেন, যাদের হাতে নগদ অর্থ নেই, পর্যাপ্ত খাদ্যের মজুত নেই তারাই করোনার ভয় উপেক্ষা করে ঘর থেকে বের হচ্ছেন শুধু খাবারের আশায়। সরকারের ত্রাণ ব্যবস্থা চালু আছে, গরিবদের জন্য ১০ টাকা কেজি চালের ব্যবস্থাও আছে। এছাড়া টিসিবির ন্যায্যমূল্যের পণ্য বিক্রিও চালু আছে। কিন্তু তারপরও এই ব্যবস্থাগুলো শতভাগ দরিদ্র মানুষের তুলনায় অপ্রতুল। বাজারে করোনার প্রভাবে জিনিসপত্রের দাম এমনিতেই বেশি। এর মধ্যে আবার রমজান ও ঈদের একটা প্রভাব আছে। এই অবস্থায় গরিব মানুষগুলো অসহায়ভাবে দিনযাপন করছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই অবস্থা চলতে থাকলে নিত্যপণ্যের দাম গরিব মানুষগুলোর নাগালের বাইরে চলে যাবে। শুধু গরিবরাই নয়, মধ্যবিত্তরাও হিমশিম খাচ্ছেন তাদের সংসারে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের জোগান নিশ্চিত করতে। এসকল মানুষ যারা ত্রাণের জন্য হাত পাততে পারেন না তাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন সংগঠন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পরিচয় গোপন রেখে তাদের কাছে সহয়তা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে।
আমাদের কী করা উচিত
খাদ্যের ব্যবস্থাপনা বলতে আমরা বুঝি, খাদ্যের উৎপাদন ব্যবস্থার পূর্ব-প্রস্তুতি থেকে শুর করে খাদ্যের উৎপাদন, সরবরাহ, পরিবহন, বাজারজাতকরণ, বাজার নিয়ন্ত্রণ, পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ এবং ন্যায্যমূল্যে খাদ্যপণ্য ক্রেতার কাছে পৌঁছানো। এখানে প্রত্যেকটি পদক্ষেপই গুরুত্বপূর্ণ। খাদ্য ব্যবস্থাপনার সফলতার জন্য প্রতি স্তরেই সরকারের পক্ষ থেকে আলাদা নজর দেয়া প্রয়োজন। খাদ্য উৎপাদনের পূর্ব-প্রস্তুতির মধ্যে কৃষকদের ও খাদ্য উদ্যোক্তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ, ঋণ প্রদান, সহয়তাসামগ্রী প্রধান, সার-বীজ-চারা এগুলোর সরবরাহ, উন্নত মানের জাত নির্ধারণের জন্য গবেষণা বৃদ্ধি, পোল্ট্রি, মৎস্য ও গবাদি পশু পালনে বিশেষ ঋণ সহয়তা, প্রশিক্ষণ, উন্নত পশুর জাত সরবরাহের জন্য বিশেষ ব্যবস্থাসহ সকল সহয়তা সঠিক সময়ে সঠিক উপায়ে প্রদান করতে হবে। এসব খাদ্যপণ্য সরবাহ ব্যবস্থা মনিটরিংয়ের জন্য সৎ ও বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে মনিটরিং টিম গঠন করতে হবে। প্রান্তিক চাষীরা যেন সরাসরি সরকার ঘোষিত সুযোগসমূহ গ্রহণ করতে পারেন, মনিটরিং টিম সেটা পর্যবেক্ষণ করবে। কৃষক ও খাদ্যপণ্য উৎপাদকদের তাদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে যেন তারা খাদ্যভিত্তিক পেশার অগ্রগতির জন্য আরও বেশি আগ্রহী হন।
আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও উন্নত করতে হবে এবং অনলাইন মার্কেটিংয়ের সাথে দেশের প্রান্তিক অঞ্চলের কৃষকদেরও সম্পৃক্ত করতে হবে। ট্রাডিশনাল পদ্ধতিতে ধান বিক্রির প্রথা থেকে বেরিয়ে এসে কৃষকদের যদি অনলাইন প্লাটফর্মের সাথে সংযুক্ত করা যায় তাহলে সরাসরি ধান বিক্রির মাধ্যমে আরও বেশি লাভবান হতে পারবেন তারা। স্বপ্ন, আগোরার মতো বড় বড় করপোরেট হাউসগুলোসহ বাজারগুলোতে কৃষকরা যদি সরাসরি চাল সাপ্লাই দিতে পারেন, এটা কৃষির জন্য বড় একটি সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। এই ব্যবস্থাপনার সম্ভাবনা জানার জন্য বিস্তারিত গবেষণা হতে পারে।
একইভাবে পোল্ট্রি, মৎস্য ও গবাদিপশু পালনকারীদেরও তাদের পণ্য বিক্রির জন্য অনলাইনে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। খাদ্যের মান নিশ্চিত ও বাজার নিয়ন্ত্রণে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, নিরাপদ খাদ্য নিরাপত্তা আইনসহ অন্যান্য আইন বাস্তবায়ন সম্পর্কে কঠোর হতে হবে। সরকার নির্ধারিত মূল্য অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে এবং অবৈধভাবে খাদ্যপণ্য মজুতের বিরুদ্ধে আরও কঠোর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। গরিবদের জন্য ন্যায্য মূল্যের খাদ্যপণ্য বিক্রির পরিধি আরও বাড়াতে হবে। দরিদ্র মানুষের ক্যাটাগরি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সহায়তা এবং তারা যেন করোনা-পরবর্তীকালে স্বাভাবিক জীবনযাপন চালিয়ে যেতে পারেন সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
শহরাঞ্চলগুলোকে ভাগ করে সেখানকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি পরিপূর্ণ লিস্ট সরকারের পক্ষ থেকে তৈরি করতে হবে এবং সে অনুযায়ী সহয়তা তাদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে হবে। যাতে এই ত্রাণ ও খাদ্য সহায়তায় কোনো অনিয়ম না হতে পারে। সরকারি ত্রাণ নিয়ে যারা দুর্নীতি করে তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। বাজার ব্যবস্থাপনায় একটি ন্যায্যমূল্য সরকারকে নির্ধারণ করে দিতে হবে, প্রতিটি পণ্যের জন্য। বর্তমানে সরকার কর্তৃক খাদ্যপণ্যের দাম নির্ধারিত থাকলেও সেটি মানে কজন, সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। খাদ্যপণ্যের মূল্য যেন সকল শ্রেণির মানুষের আওতাধীন থাকে, সেটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। যেসকল খাদ্যপণ্য আমরা আমদানি করি সেগুলো নিজেদের দেশে উৎপাদন করা সম্ভব হলে এই ব্যাপারে কৃষকদের আগ্রহী করতে হবে। এই খাতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে গবেষণার জন্য সরকারের বিশেষ ফান্ডিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের উদ্বৃত্ত খাদ্যপণ্য রফতানি করে যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করি তার একটি বিশেষ অংশ খাদ্য ব্যবস্থাপনার সফলতার জন্য ব্যয় করতে হবে।
সর্বোপরি করোনাকালীন এবং করোনা-পরবর্তী সময়ে খাদ্য সংকটের সম্মুখীন যাতে না হতে হয় সেজন্য শক্ত হাতে আমাদের খাদ্য ব্যবস্থাপনাটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আমাদের যথেষ্ট খাদ্য মজুত আছে। এখন প্রয়োজন এর সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং নিয়ন্ত্রণ। তাহলেই আমরা করোনার ফলে সম্ভাব্য খাদ্যবিপর্যয় কাটিয়ে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারব।
ডা. শামীম তালুকদার, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, এমিনেন্স-বাংলাদেশ
E-mail: [email protected]
এমএআর/এমএস